অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী
সুবর্ণকান্তি
লকডাউন না হলে এ বাড়ির লাইব্রেরি ঘরটা খোলা হত না!! না, এটা করোনার ভালো দিক নয়, কিন্তু এরকম নিশ্ছিদ্র অবকাশ মিলত কি??
আমি সুবর্ণকান্তি দত্ত। আমি প্রথম ব্যাচ মাধ্যমিক। প্রথম ব্যাচ উচ্চমাধ্যমিক। এখন আমি ষাট পেরিয়ে গেছি। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল-যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। তারপর ইউকে-র গ্লাসগোতে মাস্টার্স করিয়ে আনেন দাদু বিনয়কান্তি দত্ত। পরে আইআইএম কলকাতার ম্যানেজমেন্টের ছাপ। সরকারি অফিস হলে এখন তো রিটায়ারমেন্ট হয়ে যেত, নিজেদের ব্যবসা তাই রিটায়ারমেন্ট নেই, কিন্তু করোনার প্রকোপ আমার সেমি-রিটায়ারমেন্ট করিয়ে দিল। ব্যবসা এখন আমার ছেলে ঋজু বা অন্য ভাইপোরা অমিত প্রমিত শুভ্ররা দেখে। আমাদের পরিবারের প্রথা মেনে ওদের সকলের নামের সঙ্গেও কান্তি জুড়ে আছে। সক্কলে এখনও এই বাড়িতে থাকেন। একান্নবর্তী পরিবার, আজও। সেটা সম্ভব হয়েছে এক অদ্ভুত কারণে।
আমি কখনও লেখালিখি খুব একটা করিনি। আমার বাবা অমলকান্তি দত্ত লিখতেন৷ নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন। আমার মা সুরঙ্গমা ফিল্মে অভিনয় করতেন। অমলকান্তির সঙ্গে সুরঙ্গমার বিয়ে, সে একটা গোটা গল্প। বাবার লেখার ঘর আলাদা ছিল—সেটা এই লাইব্রেরি ঘরের লাগোয়া। লিখতে লিখতে বইয়ের দরকার পড়ত, বাবা নিয়ম করে অফিস যাবার মতোই চান করে ব্রেকফাস্ট সেরে একতলার এই লেখার ঘরে এসে ঢুকতেন—কাজের লোকেরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা দিয়ে যেত। লিখতে লিখতে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া বাবার অভ্যেস ছিল। আবার দুপুর দেড়টায় ওপরে যেতেন খাওয়া-দাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম, একটু খবরের কাগজ। ঠিক ঘণ্টা দুয়েক পর সাড়ে তিনটের সময় আবার লেখার ঘর। আমাদের সামলাতেন মা। তিনি এমন একজন মা যিনি সংসার করার জন্য হাসিমুখে নিজের ঝকমকে ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে নকল করে মাঝেমধ্যে ডায়েরি লিখেছি—কিন্তু না, গল্প উপন্যাস কবিতা ওসব আমার হাত থেকে কখনও বেরোয়নি। কখনও বের হয়নি অথচ এখন ল্যাপটপে অনর্গল লিখে চলেছি।
দাদু বিনয়কান্তি দত্ত বালিগঞ্জ প্লেসে এই পেল্লায় বাড়িখানা করেছিলেন—লন আউটহাউস ঠাকুর চাকরদের কোয়ার্টার গ্যারেজ মিলিয়ে অনেকটা জমি। আজকের হিসেবে এর বাজারদর আকাশছোঁয়া, কিন্তু আশপাশের আলো-হাওয়া-আকাশ চুরি হয়ে গেলেও বসুন্ধরা ভিলা স্বমহিমায় স্বাভাবিক ঔদ্ধত্য নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। কোনও প্রোমোটার ছুঁতে পারেনি।
তার মানে এই নয় যে এ বংশের কারও কোনও অর্থ লোভ ছিল না—আসলে ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি এ বাড়ির এক অদ্ভুত উইলের জন্যে। সে সব ক্রমশ প্রকাশ পাবে।
বসুন্ধরা ভিলা
সবুজ গালচের ওপর ধবধবে সাদা পোর্টিকো সমেত পুরোনো আমলের সার সার কাঁচের জানলায় ঝলমল করা দুধসাদা চারতলা রাজকীয় বাড়িটা লনের এককোণে বসে দেখতে আমার বড় ভালো লাগে—একেই কি প্রাসাদোপম অট্টালিকা বলে!
ভেতরে আছে একটা লম্বা উঠোন, আছে একটা ছোট্ট সুইমিংপুল, একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট আর একটা বড়সড় সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল যেখানে দুর্গাপুজো হয়। স্কাইস্ক্র্যাপার আর মলের দৌরাত্ম্যে যখন কলকাতা শহরের একের পর এক বনেদি বাড়ি ধূলিসাৎ তখন ১৯/১/ডি বালিগঞ্জ প্লেসের বসুন্ধরা ভিলা তার ব্যতিক্রম। গেটের ওপারেই থমকে যাওয়া পথচলতি অচেনা লোকজন ঘন সবুজ লনের মধ্যে দুধসাদা বাড়িটা দেখতে আজও দাঁড়িয়ে যায়। আশপাশের কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে যেন বনেদি কলকাতার সম্রাটের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বসুন্ধরা ভিলা।
কলকাতার বহুলোক বা মিডিয়ার পুরোনো লোকজন জানেন এটা প্রবাদপ্রতিম ব্যবসায়ী ও প্রাক্তন শেরিফ বিনয়কান্তি দত্ত বা বিকেডি-র বসতবাড়ি। যাঁরা আরও খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন বসুন্ধরা হল প্রয়াত বিনয়কান্তির মায়ের নাম। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর থেকে চলে এসেছিল এক সহায়হীন যুবক। ঠিক নিজের ইচ্ছেয় নয়। ঘটনাক্রমে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। শূন্য থেকে শুরু করে গড়ে তুলেছিলেন আকর্ষণীয় সাম্রাজ্য। তিনি তাঁর দৃঢ়চেতা মায়ের নামে কোম্পানির নাম রেখেছিলেন ‘বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ’ বা বিজিসি।
দাদুর আমলে শুনেছি ঠাকুর চাকর দারোয়ানদের একটা গোটা পল্টন ছিল বাড়িতে। তাদের জন্য ভেতরের চৌহদ্দির একতলায় সার সার ঘর ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর বদল হয়েছে। ওই ঘরগুলো এখন খালি পড়ে থাকে। এখন বাড়ির সব কাজের লোক এজেন্সি থেকে আসে। তারা সারাদিন কাজ করে ফিরে যায়। একটা ছোট্ট গ্রুপ নাইট ডিউটির জন্য থেকে যায়। সিকিউরিটি এজেন্সির লোক পালা করে ডিউটি দেয়। দুটো ঘরে ডরমেটরি মতো করা। যাদের ডিউটি থাকে তাদের ব্যবহারের জন্যে। অন্য খালি ঘরগুলোয় ফার্নিচার বদলানো হয়েছে—পুজোর কটা দিন বিয়ে-থা হলে আত্মীয়স্বজনরা সেখানে থাকে।
আমাদের ছোটবেলাতেও শ্যামদা রতনদা সবিতাদি মিনতিপিসিদের দেখেছি—এরা ঘরের কাজ করতেন কেউ রান্নার কাজ করতেন৷ বাড়ির আপদে-বিপদে আনন্দে বিষাদে সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমাদের পরিবারেরই এক একজন। এখন সব স্টাফ। কুকিং স্টাফ ক্লিনিং স্টাফ সার্ভিস স্টাফ লন্ড্রি স্টাফ। আমার বয়সি লোকজনের এই একটা বড় সুবিধে। আমরা অনেক কিছু দেখেছি। কয়েনের দুটো পিঠ দেখেছি ঠাকুর চাকর ড্রাইভার দারোয়ান ধোপা নাপিত দেখেছি। শেষ বয়সে দাদুকে দেখেছি দুর্গামণ্ডপে বসে চুল ছাঁটাচ্ছেন। নির্মল নাপিত চুল কাটত। এই নির্মল নাপিত আবার এ বাড়িতে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতেন। শুধু আমার দাদুর বিয়েটা উনি দেননি। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এ-বাড়ির বিয়ে শ্রাদ্ধ এসবে বাংলা শার্ট আর মালকোঁচা ধুতিপরা, কুচকুচে কালো পালিশকরা মেহগনি কাঠের আলমারির মতো শক্তপোক্ত চেহারার নির্মল প্রামাণিক চলে আসতেন। এরকম অনেকেই ছিলেন। দুজন ঠাকুরমশাই ছিলেন। গৌরঠাকুর আর বদাঠাকুর। পোশাকি নাম গৌরমোহন চট্টোপাধ্যায় আর বিপদতারণ চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত পুজোআচ্চা বিয়েতে এঁরা থাকতেন। আমাদের কৈশোরের সময় থেকেই ক্যাটারিং চালু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে রান্নার জন্য আলাদা করে দিনরাতের ঠাকুর রাখা থাকত। বাড়িতে যে একটা অনুষ্ঠান আসতে চলেছে সেটা আমরা বুঝতে পারতাম জগন্নাথ আর তার জামাই বলভদ্রকে দেখে। জগন্নাথ ছিল মূল ঠাকুর বলভদ্র তার চেলা। ওরা কলেজ স্ট্রিটে থাকত। জগন্নাথ মারা যাবার পর বলভদ্র একাই আসত।
তবে শুরুর সলতে পাকানোর ইতিহাসটা এরকম ছিল না। জীবনের লড়াইটা এক এক সময় এক এক রকম হয়। শুরুর ঘন অন্ধকার থেকে ছোট্ট মাটির প্রদীপে একটু আলো জ্বালার লড়াই একরকম—দুহাত দিয়ে সেই একবিন্দু আলোকশিখাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই আর সেই একটা থেকে দুটো-চারটে-আটটা এভাবে নতুন নতুন প্রদীপে আলোকবিন্দু পৌঁছে দেবার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখার এগিয়ে দেবার লড়াই আলাদা আলাদা। লড়াইটা শেষ হয় না—লড়াইয়ের ধরনটা বদলে যায়।
বিনয়কান্তির সেই ভয়ংকর লড়াইয়ের ইতিহাসটা আমি জানতে পেরেছি—বাবার একটা আত্মজীবনীমূলক লেখা থেকে। লেখাটা বাবা শেষ করতে পারেননি। লেখার টেবিলে লিখতে লিখতেই একদিন চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন।
বিনয়কান্তি
এক বিদেশি কোম্পানির চায়ের গোডাউনের স্টোর্স ক্লার্ক হয়েছিলেন বিনয়কান্তি। সেখান থেকে বসুন্ধরা টি ট্রেডার্স কোম্পানি ১৯৪৭-এ গড়া চায়ের ব্যবসা। ক্লাইভ রো-তে পিটারসন টি কোম্পানির অফিস ছিল তিনতলায়। রোজ সিঁড়ি ভেঙে অফিসে পৌঁছানোর সময় দেখতেন—একতলা দোতলায় অনেক অফিস। এক একটা টেবিলে একটা অফিস। বারো টেবিলের এক একটা ঘর। একান্নবর্তীর মতো এক টেলিফোনবর্তী পরিবার যেন। বিনয়কান্তি একটা পাকাপোক্ত অফিসে চাকরি করার সুযোগ পেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলতেন না। অন্তত এক টেবিলের অফিসে যাঁরা দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম করছেন তাঁদের থেকে কিছুটা হলেও বিনয় এগিয়ে আছেন। সেখান থেকে অনেক লড়াই জীবনের অনেক ধাপ টপকে পিটারসন সাহেবের হাত ধরেই তার মায়ের নামের কোম্পানি শুরু করলেন বসুন্ধরা টি ট্রেডার্স কোম্পানি। ক্লাইভ রো-তেই একটা ঘর নিয়ে অফিস হল। সেখান থেকে শুরু আর এখন বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ—এই পুরো উত্থান-লড়াই-সংগ্রামের একজন সাক্ষী। কালপুরুষ-এর মতো তিনি বিনয়কান্তির সাম্রাজ্যের ভাঙাগড়ার এক নিঃশব্দ কর্মী। তারক নিয়োগী।
লকডাউনের বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি জীবনে বাবার ওই অসমাপ্ত লেখাটা আমায় খোলা মাঠের অক্সিজেন জুগিয়েছে। সেখানেই বাবা খুব যত্ন করে দাদুর কাছে শোনা ওপার বাংলার এক যুবকের অনমনীয় লড়াইয়ের ইতিহাস লিখে গেছেন। লিখে গেছেন বিনয়কান্তি এবং এই বসুন্ধরা গ্রুপের সর্বক্ষণের সঙ্গী তারকবাবুর কথা। দাদুর কথা মনে করলে যার কথা আসবেই তিনি হলেন এই তারক নিয়োগী এ বাড়ির ও কোম্পানির সকলের ‘বাবু’। —চলবে
ক্লাইভ রো-এর পুরোনো অফিস থেকে লোয়ার রডন স্ট্রিটের ঝকঝকে বাড়িতে উঠে এল বসুন্ধরা গ্রুপের নতুন অফিস। আর সকলকে চমকে দিয়ে বিনয়কান্তি দত্ত কোম্পানির বহু সুখদুঃখের সঙ্গী সবচেয়ে প্রবীণ কর্মী তারক নিয়োগীর হাতে কাঁচি ধরিয়ে উদ্বোধনের লাল ফিতে কাটতে দিলেন।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com