রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

দেখা জানা শোনা


আমরা যারা ষাটের আনাচেকানাচে তারা অনেক কিছু দেখেছি। পাকানো কালো বা সাদা তারের বিনুনি ঝোলানো কালো ঝনঝন করে বাজা গম্ভীর টেলিফোন থেকে হাল আমলের লাল-নীল-সবুজ পাতলা ঝকঝকে মোবাইল ফোন। হিটার থেকে মাইক্রোওভেন কুকিংরেঞ্জ। ঘরের কোণজোড়া চারপেয়ে ঢাউস টেলিভিশনের ঢাকনা-বন্ধ বাক্স থেকে দেওয়াল জোড়া পাতলা ফিনফিনে স্মার্ট টিভি। ছাতে একসঙ্গে ডাবল অ্যান্টেনা। নীচে একটু মোটাসোটা কাক-বসা পাইপের আমাদের দূরদর্শন অ্যান্টেনা আর তার ওপরে কোনাকুনি কাতলা মাছের কাঁটার মতো বাংলাদেশের অ্যান্টেনা। সেই থেকে আজ তারে তারে ছয়লাপ কেবল্ আর ব্রডব্যান্ড কানেকশন। চোখের সামনে রেকর্ড, রেকর্ড থেকে ক্যাসেট, ক্যাসেট থেকে ভিডিও ক্যাসেট৷ তার থেকে সিডি ভিসিডি হয়ে মাইক্রো কার্ড পেনড্রাইভ সিগারেট কেসের মতো হার্ড ড্রাইভ।

আমরা চিঠি দেওয়া প্রেম দেখেছি। ভেজানো-দরজা ক্লাস রুমের ভেতরে, দোল সরস্বতী পুজোয় পুরোনো প্রেম ভেঙে নতুন প্রেম গড়তে দেখেছি। বাড়ি পালিয়ে কালীঘাটের বিয়ে, চুপি চুপি পিছনের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে বিয়ের রাতে পালানো কনের অনেক গল্প শুনেছি। আবার এখন ফেসবুকের প্রেম হোয়াটস অ্যাপে ভাঙতেও দেখছি। পাকাদেখা আইবুড়োভাত খাওয়া জলসইতে যাওয়া গায়েহলুদ নান্নিমুখ সাতপাকেবাঁধা শুভদৃষ্টি মালাবদল নাপিতের-বুলি বিয়ের-মন্ত্র সিঁদুর-পরানো বাসরে-হারমোনিয়াম বাসি-বিয়ে কনকাঞ্জলি দুধ-ওতলানো বধূবরণ সাদা লালপাড় মেঝেতে পাতা শাড়িতে দুধে-আলতায় ডোবানো লক্ষ্মীমন্ত পায়ের ছাপ। কালরাত্রি ভাতকাপড় বউভাত নিমন্ত্রিত-ভোজন ফুলশয্যা যা দেখে বড় হয়েছিলাম সেটা এখন সাদাকালো ছবির মতোই ইতিহাস। এখন ডিজিট্যাল বিয়ে। সেখানে এখন প্রি-ওয়েডিং শ্যুটের ফোটোগ্রাফার, বিয়ের আগের দিন ‘সাংগীত’এর কোরিওগ্রাফার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এটা বাংলায় নয়া আমদানিকৃত সংস্কৃতি তাই সংগীত এখন সাংগীত। কোরিওগ্রাফার ফুলপিসি পিসেমশাই ছোট মাসি-মেসোকে নাচের স্টেপ দেখাবেন, মেকাপ আর্টিস্ট ওয়েডিং ম্যানেজার ডিজে গর্জাস ফুড সার্ভিস গ্রুপ ফোটোশ্যুট ‘বিদাই’ (বরকনে বিদায় অপভ্রংশে), রিসেপশনের গ্র্যান্ড পার্টি এবং ড্যান্স-এর ঝাঁকানাকা উপস্থাপনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একসময় মেরাপ বেঁধে বাড়ি আলোয় মুড়ে দিয়ে বিয়ে হত, তারপর বাড়িতে ঝঞ্ঝাট না করে বিয়ে বাড়ি ভাড়া করার চল এল। তারপর হোটেলের ব্যাংকোয়েট আর ঘর ভাড়া করে রান্নার ঠাকুর চাকর পরিবেশনকারী না রেখে হিন্দি ছবির বিয়ে শুরু হল। আর এখন ফিল্মস্টারেরা শুরু করেছেন ডেস্টিনেশন ওয়েডিং। উচ্চ মধ্যবিত্তরা তৈরি হচ্ছেন। এ জীবনে সেও দেখে যাব।

বাখুন্ডা, ফরিদপুর


অমলকান্তি লিখে গেছেন বাখুন্ডার কথা। বাখুন্ডা অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার একটি রেল স্টেশন। রাজবাড়ি থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন ছিল। ১৮৯৯ সনে এই ঐতিহ্যবাহী রেলরুটে ফরিদপুর এক্সপ্রেস যাতায়াত করত। তখন বাখুন্ডা ছিল ফরিদপুরের একটি পল্লিগ্রাম। গত ২০২০ সালে ফরিদপুর থেকে বাখুন্ডা হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের পুনর্নির্মাণ করা হয় আর চালু হয় রাজবাড়ি থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন ট্রেন রাজবাড়ি এক্সপ্রেস।

বিনয়কান্তির বাবা বাখুন্ডার শ্যামসুন্দর দত্ত ছিলেন ঈশ্বরবিশ্বাসী এক ধার্মিক মানুষ। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। শ্যামসুন্দরের মা-বাবা দুজনেই এক ভয়ংকর কালবৈশাখীর রাতে একই সঙ্গে নৌকাডুবিতে মারা যান। দুই ভাই শ্যামসুন্দর ও কৃষ্ণসুন্দরকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে মানুষ করলেন তাদের বিধবা নিঃসন্তান পিসি তারাসুন্দরী। তখন শ্যামসুন্দরের বয়স নয় আর ভাই কৃষ্ণসুন্দর মাত্র দু বছরের শিশু। পিসি তারাসুন্দরী খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা ছিলেন। পিসেমশাইয়ের ছিল পাটের কারবার। বরিশালের নলচিতিতে ছিল বিরাট বাড়ি। তবে কম বয়স থেকেই তারাসুন্দরীর ছিল প্রবল হাঁপানির অসুখ। শীতকালে খুব বাড়াবাড়ি হত।

পিসির খুড়তুতো জেঠতুতো জ্ঞাতি আত্মীয়রা নিঃসন্তান অসুস্থ বিধবার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি দখল করার অপেক্ষায় ছিল। মাঝে দুই অনাথ ভাইপো এসে পড়াতেও তাদের সমস্যা ছিল না। কিন্তু ভাইপোরা সাবালক হতেই তারাসুন্দরী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তার স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু সম্পত্তি সব দুই ভাইপোর নামে লিখে দিয়ে যাবেন। কুচক্রী স্বজনরা নড়েচড়ে বসল। এক নিশুতি শীতের রাতে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হল পিসিমা তারাসুন্দরীকে। ভাইপোরা যতদিন ছোট ছিল তারা রাতে পিসিমার কাছেই শুত। কিন্তু সাবালক হবার পর দুই ভাই অন্য ঘরে থাকতে শুরু করে। সেই নিঃশব্দ রাতে বড়ভাই শ্যামসুন্দর যেন একটা আর্তচিৎকার শুনেছিল। কিন্তু সে ভাবতে পারেনি এ চিৎকার তার পিসিমা তারাসুন্দরীর। পিসিমা যে হাঁপের কষ্টেই দম আটকে মারা গেছেন গ্রামের কবিরাজ এবং আর সকলে সেটাই মেনে নিল। কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই মৃতদেহ দাহ হল। যাতে তারা সম্পত্তির অংশে কোনও ভাগ বসাতে না পারে তাই লোভী আত্মীয়রা মৃতার দুই ভাইপোকে করণীয় শ্রাদ্ধের কাজটুকুও করতে দেয়নি। পরদিনই দুই ভাইকে নলচিতির বাড়ি ছাড়া করল তারা।

ফরিদপুর ফিরে এল দুভাই। বাখুন্ডার পুরোনো মাটির বাড়ি আবার গড়ে নিয়ে থাকা শুরু করল তারা। শ্যামসুন্দর শিক্ষকতা করত আর কৃষ্ণসুন্দর পালাগান গেয়ে বেড়াত। ছোটবেলায় মা-বাবা এবং বড় হয়ে পিসিমার মৃত্যুর ঘটনায় শ্যামসুন্দর খুব বিচলিত থাকত। জনাকয়েক পরামর্শ দিল জ্যোতিষ দেখিয়ে প্রয়োজনে একটা শান্তি স্বস্ত্যয়ন করানোর। জ্যোতিষী জানাল শ্যামসুন্দরের গ্রহ অবস্থানের কারণে এমন দুর্যোগ ঘটছে। শ্যামসুন্দরের যদি পুত্র হয় তবে সে হবে একজন উদ্যোগী পুরুষ, তবে তাকে অনেক সংগ্রাম অনেক কষ্টের রাস্তায় সফল হতে হবে। কিন্তু পুত্রসন্তান হলে তার ভাই কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুযোগ আছে। শ্যামসুন্দর সিদ্ধান্ত নিল সে এ জীবনে বিবাহ করবে না। ভাই কৃষ্ণসুন্দর বাউন্ডুলে মানুষ, পালাগান নিয়ে মেতে থাকে। সে দাদাকে বারবার বলতে থাকে দাদা যেন সংসারী হয়। জ্যোতিষীর সে ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী গোপনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শ্যামসুন্দর। জ্যোতিষীকে করজোড়ে অনুরোধ করেছিল কোনওদিন যেন তার ছোটভাই বা গ্রামের কেউ এ কথা জানতে না পারে।

বহু দিন কেটে গেল। গ্রামের পাঁচজনের পরামর্শে শ্যামসুন্দর উপলব্ধি করলেন যে এভাবে জীবন কাটানোর কোনও অর্থ নেই। সম্পর্কে এক খুড়ো সম্বন্ধ নিয়ে এল। ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর সাব ডিভিশনের মধ্যে এক ছোট্ট গ্রাম কোটালীপাড়া। সে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই মুকুন্দ সেনগুপ্তের বড়মেয়ে বসুন্ধরা। মা মারা গেছেন। তিনি একটি সুপাত্র খুঁজছেন। শ্যামসুন্দর শিক্ষকতা করেন জেনে তিনি বিশেষ উৎসাহী। তিনি শ্যামসুন্দরের মা-বাবার দুর্ঘটনার মৃত্যুর খবর পিসিমার কাছে মানুষ হওয়া পিসিমার অস্বাভাবিক মৃত্যু—সবই শুনেছেন। তাঁর কোনও আপত্তি নেই। গ্রামের সকলের উৎসাহে বিয়েটা হল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রকৃতির নিয়মে বসুন্ধরা সন্তান-সম্ভবা হলেন। ১৯০৫-এর কাকভোরে বসুন্ধরা জন্ম দিল এক পুত্রসন্তানের। আরও শঙ্কিত হয়ে উঠলেন শ্যামসুন্দর। তবে কি জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাবে?

বসুন্ধরার বাবা নাতির নাম রাখলেন বিনয়কান্তি। দিনে দিনে শিশু বড় হতে লাগল। আর প্রাণপ্রিয় ভাই কৃষ্ণসুন্দরের অজানা মৃত্যু আশঙ্কায় ছটফট করতে লাগলেন শ্যামসুন্দর। ভাই কৃষ্ণসুন্দরকে তিনি পালাগান গাইতে যেতে দিতেন না৷ সারাদিনই নানা অছিলায় ভাইকে বাড়িতে রেখে দিতেন। কোনওদিন ইস্কুলফেরত শ্যামসুন্দর ভাই কৃষ্ণসুন্দরকে সামনে না দেখলে ভীষণ রেগে যেতেন, ছটফট করতেন, স্ত্রী বসুন্ধরার উপর অযথা রাগারাগি করতেন। কৃষ্ণসুন্দর লক্ষ করতে থাকে দাদার এই পাগলামিটা ক্রমশ বাড়ছে। দাদা রাতে ঘুমোয় না, সারারাত উঠোনে পায়চারি করে। মাঝে মাঝে ভাইয়ের ঘরে গিয়ে দেখে সে ঘুমোচ্ছে কি না। স্ত্রী বসুন্ধরা জানত না কেন মাঝেমধ্যে তার স্বামী অদ্ভুতভাবে তার শিশুসন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কৃষ্ণসুন্দর গোপনে দাদার চিকিৎসার জন্য এখানে সেখানে কবিরাজের খোঁজ করতে লাগল। এভাবেই একদিন সে জানতে পারল দাদার মানসিক অশান্তির কারণ এক জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী।

এরপর কৃষ্ণসুন্দর রাতে আর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। দাদার অজান্তে সে দাদাকে নজর করতে থাকে।

এদিকে একদিন মাঝরাতে শ্যামসুন্দর ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশ থেকে শিশুকে তুলে নিয়ে চলে গেল পুকুরঘাটে। পুকুরঘাটে জলে ডুবিয়ে আত্মজকে হত্যা করতে চেয়েছিল অসহায় বাবা শ্যামসুন্দর। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে শিশু বয়সে বিনয়কান্তি রক্ষা পেলেন কাকা কৃষ্ণসুন্দরের তৎপরতায়। —চলবে
পরের পর্ব আগামী রবিবার
ছ’মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে বসুন্ধরা পড়লেন অকূল পাথারে। বাবা মুকুন্দ সেনগুপ্ত মেয়েকে নিজের কাছে কোটালীপাড়ায় এনে রাখলেন। তবে এই দুর্ঘটনার কারণেই বিনয়কান্তির আর অন্নপ্রাশন হল না। মা বসুন্ধরার নির্দেশে পরবর্তীকালে এ পরিবারে কখনও কোনও শিশুর অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয়নি।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content