১৯২৯-এর ফোর্ড মডেল ‘এ’ টিউডর গাড়ি (ছবি সংগৃহীত)
গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি
‘পর্দা মা পর্দা। বাড়ি ছেড়ে দিলে সেটা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো। এই জায়গাটার তো এটাই সুবিধে। এই হাতিবাগানের মোড়েই দর্জির দোকান। বাইরের ঘর একেবারে রাস্তার ওপরে। একটু আব্রু থাকলে ভালো লাগে। গুহবাবুদের ফড়েপুকুরের বাড়িতে যেমন আছে — অত দামি নয় সস্তা দেখেই কাপড় কিনে দর্জিকে দেবো — ও বানিয়ে রাখবে — অফিস ফেরতা ওকে নিয়ে এসে একদিন লাগিয়ে নেবো।’
‘লোকটার নামটা কি?
নামে কি আসে যায় মা ? দর্জির কাজ-জানা একটা মানুষ, খেটে খাচ্ছে। নাম হয়ত ছকু মিঞা নয় শিবু গায়েন।’
‘নাম না জেনেই একটা মানুষকে টাকা দিয়ে দিবি।’
‘না তো — কাপড় আমি কিনে দেবো— ওতো কেটে সেলাই করবে — যেদিন পর্দা লাগাবে পুরো পয়সা সেদিনই হাতেহাতে চুকিয়ে দেব।’
দর্জি জানালো অন্যঘরের কাজটা একবারে হয়ে যেতো — কাপড়টা নয় সেই দেবে— বাকী টাকা বিনয় মাসে মাসে বরং শোধ দিয়ে দেবে। টাকা মার যাবার ভয় নেই তার।
বিনয় শান্তভাবে জানালো,
‘আমি অপ্রয়োজনে টাকা ধার করি না ভাই। আর এক্ষুনি এতগুলো টাকা খরচ করার ইচ্ছে বা উপায় কোনওটাই নেই। তোমার সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে সেই মতো এই ঘরে পর্দা লাগাতে কত কাপড় লাগবে সেটা জানাও। আমি তোমায় আমার সাধ্য পছন্দমতো কাপড় কিনে দিয়ে আসব। তুমি পর্দা তৈরি করে বাড়িতে এসে লাগিয়ে দিলেই আমি তোমার পরিশ্রমের টাকা দিয়ে দেবো, আশা করি বুঝতে পেরেছ।’
লোকটা বিনয়কে কতটা কী কাপড় লাগবে বলে তড়িঘড়ি চলে গেল। বিনয় হাতমুখ ধুতে কলঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরে উনুনে চায়ের জল ছাপিয়ে বসুন্ধরা ভাবতে লাগলো — তার ছেলেটা চোখের সামনে ক্রমে বোধে-বুদ্ধিতে নিটোল একখানা মানুষ হয়ে উঠছে।
পর্দা লাগাতে বসার ঘরের চেহারাই পাল্টে গেল। নিজেদের বাড়ি বলে যেন আর চেনা যায় না। বিনয়ের পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। হালকা হলুদ রঙে সাদা সাদা ফুল কাটা সুন্দর পর্দা।
সেদিন মুখ হাত ধুয়ে বিনয় মুড়ির বাটি আর চায়ের কাপ হাতে মাকে নিয়ে বসলো।
‘কি গো কেমন লাগছে?’
‘খুব সুন্দর।’
‘এইবার তবে ডাকা যায়’
‘কাকে? কাকে ডাকবি এবার?’
‘আনন্দমোহন বসু এডভোকেট।’
‘তিনি কে?’
‘কেন কাশীর যাবার সময় দেখা হল যে। যারা হাওড়ায় রেল মিস করছিল। সেই যে ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বরানগরের।
‘তাই বল। এর জন্য এত? তেলিপাড়া লেনের বাড়ি গেল। নতুন বাড়ি নতুন পর্দা এল! আমি তাই ভাবছি ছেলের হল কি?’
‘কিছু হয়নি মা। এসব তোমার সম্মানের জন্যে। একজন বাইরের লোক রেলে আলাপ হয়েছে। ঠিকানা নিয়েছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি দেখা করতে আসতে পারেন আমি ভাবিনি। আমরা যখন কাশীতে ছিলাম তখন অফিসে এসেছিলেন। তারাপদবাবুর কাছে শুনে গেয়েছিলেন কাশীতে আমার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। হপ্তা দু’য়েক আগে আবার এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুর খবরে ওঁরাও মর্মাহত। সস্ত্রীক তোমার সঙ্গে এসে দেখা করতে চান। আমি তো মুখের উপর না বলতে পারি না। কিন্তু তুমি বলো, কোন ভদ্র মানুষকে কি তেলিপাড়া লেনের ওই ভাড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়?
বসুন্ধরা ছেলের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন।
‘আচ্ছা আমি যা ভাবছি তুইও কি ঠিক সে কথাই ভাবছিস বিনু’
‘আমি কিছু ভাবছি না, তবে তুমি যা ভাবছ সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এটা তোমার অলীক ধারণা। ওরা স্বজ্জন পরিবার। রেল কামরায় আচমকা অসুস্থ হয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। আমরা সাহায্য করেছিলাম। নিতান্ত কৃতজ্ঞতা জানাতেই ওঁরা আসতে চান আর কিছু নয়।’
শনিবার শনিবার বিনয়ের ছুটি থাকে। তবে সে নিজেই তারাপদ বাবুকে গোডাউনের কাজে সাহায্য করবে বলে অফিসে যায়। এই শনিবার তারাপদবাবু জানালেন, আসবেন না। বিনয় তার পাওনা ছুটিটা পেল। ভালোই হল। মায়ের সঙ্গে ঘরদোর একটু গুছিয়ে রাখলো। রোববারে বিকেলের দিকে আসবেন এডভোকেট আনন্দমোহন বসু এবং তাঁর স্ত্রী কণিকা। আসবাব বলতে কিছুই ছিল না। কেদারবাবু তার নিজের ব্যবহারের একজোড়া সিঙ্গেল তক্তপোশ — দুটো শোবার ঘরে পেতে রেখেছিলেন। আর বসার ঘরে একটা চেয়ার একটা টেবিল।
বাইরের ঘরে বসার জায়গা সেই অর্থে নেই। বিকেলবেলা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে বেথুন কলেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল বিনয় কান্তি। তাই ভেতরের ঘর থেকে একটা সিঙ্গল তক্তপোশ টেনে হিঁচড়ে বসার ঘরে রেখে এল। বেথুন কলেজ টপকে ডানহাতি গলিতে ঢুকলেই গিরীশ দে-নকুড় নন্দীর বিখ্যাত সন্দেশের দোকান। বাড়িতে এই অতিথিরা একবারই আসছেন তাই আপ্যায়নটা ঠিকমতো হওয়া উচিত।
মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরে বিনয় চমকে ওঠে। বসার ঘরের লেসের ফুল কাটা ঢাকা দেওয়া বেতের সোফা কে নিয়ে এলো? ভাবতে ভাবতেই দুটো লোক একটা সুন্দর কাঠের কাজকরা সেন্টার টেবিল রেখে চলে গেল। তাদের পিছনে পিছনে বসুন্ধরা এসে চারদিকটা দেখে বললেন, ‘কিরে বিনু পছন্দ হয়েছে?’
বিনয় জানতে চাইল এসব কোথা থেকে এলো। বসুন্ধরা হেসে বললেন
‘ওপরওলা!! —এসব আমাদের বাড়িওয়ালার’ —
‘এসব কেন চাইতে গেলে মা? আমরা যেভাবে থাকি, সেটাই সত্যি। তারা এসে তাই দেখতো।’
সন্দেশের বাক্সটা খুলে দেখতে দেখতে বসুন্ধরা বলে,
‘তাই যদি হবে তাহলে তুই ‘দেড়া’ ভাড়া দিয়ে তেলিপাড়া লেনের বাড়ি ছাড়লি কেন? খরচা করে বসার ঘরের পর্দা লাগালি কেন? আর এখন দু-মাইল হেঁটে গিয়ে সেই গিরিশ দে – নকুড় নন্দীর দোকান থেকে কড়াপাকের সন্দেশই বা আনতে গেলি কেন?’
বিনয় চুপ করে লেসের কাজ করা ঢাকাগুলো দেখে।
‘তা মিষ্টি যে এনেছিস সেগুলো তো আর কাঁসার রেকাবে দেওয়া যায় না। আর একটা ভালো পেয়ালা পিরিচও নেই। বাখুণ্ডায় যা ছিল, পরার কাপড়জামা ক’টা তোরঙ্গে নিয়ে বাকি সেসব তো খুড়োমশায়কে দিয়ে তোর হাত ধরে গুহবাড়িতে এসে উঠলুম! ঝাড়া-হাত-পা। তারপর এত বছর এসবের দরকার পড়েনি। ফড়েপুকুর থেকে যখন ভাড়া বাড়িতে উঠে গেলাম তখন কত্তামা জোর করেই কিছু কাঁসার বাসন-কোসন সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। সেগুলোতেই চলতো। কিন্তু মান্যিগন্যি লোকেরা বাড়িতে এলে তো আর… তাই দোতলায় পালগিন্নির কাছে গিয়েছিলাম ভালো দেখে চারটে কাপ ডিশ – মিষ্টি দেবার জায়গা আনতে। তা পালগিন্নি বললে, ‘বসার ঘরে তো একটা চেয়ার টেবিল মাসিমা। লোকজন এলে বসবে কোথায় – আমাদের বারান্দায় একটা বেতের সোফা সেট আছে – ওটা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে কুশন কভার দিয়ে আমি নিচে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ আমি বলেছিলুম বিনু আসুক আর লোকজনতো আসবে কাল রোববার। বিকেলে। সে বললে ‘আজকে পাখায় কার্বন লাগাতে লোক এসচে – ওদের দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছি আপনার ছেলে একা পারবে না।’
সোফা দিয়ে যাওয়া সেই দুজনের একজন আবার ফিরে এলো। তার হাতে একটা রঙিন ফুল কাটা চাদর। চাদরটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘বৌদি পাটিয়ে দিল।’
আনন্দমোহনবাবু সস্ত্রীক তিনটের মধ্যে পৌঁছে গেলেন। ভাগ্যিস বিনয়কান্তি পাজামা পাঞ্জাবি পরে বাড়ির সামনে গ্রে স্ট্রিটের ওপরেই দাঁড়িয়েছিল। কালো রঙের বড়সড় মোটরগাড়ি হাতিবাগানের দিক থেকে ডান দিকে ঘুরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। গাড়ির বিষয়ে তখন বিনয় কিছুই জানত না। অনেক পরে জেনেছে সেটা ছিল ফোর্ড কোম্পানির মডেল ‘এ’ টিউডর গাড়ি।
বিনয় ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। গাড়ি থেকে বিনয়কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। গাড়ি এসে একেবারে বিনয়ের উল্টোদিকে দাঁড়ালো। সামনেই গাড়ির জানলার পাশে ড্রাইভিং সিটে আনন্দমোহন বসু স্বয়ং আর ওপাশে কণিকা দেবী, স্বর্ণময়ীর মা। ওদের গাড়িটা রাস্তার বাঁদিকে। বিনয়দের ভাড়াবাড়ি উলটো ফুটপাথে। বিনয় আঙুল তুলে ইশারায় বাড়িটা দেখিয়ে ওঁদের গাড়িটা ঘুরিয়ে আনতে বলে। সেই মতো গাড়ি একটু এগিয়ে গেল টার্ন করতে।
ওঁদের আসাটা নিছক ট্রেন-আলাপের ভদ্রতার কারণে হলে স্বর্ণময়ীরও আসার কথা। অবশ্য স্বর্ণময়ীর বাবা-মা হয়তো ভেবেছেন — না জানি কেমন পরিবেশে থাকে বিনয়রা। মেয়েকে সে পরিবেশে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা!! আর্থিক অবস্থা দিয়েই সমাজে মানুষের ভালো-মন্দের বিচার হয়তো!
—থাম থাম! এই তো আমাদের বিনয়।
কথাটা কানে যাওয়ার পরই গাড়ির জানলায় এবার কণিকাদেবীর হাসিমুখ নজরে এলো। বিনয়দের বাড়িটা যে রাস্তার ওপরেই হবে সেটা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আশা করেননি। ওদের চোখেমুখে বিনয় যেন খুশিটা পড়তে পারল। তবে ‘আমাদের বিনয়’ কেন? তারা তো কোনওভাবেই এই মোটরগাড়ি চেপে আসা পরিবারের সমকক্ষ নয়। মাঝে মাঝে বেশি মাত্রার ভদ্রতাতেও এতো অস্বস্তি হয় কেন? কেমন যেন দম আটকানো পরিস্থিতি। অহেতুক সম্মান অপ্রয়োজনীয়।
ওঁদের বসার ঘরে বসিয়ে – মাকে ডাকল বিনয়। সকালবেলায় বাজার থেকে রজনীগন্ধার মালা কিনে নিয়ে এসেছিল বিনয়। শ্যামসুন্দরবাবুর ছোট একটা পুরনো ছবি মাঝারি ফটো ফ্রেমে বাঁধিয়ে এ-বাড়িতে রাখা হয়েছিল। সে ছবিটায় বসার ঘরে টেবিলে আজ মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাড়ার মোড়ে মিষ্টির দোকানে গরম সিঙ্গাড়া ভেজে তৈরি রাখার কথা বলা ছিল। মা কাশীতে বাবার সঙ্গে দেখা, অদ্বৈত আশ্রমের হাসপাতালে চিকিৎসা — দশাশ্বমেধ ঘাটে শ্রাদ্ধাদি এসব কথা শেষ করার আগেই বিনয় সিঙ্গাড়া নিয়ে রান্নাঘরের রেখে এল। ওঁরা সঙ্গে করে প্রচুর মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। এনেছিলেন মার জন্য শাড়ি এবং বিনয়ের জন্য ধুতি।
এটাও বিনয়ের অপছন্দ— কিন্তু মুখের ওপর বলা তো যায় না! লৌকিকতা শব্দটার আড়ালে কি লোক দেখানো ব্যাপারটা গা-ঢাকা দিয়ে আছে? ‘ফরমালিটিজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু কথাবার্তায় ‘ফরমালিটিজ’ বোঝাতে ‘লৌকিকতা’ শব্দটাই ফোটোফিনিশে এগিয়ে আছে। তাই ফর্মাল ব্যবহারটাও খানিকটা দেখানদারি। মায়ের কথায় বিনয়ের সম্বিত ফেরে।
বসুন্ধরা বলল, ‘মেয়েকে নিয়ে এলেন না কেন? সে একা একা বাড়িতে বসে রইল?’ — চলবে
ফুলের কানে ভ্রমর আনে স্বপ্ন ভরা সম্ভাষণ। ছবি: সত্রাগ্নি
জীবনের লড়াইটা সব থেকে কঠিন। একদিনে সেটা জেতা যাবে না। এগোতে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেতে হবে – উদ্যম না হারিয়ে বারবার পিছন ফিরে দেখতে হবে। তুমি লড়াই করতে করতে কোথা থেকে আজ এখানে এসে পৌঁছেছো। তবে তো নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসবে। মনে হবে আমি যদি এতটা পৌঁছতে পারি তাহলে সামনের বাধা ভেঙে আরও দূরে যেতে পারবো না কেন?’
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।