আশেপাশে কত মুখ! কত গল্প! ছবি: সত্রাগ্নি
অচেনা মুখ অজানা কাহিনী
বিকেলের আলো কমে এসেছে — তবে কি সন্ধ্যে হল? সুবর্ণকান্তি হাতের রোম দেখার চেষ্টা করে — নাঃ! স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না! চমকে ওঠে সুবর্ণকান্তি। এটা কোথায় পড়েছে সে? এটা কি রামকৃষ্ণ কথামৃততে আছে। বিনয়কান্তি দত্ত রামকৃষ্ণ কথামৃত পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়েছে। বার বার পড়েছে। বিনয়কান্তির অদেখা যৌবনবয়েস গড়তে গিয়ে সুবর্ণকান্তিকেও যে কথামৃত পড়তে হয়েছে। একবার নয় বারবার। কিন্তু বিকেলের আলো কমে আসার সঙ্গে হাতের রোম দেখতে না পাওয়ার ব্যাপারটা লেখার আগে আর-একবার দেখে নেওয়া দরকার। লাইব্রেরিতে লেখার টেবিলেই ছিল কথামৃত। পরিষ্কার মনে আছে সেখানেই কোথাও পড়েছে। কিন্তু নাঃ। খুঁজে পাচ্ছে না — নানা কিছু নজরে আসছে। তার মধ্যে যেগুলো জরুরি মনে হচ্ছে — নোট বইয়ে পাতার নম্বর দিয়ে এবার সে লিখে রাখছে ভবিষ্যতের জন্যে। কি আশ্চর্য্য যেটা দেখতে চাইছে সেটা দেখতে পাচ্ছে না কিছুতেই। কিন্তু এমন অসাধারণ সব রেফারেন্স পাচ্ছে যা আগে দু-তিনবার পড়া সত্ত্বেও নজর এড়িয়ে গিয়েছে। কথামৃততে হাত রেখে সুবর্ণকান্তি ভাবতে থাকে— এই একটা ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে সে একটাই বই এতবার ওল্টাচ্ছে — যাতে ভুল না হয়ে যায়— চরিত্রটা যেন ঠিক থাকে। তাকে চিনতে, জানতে পাঠকের যেন অসুবিধে না হয়। এই একটা লেখা নিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে তাহলে বাবা, তাঁর লেখা অত অত গল্প উপন্যাসের অতসব চরিত্রের খুঁটিনাটি সামলাতেন কী করে? এমন তো নয়— বাবা চোখ বুজে ঘরের রকিং চেয়ারে বসতেন আর মনের পর্দায় তাঁর সৃষ্ট চরিত্রেরা তাদের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে গো-অ্যাজ-ইউ-লাইকের মতো সেজেগুজে ঘুরে বেড়াতো? আসলে তাঁকে এত বছরের অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে এই পৃথিবী এই সমাজ থেকেই ওই চরিত্রগুলোকে বানাতে হতো—তারপর তাঁর কল্পনা দিয়ে তাদের একটু একটু করে নিখুঁত করতে হতো। তাদের নিজের ভেতরে যাপন করতে হতো। অথচ পরিবারের সকলেই তাঁর এই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভিড় এড়িয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, নিজের মধ্যে অন্তর্লীন থাকার ব্যাপারটা ভালো চোখে নিতেন না — ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন—আমরা ছেলেমেয়েরাও তাই ভাবতাম। শুধু একজন ছাড়া— তিনি সুরঙ্গমা, আমার মা—তিনি গড়ে তোলার ব্যাপারটা জানতেন বুঝতেন। তাই বাবাকে কখনো সাংসারিক বিষয়ে মাথা ঘামাতে দেননি।
লিখতে গেলে এমনই কি হয়? চরিত্রের স্বভাব অভ্যেস মুদ্রাদোষ মনের মধ্যে চেপে বসে লেখকের? একা থাকলেই কি লেখা চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে? লেখকের মধ্যে কি চরিত্রের দ্বৈতসত্তাও কাজ করে? একটা বাইপোলার এন্টিটি! এইসব প্রশ্নের উত্তর যিনি অক্লেশেই দিতে পারতেন তিনি আজ তিনতলার দক্ষিণের ঘরটাতে বড় ছবি হয়ে আছেন। তাঁর রকিং চেয়ারটা মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় একা একাই দোলে।
এখন বাবার কথা সবসময় মনে হয়। কোন সিচুয়েশনে পাজল হয়ে গিয়ে মনে হয় একবার জিজ্ঞেস করে নিই। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন এতটা নির্ভরশীলতা ঠিক বুঝতে পারেনি সুবর্ণকান্তি। যেদিন চলে গেলেন সেদিন থেকে শূন্যতাটা বাড়তে শুরু করলো। তার আগে বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টার্স, আইআইএমএর ছাপলাগা ম্যানেজমেন্ট-এর মাস্টার্স। ক্যারিয়ার, জীবনের সাকসেস এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত সুবর্ণ। বাবা লেখেন। নামকরা সাহিত্যিক। ব্যাস এটুকুই। নতুন বই বেরোলে তার মলাট, চেহারা, ক’পাতার বই, দাম কত? উল্টেপাল্টে এইসব দেখতো। মন দিয়ে পড়েনি। যেমন এখন পড়ছে। নতুন বইয়ের বেশ কয়েক কপি বাড়িতে আসত। তারই একটা নিয়ে ঘরে দু’দিন রেখে দিত। তৃতীয় দিন বাবার লেখার টেবিলে রাখার সময় বলতো ‘দারুণ!’ বাবা কিছু বলতেন না। একবার তাকাতেন। স্মিতভাবে হাসতেন। আবার পড়া বা লেখায় মন দিতেন। সুবর্ণকান্তি তখন ব্যবসায় যোগ দিয়েছে অনেক দায়িত্ব। অনেক জটিল জিনিস বুঝতে পারত। কিন্তু বাবার সেই নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়ার অর্থ বুঝতে পারতো না!
আজ ৬০ বছর পেরিয়ে এসে লেখার চেষ্টা করা ক্রমাগত লেখা নিয়ে ভাবার পর বাবার সেই নিঃশব্দ স্মিত হাসির অর্থ বুঝতে পেরেছে। বাবা সেদিন বুঝতে পারতেন বইটা না পড়েই ফেরত দেওয়ার সময় একটা সাজানো কথা বলে দিয়েছি। যে মানুষটার হাজার হাজার পাঠক— তার লেখা উপন্যাস না পড়েই মন্তব্য করেছি , এটা নিশ্চয়ই লেখক অমলকান্তিকে কষ্ট দিত। মনের কথা বুঝতে পারেন তাই তো লিখতে পারেন। আজ সুবর্ণকান্তির নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছে।
তখন শ্রীতমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একবার এক বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীতে সস্ত্রীক নিমন্ত্রিত ছিল সুবর্ণকান্তি। বাবার লেখা দুটো বই দেবে ঠিক করেছিল—স্ত্রী সেজেগুজে তৈরি। শেষ মুহূর্তে সুবর্ণর মনে হল একটা এক্সক্লুসিভ ব্যাপার করতে হবে। ‘বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে আসি।’ শ্রীতমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবার লেখার ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
বাবা নিঃশব্দে বই দুটোতে স্বাক্ষর করতে করতে বললেন—
—’দুটো ভয় আছে। এক, বই দুটো যদি তোমার পড়া না হয় আর যদি তোমার সেই বন্ধু বা অন্য কেউ এর সম্বন্ধে দু-এক কথা বলতে বলে তাহলে তুমি খুব বেইজ্জত হয়ে যাবে। আর দুই, তোমার বন্ধু যদি মনোগ্রাহী পাঠক না হন তাহলে মাস দুই বাদে পুরনো খবরের কাগজের সঙ্গে ওজন বাড়াতে বই দুটো বেচে দেবেন।’
বই দেয়নি সুবর্ণ। ফুল আর মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীতে। বাবার স্বাক্ষর করা সেই বই দুটো এখনও তার নিজের ঘরের বেডসাইড টেবিলে বাবার ছবির ছোট্ট একটা ফোটো ফ্রেমের পাশে যত্ন করে রাখা আছে।
কফিকাপে চুমুক দিয়ে বেডরুমে ল্যাপটপ নিয়ে বসল সুবর্ণ! স্ত্রী শ্রীতমা এখানে থাকলে এটা হতো না। লেখা লাইব্রেরি ঘরে শেষ করে আসতে হতো। শ্রীতমার মা অসুস্থ ওকে আবার যেতে হয়েছে। শ্রীতমার মায়ের কিডনির সমস্যা আছে। ঋজুও গিয়েছে। বলেছিল, দিদা ঠিক থাকলে বেশি রাতে গিয়ে গাড়ি করে মাকে নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু সুবর্ণ শ্রীতমা দু’জনেই চায়নি। লকডাউনের কড়াকড়ি একটু কমলেও তার মধ্যে গাড়ি নিয়ে রাতে রাস্তায় বেরোনো — যেচে ঝঞ্ঝাট নিয়ে লাভ কী! সময়টা খুব খারাপ। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিতে পারছে না। হাসপাতালে বেড নেই। চেনাজানা অনেকের আচমকা মৃত্যুর খবরে আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে মানুষ। আর শ্রীতমার ব্লাড সুগার যথেষ্ট বেশি। মায়ের কিছু বাড়াবাড়ি হলে— ঋজু তার ডাক্তার বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিতে পারবে। সুতরাং ছেলেও এখন মামারবাড়িতে।
আজ একবারও ফোন করা হয়নি শ্রীতমাকে। মোবাইলটায় দেখলো রাত পৌনে এগারোটা। ফোন করা যায়— তবে সুবর্ণ এখন কফি খেতে খেতে ল্যাপটপে লিখছে — এই সত্য ভাষণ করার মতো বোকা স্বামী সে নয়। সুবর্ণ পসেসিভ বেটারহাফদের সঙ্গে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির খুব মিল পায়। তাই সে মনে করে সব কিছুতে আগ্নেয়গিরিদের নাড়া দিতে নেই! তবে সে এটাও মানে যে অধিকাংশ সুখী স্বামীরা অমেরুদণ্ডী প্রাণী। প্রয়াত কথাকবি শঙ্খ ঘোষের ‘হামাগুড়ি’ কবিতায় মিহিস্বরের মেরুদণ্ড খুঁজতে থাকা, ঘরজুড়ে হামাগুড়ি দিতে থাকা স্বামীরা— যাঁরা ভাবে মেরুদণ্ড খুঁজে পেলেই উঠে দাঁড়াবে। তবে সমাজের পুরুষবাদী-নারীবাদী জ্যাঠা-জেঠিমাদের হাতে মার খাবার ভয়ে এসব কথা কোথাও লিখতে পারেনি সুবর্ণ। চিন্তার স্বাধীনতা দিবস এখনও আসেনি যে।
মঠের নিয়ম অনুযায়ী— থাকাখরচা খুবই সামান্য। হাসপাতালেও এমন কিছু খরচ হয়নি। বাচ্চা মহারাজের সঙ্গে দেখা করে— বিনয় শ্রাদ্ধের দিনক্ষণ জানিয়ে এলো। সময় পেলে মহারাজকে একবার আসতে অনুরোধ করলো। শুক্লাজি দশাশ্বমেধ ঘাটেই বিনয়ের বাবার শ্রাদ্ধের আয়োজন করবেন।
দশাশ্বমেধ ঘাটে একটা দেওয়ালের আড়ালে খানিকটা জায়গা নিয়ে কমলা হলুদ বড় বড় ফুল আঁকা একটা চাঁদোয়া লাগানো হয়েছিল। দেওয়ালের আড়ালে থাকায় গঙ্গার হাওয়ায় চাঁদোয়া দুলছিল কিন্তু জায়গা থেকে সরেনি— শুক্লাজির জানাশোনা অনেক লোকজন ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। বিনয়কান্তি মন দিয়ে শ্রাদ্ধের কার্য্য করছিল। শুক্লাজির পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে মা একটু তফাতে বসে সব দেখছিলেন। মঠ থেকে বাচ্চা মহারাজ নিজে এসেছিলেন মা’র সঙ্গে দেখা করতে। বিনয় পুজোয় ব্যস্ত থাকায় দূর থেকে তাঁর উপস্থিতি জানিয়েছিলেন। দ্বিপ্রহরের শুরু হওয়া শ্রাদ্ধের কাজ মিটতে মিটতে বিকেল হয়ে গেল।
কাশীর বাঙালিটোলা থেকে শুক্লাজি শুনেছিলেন বাঙালি প্রথায় মাছ পান খেয়ে একটা নিয়ম ভঙ্গ বলে রীতি রয়েছে। শুক্লাজিরা ঘোর নিরামিষাশী। তাই কাছেই বাঙালিটোলায় তারই পরিচিত একজনের বাড়িতে পরদিন সে ব্যবস্থা হল।
এই সমস্ত খরচখরচা শুক্লাজি কোনওমতেই নিতে চাননি — কিন্তু তাঁকে নিতে হয়েছিল বসুন্ধরার অনুরোধে। তবে তাঁর বাড়িতে ১৫ দিনের আতিথ্যের কপর্দকও তাঁকে দেওয়া গেল না। বসুন্ধরা কলকাতা ফিরে আসার জন্য ছটফট করছিল। শুক্লাজিই টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন তবে তাদের কাশী যাতায়াতের সব খরচপত্র বিনয়ের অফিস থেকে দেবে এটা জানানোর ফলে বিনয়কান্তি ফেরার ভাড়াটুকু তাকে দিতে পেরেছিল।
শুক্লাজি নিজে তাঁর লোকজন নিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেলেন— ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাবার সময় বিনয়কান্তি কি শুক্লাজির চোখে জল দেখল?
সম্পূর্ণ অচেনা অন্য প্রদেশের একটি মানুষ ও তার পরিবারের এই গভীর স্নেহ-মমতা আতিথেয়তার কথা বিনয়কান্তি জীবনেও ভোলেনি। ভোলেনি বসুন্ধরা। — চলবে
ছবি (সংগৃহীত)
১৫ দিন অশৌচের সময় মাকে সকাল-সন্ধে রোজ নিয়ে যেতে হতো মণিকর্ণিকা ঘাটে। বাবাকে যে জায়গাটা দাহ করা হয়েছিল— সেই জায়গার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকত মা। রোজ রোজ সেই জায়গায় নতুন শবদেহ দাহ হতো…। যতক্ষণ সেই অচেনা শবদেহ দাহ হতো মা চুপ করে তাকিয়ে থাকতো সেই দিকে। বিনয় কোনওদিন ফিরে যাবার তাড়া দেয়নি। কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি কেন তুমি রোজ আসো- কী খোঁজো এখানে? কাকে খোঁজো?
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।