শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জীবন এক নদী

শুক্লাজি

মণিকর্ণিকা ঘাটে বসে বিনয় দেখছে গঙ্গার স্রোত বয়ে চলেছে। সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ফুল বেলপাতা মালা। সেই স্রোতে বয়ে যাচ্ছে সময়। এই মণিকর্ণিকা ঘাটে বসে থাকা কত মানুষের সময়টা আজকের পর বদলে যাবে। যাদের নিকটাত্মীয়ের শরীর সত্তা অস্তিত্ব পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারাও বিনয়ের মতোই ওই পবিত্র গঙ্গার জলে সব যন্ত্রণা ভাসিয়ে দিতে চাইছে। বিনয়ের মা-গঙ্গার কাছে একটাই আকুতি তাঁর মাকে যেন তিনি এই শোক সহ্য করার শক্তি দেন। বিনয়ের স্মৃতিতে বাবার অস্তিত্ব ছিল না—বাবাকে সে এই কাশীতে এসেই চিনল। কিন্তু তবু এখন এত কষ্ট কেন? কেন গলার কাছে একটা অচেনা কান্না দলা পাকিয়ে উঠছে!

তার বাবা শ্যামসুন্দর অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন। কাউকে কখনও দুঃখ দিয়ে কথা বলেননি অপমান করেননি কারওর সঙ্গে শঠতা প্রবঞ্চনা করেননি। জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো ভুলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু আচমকা নৌকাডুবিতে কাকা কৃষ্ণসুন্দরের মৃত্যু তাকে নিজের কাছে অপরাধী করে দিল। তাই তিনি নিজেকে সংসার সুখ থেকে চিরকালের মতো বঞ্চিত করার জন্য দেশান্তরি হলেন। শিশুপুত্রকে জলে ডুবিয়ে মারতে যাওয়া একটা মানসিক বিকার। কৃষ্ণসুন্দর ভাইপো বিনয়কে সেদিন রক্ষা করেছিল। শ্যামসুন্দরের অপরাধ বলতে এটুকুই। কিন্তু তার জন্যে শ্যামসুন্দর উনিশটা বছর স্ত্রী বসুন্ধরা আর একমাত্র সন্তান বিনয়কে ছেড়ে থেকেছে। সেই বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ংকর আত্মগ্লানিতে তিনি প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছেন। বসুন্ধরা এই ১৯ বছর সধবা হয়েও প্রায় বৈধব্য পালন করেছে। আজ থেকে পূর্ণ বৈধব্যে বেঁচে থাকতে হবে বসুন্ধরাকে। সত্যিই কি সব ঠিক করা আছে? মানুষ শুধু ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করছে? জাতিপুরায় সেই বৃদ্ধ বেনারসি কারিগর জানিয়েছিল গুজরাটি তাঁতশিল্পীরা এসে প্রচলিত বেনারসি শাড়ি শুরু করলেন। তাঁরা এলেন কেন? দুর্ভিক্ষের কারণে।

দুর্ভিক্ষ। ভিক্ষার অভাব। অব্যয়ীভাব সমাস। কূলের সমীপে। উপকূল। বিরুদ্ধ কূল। প্রতিকূল। ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়া। বাবার কিছু জানা হল না। বাবাও শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বিনুর জলপানি পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করার কথা— গুহবাবুর কাছে সোনার মেডেল পাওয়ার কোনও কিছুই বাবা জানতে পারলেন না। বিনু যে পিটারসন কোম্পানিতে চাকরি করছে—মাসে ৫০ টাকা মাইনে—সেই কোম্পানি যে বিনুর কাজের মর্যাদা দিয়ে তার আর মায়ের কলকাতা থেকে বেনারস আসা-যাওয়ার সব খরচাপাতি দিয়েছে—এসব কিছু জানার আগেই বাবা!! নদী থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিনয় পাড়ে মণিকর্ণিকা ঘাটের সেই বিখ্যাত শ্মশানভূমির দিকে তাকায় —বাবার চিতাটা এখন একটা অগ্নিকুণ্ড। যে কুণ্ড থেকে আত্মার মোক্ষলাভের পথ সুগম হয়।

স্নান সেরে উত্তরীয় নেবার পর বিনয় শুক্লাজিকে পারলৌকিক খরচ দিতে চাইল। শুক্লাজি একটু থমকে গিয়ে বলেছিল—বাবার পারলৌকিক খরচ তো ছেলেই করবে। সুতরাং সে টাকা তিনি নেবেন। তার কোনও আপত্তি নেই। তবে একটা শর্ত আছে। বোনের স্বামী মারা গেলে ভাইয়েদের কর্তব্য থাকে। সে কর্তব্য স্বীকার করতে হবে। বিনয় বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে যে তার মামামামিরা থাকেন ফরিদপুর কোটালীপাড়ায়। মায়ের বাবা মানে দাদু মারা যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে মামামামিদের আর কোনও যোগাযোগ নেই। শুক্লাজি হাসতে হাসতে বলেন যোগাযোগ তো ছিল না—বোনের সঙ্গে অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু এখন যোগাযোগ যখন হয়েছে তখন তো আর অন্য কোথায় গিয়ে থাকার উপায় নেই। অবাক বিনয়কে আশ্বস্ত করে কল্পেশ শুক্লা জানালেন মঠে বাচ্চা মহারাজের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে—এখন থেকে শ্যামসুন্দরবাবুর শ্রাদ্ধশান্তি পর্যন্ত বিনয় মাকে নিয়ে তার এই মামা শুক্লাজির ব্রহ্মানলচকের বাড়িতেই অতিথি হয়ে থাকবে। মা সেখানেই আছেন। বিনয়কেও সেখানেই যেতে হবে। কোনও আপত্তি চলবে না।

সকালে বাচ্চা মহারাজ বলছিলেন শুক্লাজিকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সাধারণ পূজারি পান্ডা নন। অর্থের জন্য তিনি পূজারির কাজ করেন না। পৈতৃক পেশাকে সম্মান করে ভালোবেসে এই কাজটা করেন। ব্রহ্মানলচকের শুক্লাজির একটা বাড়ি ছাড়াও শুক্লাজির স্ত্রীর নামে ভাড়াটে সমেত দু-দুখানা বাড়ি আছে কাচৌরি গলি এলাকায়। মৃত্যুর সময় শুক্লাজির শ্বশুর তার ছখানা বাড়ি তিন মেয়েদের লিখে দিয়ে যান। শুক্লাজির তিন ছেলে তিন মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। নাতিনাতনি হয়ে গেছে। ছেলেরা কাশীতে রেলওয়ে কন্ট্রাক্টরির ব্যবসা করে—ব্রহ্মানলচকে আসলে দুটো দোতলা বাড়ি। বিনয়কে নিয়ে গেল সেখানে। এবাড়ি-ওবাড়ি বারান্দা দিয়ে জোড়া। সবাই সেখানে থাকে। অনেকগুলো ঘর।

ঘরে ঢুকে বিনয় মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে গেল। সে কাকে দেখছে? ছোটবেলা থেকে মায়ের সিঁদুরের টিপ পরা মুখটা দেখেই সে যে বড় হয়েছে। সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা টানা মেঝেতে দিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা। এটা বিনয়কান্তির মা? বসুন্ধরা?

শুক্লাজির বাড়ির বউমেয়েরা বিনয় ও বসুন্ধরার আতিথেয়তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল—তাদের জন্যে ফলমূল খই দুধের ব্যবস্থা হল—শুক্লাজি বসুন্ধরা বিনয়ের থাকার ঘরের জন্য ব্যবস্থা করতে গেলেন। মা এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি চুপ করে বসেছিল। একলা পেয়ে বিনয় থাকার ব্যাপারে শুক্লাজির সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে মাকে জানাল। বিনয় জানাল যে পারলৌকিক সব খরচ বিনয়ের কাছ থেকে নিতে শুক্লাজি রাজি হয়েছেন—কিন্তু শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ওঁর বাড়িতে থাকাখরচ বাবদ কোনও টাকা উনি নেবেন না।

মা এখনও কোনও কথা বলছে না দেখে—বিনয় বুঝল সে রাতে মা আর কথা বলবে না—বিনয় মাকে জানাল পরদিন সকালে গিয়ে সে রামকৃষ্ণ অদ্বৈত মঠ থেকে তাদের বিছানাপত্র সুটকেস সব নিয়ে আসবে। আর মঠে এ-কদিন তাদের থাকাবাবদ আর হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা বাবদ যা খরচপত্র হয়েছে তা সে মিটিয়ে আসবে।

রেখে যাওয়া ফল মিষ্টি দুধ খই এসবে মা হাত ছোঁয়ায়নি—সেই দেখে শুক্লাজির স্ত্রী বললেন, ‘আপনারা অতিথি আপনারা কিছু মুখে না দিলে তো আমরা গৃহস্থ হিসেবে কিছু খেতে পারব না।’

মা তখন অল্প কিছু খাবার খেলেন— ইশারায় বাকি খাবার সরিয়ে নিতে বললেন। বিনয়ের খাবার ইচ্ছে ছিল না—খিদের ইচ্ছেটা চলে গেছে। সবকিছুই বড় রিক্ত নিঃস্ব লাগছে।

তাদের জন্য খাটের ওপর কম্বল পেতে শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শোবার আগে বিনয় তার গায়ের উড়নির ফাঁস খুলে বাবার চশমাটা বের করল। চিতায় দেবার আগে সে বাবার চোখ থেকে খুলে নিয়েছে। অনেকে বলেছিল মৃতের ব্যবহার্য জিনিস গঙ্গায় ফেলে দিতে হয়—যেমন বাবার ধুতি পাঞ্জাবি ব্যবহার্য যা ছিল এমনকী বিনয়ের সাধের টুইডের বাংলা শার্টখানাও পরনের ধুতির সঙ্গে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু বাকি সব কিছু জলে ফেললেও শ্যামসুন্দরের চশমা ফেলেনি।

এতক্ষণ চুপ করে থাকা বসুন্ধরা শ্যামসুন্দরের চশমাটা হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। বিনয় চমকে ভাবল অন্যের বাড়ি। তারা শুনলে… বসুন্ধরা বিনয়ের মনের দোটানা বোধ হয় বুঝতে পেরেই আপন চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করতে লাগল। চশমায় হাত বোলাতে বোলাতে তাঁর দুগাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল৷ নিঃশব্দ কান্না। মাকে নিজের আঁচলের খুঁটের গিঁট খুলে বাবার সেই রুপোর তাবিজটা বের করতে দেখে বিনয় অবাক হল—বাচ্চা মহারাজের থেকে নেওয়ার পর এটা তো মায়ের কমলা ডুরে শাড়ি আঁচলে বাঁধা ছিল। কোনও এক সংস্কার থেকে মা সকাল-বিকেল বাবাকে এই শাড়িটা পরেই দেখতে যেত। কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে সেই শাড়িটাই পরে গিয়েছিল। বাবার থানেও সেই খুঁটে বাঁধা তাবিজ ছুঁইয়ে ছিল। হাসপাতালে রোজ সকাল-বিকেল বাবার মাথায় সেই আঁচলের খুঁটে বাঁধা তাবিজ ছোঁয়াত।

তার মানে মা’র সে শাড়িখানা ফেলে দিয়ে এই বিধবার থান পরানো হয়েছে—কিন্তু বাবার তাবিজটা মা-ও ফেলেনি।

সুবর্ণকান্তি এখন লিখছে না—খালি পায়ে সবুজ গালচের মতো নরম ঘাসের লনে হাঁটতে-হাঁটতে লেখার কথা ভাবছে। সুবর্ণকান্তি ভাবছে মানুষের সংস্কারের কথা। আত্মবিশ্বাস হারালে মানুষ সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে? নাকি চরম আত্মবিশ্বাসী মানুষ তাঁর আত্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে রাখার জন্যে সংস্কার মেনে চলেন?

বিশ্ববন্দিত ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকার ডান পায়ের আগে বাঁ পায়ের প্যাড বাঁধেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে বিরাট কোহলি একটাই হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করতেন ম্যাচের পর ম্যাচ। মাহিন্দর অমরনাথ ফিল্ডিঙের সময় লাল রুমাল ব্যবহার করতেন। শাহরুখ খান ৫৫৫ নম্বরটা ফেভারিট মনে করেন। এরকম অজস্র অসংখ্য উদাহরণ আছে। এরা কেউই ভিতু নন। বরং বলা যায় বিশেষভাবে সাহসী ও ক্ষমতাবান। অনেকের মতো সুবর্ণকান্তিরও মনে হয় একজন সাধারণ অপরিচিত মানুষ যে কাজ করলে সমালোচিত হন—সেই কাজটাই অর্থ ও ক্ষমতার বলে বলীয়ান মানুষেরা শুধু অক্লেশে করতে পারেন এমন নয়; তারা প্রশংসিতও হন—এবং প্রচারের আলোয় আরও আলোকিত হোন। একেবারে জনতার দঙ্গলে মিশে থাকা অপরিচিত সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন বিনয়কান্তি দত্ত এবং তার পরিবার। বিনয়কান্তির তৃতীয় প্রজন্ম সাহিত্যিক অমলকান্তির ছেলে সুবর্ণকান্তি লিখছে সেই উপাখ্যান।—চলবে

প্রকৃতিকেও বড়ো রিক্ত নিঃস্ব লাগছে

ছবি: সত্রাগ্নি
পরের পর্ব আগামী রবিবার

লিখতে গেলে এমনই কি হয়? চরিত্রের স্বভাব অভ্যেস মুদ্রাদোষ মনের মধ্যে চেপে বসে লেখকের? একা থাকলেই কি লেখা চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে? লেখকের মধ্যে কি চরিত্রের দ্বৈত সত্তাও কাজ করে? একটা বাইপোলার এন্টিটি!! এইসব প্রশ্নের উত্তর যিনি অক্লেশেই দিতে পারতেন তিনি আজ তিনতলার দক্ষিণের ঘরটাতে বড় ছবি হয়ে আছেন। তাঁর রকিং চেয়ারটা মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় একা একাই দোলে।

* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content