শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কোন ঠিকানায় যাও পাখি!

ফিরে আসা

Father expired. Returning after Shraddha by month-end.
—BINOYKANTI
ক্লাইভ রো অফিসের ঠিকানায়— বিনয় কান্তি এই ছোট্ট টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ছিল তারাপদ বাবুর নামে। বিস্তারিত চিঠি দেওয়ার কথা ভেবেও সেটা পাঠায়নি। তাছাড়া যদি ব্যস্ত হয়ে ওরা উত্তর পাঠান, মানি অর্ডার করতে চান সেটা পাঠাবেন কোন ঠিকানায়? বিনয়রা তো এখানেও ছিন্নমূল। একবার রামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রম আবার শুক্লাজির বাড়ি।

ট্রেনে ওঠার পর থেকে মা চুপ করে আছে। ১৫ দিন অশৌচের সময় মাকে সকাল সন্ধ্যে রোজ নিয়ে যেতে হতো মণিকর্ণিকা ঘাটে। বাবাকে যে জায়গাটা দাহ করা হয়েছিল— সেই জায়গার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকত মা। রোজ রোজ সেই জায়গায় নতুন শবদেহ দাহ হতো। বদলে যেত শোকাকূল আত্মীয়-স্বজন। মার কোন দিকে খেয়াল থাকত না। যতক্ষণ সেই অচেনা শবদেহ দাহ হত মা চুপ করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। বিনয় কোনদিন ফিরে যাবার তাড়া দেয়নি। কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি কেন তুমি রোজ আসো— কি খোঁজো এখানে? কাকে খোঁজো? সে শুধু- মণিকর্ণিকা ঘাট থেকে দেখা বহমান স্রোতস্বিনী গঙ্গাকে মনে মনে প্রণাম করে বলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের এই ভয়ঙ্কর শোক তুমি ভুলিয়ে দাও মা গঙ্গা!

সকাল-বিকেল ফেরার পথে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আর অন্নপূর্ণা মন্দিরে মাকে নিয়ে যেতে হতো। ভেতরে না গিয়ে মন্দিরের সামনে থেকেই অন্নপূর্ণা আর বাবা বিশ্বনাথের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে শুক্লাজির বাড়িতে ফিরে যেত ওরা। শুক্লাজিরা জানতেন মা সকাল-বিকেল মন্দির দর্শন করে আসেন।

মাকে ট্রেনে চুপচাপ দেখে বিনয় ভাবে মাকে তো ধীরে ধীরে সুস্থ করতে হবে। তাকে তো কলকাতা ফিরেই এক দু’ দিনের মধ্যে অফিস জয়েন করতে হবে। কোম্পানি থেকে এক মাসের সবেতন ছুটি পেয়েছে বলে পুরো সময়টাই সে আয়েস করবে এমন ছেলে বিনয় নয়। ৩০ দিনের ন’দিন এখনও বাকি। মাত্র কিছুদিন কাজ করেই কোম্পানি তো তাকে অনেক দিয়েছে। বিনয়ের ইচ্ছে এই ন’টা দিন সে কোম্পানিকে ফিরিয়ে দেবে। সে কাজ করবে মন প্রাণ দিয়ে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।

শুক্লাজির স্ত্রী পুরি তরকারি বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মা কি এসব খাবে?

তাড়াহুড়োতে একটা বড় অন্যায় হয়ে গেল। বাচ্চা মহারাজের চিঠিটা গুহবাবুর বাড়ি থেকে আনবার পর মাকে নিয়ে কাশী আসার ব্যাপারে আলাদা করে বলে আসা হয়নি। হ্যাঁ, জাহাজঘাটায় গুহবাবুদের তরফে তাঁর বড় ছেলে আসতেন। পিটারসন কোম্পানি থেকে জাহাজঘাটায় যে ক্লার্ক যেত — যাবার দিনে তার হাতে একটা হাত-চিঠিতে কাশীযাত্রার কথা জানিয়ে গুহবাবুর বড় ছেলেকে দিতে বলেছিল। আসলে ‘যাবে যাবে’ ঠিক ছিল। কিন্তু অফিসের চাপে ঠিক কবে যেতে পারবে সেটা তো বিনয় নিজে জানতও না। কর্তাবাবু বা কর্তা-মার অনুমতি নিয়ে যে বেরোনো হয়নি — সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সে চিঠি পৌঁছেছে কি না জানা নেই।

আচ্ছা একটা কথা, গুহবাবুদের বাড়িতে তাদের তো কোন ক্ষতি হয়নি। বরং চাকরিটা গুহবাবুদের বাড়ি থেকেই হয়েছে। অথচ তেলিপাড়া লেনের বাড়িতে এসেই খবর এল বাবা কাশীতে গুরুতর অসুস্থ। মাকে নিয়ে ছুটে এসেও শেষ রক্ষা হল না। বাবা চলে গেলেন চিরকালের মতো। তারমানে তেলিপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িটা কি বিনয়দের জন্যে অপয়া? আশ্চর্য বিনয়ের তো কখনও আগে এসব মনে হয়নি। আজ হঠাৎ পয়া-অপয়া সে এইসব ভাবছে কেন?

কি এত ভাবছিস? বিনু!

মা’র গলা পেয়ে বিনয় চমকে ওঠে।

কিছু না মা ! এমনিই

কিছু না বললে হবে? আমি যে তোর মা

মা! তুমিও যে সব সময় সাত-পাঁচ কতকিছু ভাবতে থাকো। জিজ্ঞেস করলে বল? কি ভাবছো ?

এবার থেকে বলবো। তোকেই বলবো। তুই ছাড়া যে কেউ আমার রইল না। বল কী ভাবছিলি।

বিনয় ভাবে মা নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। এটাই তো সে চাইছিল। তাই এখন মার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। মা তাড়া দেয়।

কিরে বল?

না ভাবছিলাম গুহবাবুদের ফড়েপুকুরের বাড়িতে আমাদের তো সেরকম কোন সমস্যা হয়নি। হুড়োহুড়ি করে তেলিপাড়া লেনের বাড়িতে না আসলেই হতো!

কেন? তোর কেন মনে হচ্ছে তেলিপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িতে এসেই সব দুর্ঘটনা ঘটলো। সাহেবের কাছে নিজের কাজ নিজের গুণ প্রকাশের সুযোগ তো তেলিপাড়া লেনের বাড়ি থেকেই হল। তোর কোম্পানির থেকে আমাদের কাশী যাতায়াতের খরচ দিল। কোম্পানি মাস-মাইনে সমেত এক মাসের ছুটি দিল— এও তো সব তেলিপাড়ার লেনের ভাড়াবাড়ি থেকেই।

বিনয়ের মনে হল মা ভুল কিছু বলছে না। বসুন্ধরা যেন মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা একরাশ দীর্ঘশ্বাস হালকা করে দিয়ে বলেন—

আর বিনু! এই বোধহয় ভালো হল। এই ১৯টা বছর নিজের একটা হঠকারি সিদ্ধান্তের বশে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দিনের পর দিন আমাদের দেখতে ইচ্ছে হয়েছে আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা হয়েছে কিন্তু ছেড়ে চলে যাওয়ার সে গ্লানি তাকে ছাড়েনি। সেই লোকলজ্জা তাকে ফিরতে দেয়নি। আমাদের মুখোমুখি হতেই তার আত্মসম্মানে ধাক্কা লেগেছে— ফিরে এসে কলকাতা বা বাখুণ্ডায় লোকসমাজের মুখোমুখি তিনি হতে পারতেন না। তার চেয়ে এই তো ভালো হল— আমরা তাকে দেখতে পেলাম তিনি আমাদের দেখতে পেলেন তারপর সসম্মানে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এই ভালো হল।

মা এখন আর কাঁদছে না। মায়ের গলা কাঁপছে না। যন্ত্রণাটা শরীরে-মনে মেনে নিয়েছেন। অগোছালো চুলগুলোকে শাসন করে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে হাতখোঁপা বেঁধে নিলেন। আঁচলে মুখটা মুছে বললেন

একটু জল দে খাই।

রেল গতি কমিয়ে কোন একটা স্টেশনে ঢুকছিল। তারাপদবাবুর প্রেজেন্ট করা ঘড়িটা দেখল বিনয়। রাত ৯টা। যাবার সময় স্টেশনের নাম আর রেল পৌঁছনোর সময় দিয়ে একটা কাগজে তালিকা করা ছিল। ফেরার সময় সে সুযোগ হয়নি। ইচ্ছেও হয়নি। জানালা দিয়ে দেখা গেল দানাপুর জংশন। মা বলে উঠলো

কোন স্টেশন রে ?

দানাপুর জংশন।

এখানে থামবে তো?

হুঁ!

একটু চা খেতুম! তবে তোমায় নামতে হবে না। এই জানলায় যদি আসে তবে খাব না হলে নয়। আমার সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভালো।

মা বেশ দু’ কাপ চা খেল। আজ এতদিন যে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল— সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ঘটেছে। সত্যি কথা বলতে কি সধবার বেশটুকুই ছিল। মানসিক বৈধব্য তো সেদিনই শুরু হয়েছিল। ১৯ বছর আগে বাবার দেশান্তর হবার পরদিন। রাত ভোর হতে।

অশৌচের ওই ১৫ দিন মা যে ক্রমাগত মণিকর্ণিকা ঘাটে যেত — বাবার সাজানো চিতার জায়গাতেই অজস্র অসংখ্য অচেনা অজানা সব দেহকে দাহ হতে দেখতো — সেগুলো মাকে যেন সামনের দিনগুলোর লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছে। মায়ের পরের কথাগুলোতে যেন এক বদলে যাওয়া মানুষকে দেখছে। গুহবাবুদের প্রসঙ্গ মা-ই তুলল।

কাল হাওড়া আমরা কখন পৌঁছবো বিনু?

সকালবেলা। সাড়ে সাতটা নাগাদ।

তোমার আপিস কি কালকেই?

না কাল যাব না। এতদিন ছিলাম না। ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। বাজারহাট করতে হবে। পরশু থেকে যাব।

বেশ! কাল তবে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর গিয়ে একবার ফড়েপুকুরে গুহবাবুদের বাড়ি দেখা করে আসবো। সন্ধ্যে করব না। তোমার আবার পরদিন বেরুনো।

ওঁদের কিছু না জানিয়ে হুট করে আমরা চলে এলুম এটা ঠিক হয়নি মা!

কাশীতে আমরা তীর্থ করতে যাইনি বিনু। কত্তাবাবু কত্তামাকে আমি বহুদিন চিনি। এরকম অবস্থায় দোষ ধরার মানুষ নন ওঁরা। কাল আমি গিয়ে কথা বলব। তোমায় এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি তোমার কাজে উন্নতি করো গে! নিজের কাজ নিজে বড় হওয়া। এর বাইরে আর তুমি মাথা দেবে না।

চুপ করে বিনয় মায়ের কথা শুনছিল

ভবিষ্যতের খারাপগুলো খালি ফলে যাবে আর ভালোটা ফলবে না তাতো হয় না বিনু। যে ভবিষ্যৎ বাণী আমার সধবা জীবন ছারখার করে দিল — তাকে তো এবার আমার ছেলের জন্য ফলতে হবে। নাহলে আমি ভবিষ্যতকেও ছাড়বো না ঈশ্বরকেও ছাড়বো না।

পাটনা জংশন ছাড়াতে শুক্লাজীর বাড়ি থেকে বানিয়ে দেওয়া পুরি তরকারি খেয়ে নিল বিনয় ও বসুন্ধরা। খানিক বাদেই মা শুয়ে পড়ল। ট্রেনের গতিতে দুলতে থাকা ঘুমন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে বিনয় ভাবছিল —পরিবেশ-পরিস্থিতি একজন মানুষকে কীভাবে কতখানি বদলে দিতে পারে।

ট্রেনে বিনয় ঘুমোতে পারে না। কী রকম যেন একটা অস্বস্তি হয়। আসার সময়ও অনেকটা সময় জেগে ছিল। তবে তার একটা কারণ কি ছিল? স্বর্ণময়ী!

গাড়িটা গতি কমিয়ে কি যেন একটা স্টেশনে ঢুকছে। বিনয় জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের নাম দেখার চেষ্টা করছে। গড়াতে গড়াতে রেলগাড়ি যখন থামল বিনয় দেখল একেবারেই কাকতালীয়ভাবে বড় বড় অক্ষরে লেখা স্টেশনের নাম মধুপুর। এখানেই স্টেশন ছেড়ে রওনা-দেওয়া রেলের জানলা দিয়ে দেখেছিল স্বর্ণময়ীকে। প্ল্যাটফর্ম থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। —চলবে

নরম পাপড়ির ঘ্রাণ

ছবি: সত্রাগ্নি
পরের পর্ব আগামী রবিবার

বাচ্চা মহারাজ—স্বামী নিখিলানন্দ। চিকিৎসক মানুষ। সুদর্শন সুপুরুষ। সন্ন্যাসী হলেন কেন? সন্ন্যাসীকে পূর্বাশ্রমের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই। তিনি বলবেন না। কিন্তু এরকম একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ সংসার ছাড়লেন কেন ? মানুষ কি কেবল দুঃখের কারণেই, অপ্রাপ্তির কারণেই সংসার ছেড়ে যায়। নাকি অন্য কোনও কারণ আছে… বাচ্চা মহারাজ তো ইচ্ছে করলেই পায়ের উপর পা তুলে জীবন কাটাতে পারতেন। তাহলে?

* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content