শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

বসুন্ধরা


এভাবে ছ’মাস কেটে গেল। কোনও অঘটন ঘটেনি এটা বুঝে শ্যামসুন্দর একটু নিশ্চিত হলেন। কৃষ্ণসুন্দর বায়না ধরল ভাইপোর অন্নপ্রাশনের। দাদা রাজি হয়ে গেলেন।

অন্নপ্রাশনের জোগাড়যন্ত্র নিমন্ত্রণ সব একা কৃষ্ণসুন্দর সামলাতে লাগলেন। অন্নপ্রাশনের ঠিক দু’দিন আগে কৃষ্ণসুন্দরের খেয়াল হল সে তার পালাগানের গুরু রাখাল গোঁসাইকেই আমন্ত্রণ জানাতে ভুলে গেছে। তিনি থাকেন মানিকগঞ্জ। মানিকগঞ্জ যেতে গেলে মাঝে পদ্মা নদী। নিমন্ত্রণ সেরে ফেরার পথে আচমকা ঝড় উঠল। নৌকাডুবিতে মারা গেলেন কৃষ্ণসুন্দর। যেদিন অন্নপ্রাশন হবার কথা ছিল সেদিন ভাইকে শ্মশানে দাহ করে বাড়ি ফিরলেন বিধ্বস্ত শ্যামসুন্দর।

শ্যামসুন্দর বাকরুদ্ধ হলেন। অপঘাতে মৃত ভাইয়ের চতুর্থীর কাজ শেষ করে সে রাতেই দেশান্তর হলেন শ্যামসুন্দর।

ছয় মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে বসুন্ধরা পড়লেন অকূল পাথারে। বাবা মুকুন্দ সেনগুপ্ত মেয়েকে নিজের কাছে কোটালীপাড়ায় এনে রাখলেন। তবে এই দুর্ঘটনার কারণেই বিনয়কান্তির আর অন্নপ্রাশন হল না। মা বসুন্ধরার নির্দেশে পরবর্তীকালে এ পরিবারে কখনও কোনও শিশুর অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয়নি।

বিনয়কান্তি দাদুর শিক্ষায় ও স্নেহে বেড়ে উঠতে লাগল। বসুন্ধরার ভাইয়েরাও ভাগ্নে বিনয়কে খুব স্নেহ করত। কিন্তু বসুন্ধরা বুঝতে পারত এভাবে আজীবন থাকা যাবে না। ভাইদের বউরা মুখে কিছু না বললেও তাদের নিঃশব্দ করুণা বসুন্ধরাকে শান্তি দিত না। মেধাবী বিনয়কান্তির সাফল্য বসুন্ধরার একমাত্র স্বপ্ন। ভাইপোকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেওর কৃষ্ণসুন্দর দাদার অজান্তে বউদি বসুন্ধরাকে জানিয়ে গিয়েছিল জ্যোতিষীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী। দেওর কৃষ্ণসুন্দরের মতোই বসুন্ধরাও এই ভবিষ্যদ্বাণী অলীক বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণসুন্দরের আচমকা দুর্ঘটনা এবং স্বামীর দেশান্তরি হওয়ার ঘটনায় বসুন্ধরার একটু একটু করে জ্যোতিষীর কথা সত্যি বলে মনে হতে লাগল।

বাবা মুকুন্দ অসুস্থ হলেন। বসুন্ধরার মনে অজানা আশঙ্কার মেঘ দেখা দিল। বাবার কাছে একদিন বিনয়কে নিয়ে গিয়ে বসুন্ধরা জানাল, বাবা তুমি বিনয়কে আশীর্বাদ করো। ও যেন আর পাঁচজনের ভিড়ে মিশে না যায়। ও যেন পাঁচজনের মধ্যে আলাদা করে পঞ্চম হয়ে উঠতে পারে।

অসুস্থ মুকুন্দ বুঝতে পেরেছিলেন কেন তার মেয়ে নাতির জন্যে আশীর্বাদ চাইছে। তিনি প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন।

বসুন্ধরা প্রায়ই পত্র মারফত বাখুন্ডার খোঁজ নিত। হয়তো শ্যামসুন্দর ফিরে আসার একটা ক্ষীণ আশা তার মধ্যে তখনও জিইয়ে ছিল। বাখুন্ডায় পাড়াতুতো খুড়োমশাই পত্র পাঠালে তার উত্তর দিতেন। তিনিই শ্যামসুন্দরের বাড়ি-জমি-পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। বিনিময়ে বসুন্ধরা তাঁকে কোনও অর্থ পাঠাতে পারেনি। কিন্তু তিনি ক্রমাগত বলতেন, বাখুন্ডার খুড়োমশাই আমাদের জন্যে যা করছেন সেটা দয়া কিন্তু খরচখরচা যা কিছু করছেন সেটা ধার। আমাদের সেই ধার কিন্তু শোধ করতে হবে বিনু৷

অনেক পরে বিনয়কান্তি এই শিক্ষা থেকেই উইলিয়াম পিটারসনের অসাধারণ দাক্ষিণ্যকে মাথা পেতে নিয়েছেন কিন্তু কোম্পানির যোগ্য ভারতীয় অর্থমূল্য লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মুকুন্দ চলে গেলেন। শ্রাদ্ধশান্তি মিটল। ভাই-ভাইবউদের তরফ থেকে কোনও কথা ওঠার আগেই বসুন্ধরা জানিয়ে দিলেন তিনি বাখুন্ডায় ফিরে যাবেন।

স্বামী দেশান্তরি হবার পর মাত্র ৬ মাসের ছেলেকে নিয়ে একা বাখুন্ডায় থাকাটা খুব কঠিন ছিল। সেদিন বাবা আমার ভাই-ভাইবউরা না থাকলে হয়তো ভেসে যেতাম। তোমরা আমার বিনুকে মানুষ করে দিয়েছ। এখন আমি ছেলের হাত ধরে বাকি জীবনটা বেঁচে থাকতে পারব। তোমরা আর না কোরো না, আমায় বাখুন্ডা ফিরে যেতে দাও।

বাখুন্ডায় স্বামীর ভিটেতে ফিরল বসুন্ধরা। বসুন্ধরা ছিল সৎ, ছিল জেদি এবং একই সঙ্গে বুদ্ধিমতী। কথাগুলো ভাইদের সামনে বলে এলেও বসুন্ধরা জানত যে মাত্র ১২ বছরের নাবালক ছেলেকে নিয়ে একা সে স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। তাই তার একটা ভদ্র নিশ্চিন্ত আশ্রয় চাই।

গুহ বাড়ি


বাখুন্ডায় গুহরা ছিলেন বর্ধিষ্ণু সজ্জন ব্যবসায়ী পরিবার। তাদের অনেক ব্যবসা ছিল। গুহবাড়ির কর্তার সবচেয়ে বড় ব্যবসা ছিল পাটের। এই পাটের ব্যবসার কাজেকর্মে কর্তাবাবু গিরিজাশঙ্কর গুহ এবং ছেলেপিলেদের কলকাতা যেতে হত। এর কিছুদিন আগে পর্যন্ত কলকাতাই ছিল দেশের রাজধানী শহর।

গিরিজাবাবু সৎ শিক্ষক শ্যামসুন্দরকে খুব পছন্দ করতেন। শ্যামসুন্দরের বিয়ের পর গুহবাড়ির কত্তা-মা নিজের হাতের সোনার চুড়ি খুলে বসুন্ধরাকে পরিয়ে দিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন।

কৃষ্ণসুন্দরের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর দাদা শ্যামসুন্দর যখন দেশান্তরি হলেন তখন এই কত্তামা-ই বসুন্ধরাকে তার ছেলেকে নিয়ে গুহবাড়িতে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। বসুন্ধরা জানিয়েছিল—

এখন বাবা আমায় নিতে এসেছেন কত্তা-মা। এখন আমি বাবার কাছে কোটালীপাড়ায় গিয়ে থাকব। তবে বাবা তো চিরকাল থাকবেন না ভবিষ্যতে যদি কখনও বিপদে পড়ি তখন আমি বাখুন্ডায় এই গুহবাড়িতে আপনার আশ্রয়ে এসে উঠব৷

জীবন তার আপন খেয়ালে চলে। কখন? কে? কোন অবস্থায়? কী বলেন? কেন বলেন? তার উত্তর একমাত্র ঈশ্বরের কাছেই আছে।
বাখুন্ডায় ফিরে বসুন্ধরা তার স্বামী ও দেওরের যা সামান্য জমিজমা পুকুর ছিল সব বিক্রি করে দিল। গুহবাড়ির কর্তা-মার সঙ্গে বাখুন্ডায় পৌঁছে দেখা করেছিল। এবার পাকাপাকিভাবে ছেলের হাত ধরে গুহবাড়ির আশ্রয়ে উঠল। কিন্তু নিতান্ত আশ্রিতের মতো থাকতে রাজি নয় বসুন্ধরা। শেষমেশ গুহবাড়ির রাঁধুনির কাজে যোগ দিল বসুন্ধরা।

মাঝে কিছুদিন লেখাপড়ায় বিরতি পড়ে গিয়েছিল। বিনয়কান্তি মনপ্রাণ দিয়ে লেখাপড়া করতে চাইছিল। কিন্তু কোটালীপাড়া থেকে ফিরে আসার পর আবার নতুন করে শুরু করা হয়ে ওঠেনি।

ল্যাপটপের কিবোর্ড থেকে আঙুল তুলে ভাবতে থাকে ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো স্কটলান্ড থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার-আইআইএম কলকাতা থেকে ম্যানেজমেন্ট পাশ করা সুবর্ণকান্তি দত্ত। চেয়ার ছেড়ে উঠে লনের দিকের বড় খোলা জানালার সামনে দাঁড়ায়।

সবুজ গালচের মতো লন টপকে বসুন্ধরা ভিলার পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে সাবেকি দু-একটা বাড়ি। তারপর একটা উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি আর একখানা বড়গাছ আকাশের অনেকটা ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু তারও ওপারে যে চিলতে আকাশের টুকরো দেখা যাচ্ছে, তাতে মেঘ ফুঁড়ে উদ্ধতভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার নতুন গর্ব ৬৫ তলার গগনচুম্বী অট্টালিকা- ‘THE 42’ – ৪২বি জহরলাল নেহরু রোডের এই জমির মালিক ছিলেন দ্বারভাঙার মহারাজা। সুবর্ণ শুনেছে ওই বাড়িতে চার থেকে ছয় কামরার এক একটা ফ্ল্যাটের দাম নাকি সাড়ে ১৬ কোটি টাকা।

জানালা থেকে সুবর্ণ আবার ফিরে আসে তার ল্যাপটপের কাছে, চোখ বুঝিয়ে ভাবে যদি কেউ একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে সাফল্য ও উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছোতে চায়, তার অনেক অনেক গুণের দরকার হয়। এক বুক সাহস, তা না হলে প্রতি মুহূর্তের অনিশ্চয়তাকে জয় করা যাবে না। চাই উপযুক্ত শিক্ষা আর বুদ্ধি তা না হলে দিকভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা। নিজের কাজের প্রতি আর আশপাশের মানুষের প্রতি সততা না থাকলে অন্যের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা যাবে না। চাই স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর মনোযোগ, চাই অদম্য জেদ, অসীম ধৈর্য, চাই লড়াই-এ টিকে থাকার অধ্যবসায়, পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি করতে হবে তাই চাই আগাম অনুমান শক্তি, কিছু গড়তে গেলে চাই অগাধ আত্মবিশ্বাস, চাই অমানসিক পরিশ্রমের ক্ষমতা আর চাই পাগলামো। নিজের স্বপ্নকে সফল করার বেলাগাম পাগলামো।

বিনয়কান্তি দত্তের মতো আশ্চর্য উত্থানের নায়ক যে সমস্ত উদ্যোগী পুরুষ তাদের মধ্যে কমবেশি এই গুণগুলো থাকে। বিনয়কান্তি এইসব গুণ পেয়েছিলেন তার বাবা শ্যামসুন্দর এবং মা বসুন্ধরার কাছ থেকে। তবে ছয় মাসের শিশুকে গড়ে তুলেছিলেন মা বসুন্ধরা৷ মায়ের কাছেই বিনয়কান্তি বাবার কথা শুনেছে। বিনয়কান্তি জানত তার মা বিশ্বাস করেন বাবা একদিন ফিরে আসবেন। অলীক অপেক্ষায় দিন কাটত মায়ের।

সাহসী উদ্যোগে পুরুষদের সৌভাগ্য সহায়তা করে। বিনয়কান্তির ক্ষেত্রেও ঘটল এক অবাক কাণ্ড৷ —চলবে
পরের পর্ব আগামী রবিবার
দুশ্চিন্তা কোরো না মা।… গুহবাড়ির পাটের জমাখরচের হিসেব লিখে আর কচিবাচ্চাদের এবিসিডি পড়িয়ে জীবনের ইতি টানতে আমি রাজি নই। আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছি মা। একটা। একটা পাকা চাকরির সুযোগ। যেখানে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারব।… আর তুমিই তো ছোটবেলায় শিখিয়েছ মা-পাঁচজনের ভিড়ে মিশে থাকা একজন নয়—আলাদা করে পঞ্চম জন হয়ে উঠতে হবে।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content