শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


খণ্ডন-ভব-বন্ধন, জগবন্দন, বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়।।

সান্ধ্যসংগীত

এ পর্যন্ত বিনয় জীবনে দুটো মৃত্যু দেখেছে। নলচিতিতে পিসিমাকে দেখেছিল। ফর্সা মুখটা নীল হয়ে আছে, চোখ দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শরীরের পাশের দুটো হাত শক্ত করে মুঠো করা—আর পা দুটো কোমর থেকে যেন এলিয়ে পড়ে রয়েছে। সে এক ভয়ংকর চেহারা। আর দাদু মানে বিনয়কান্তির মায়ের বাবার মৃত্যুর সময় তো একটা কাণ্ডই হয়েছিল।

কোটালীপাড়ায় দাদু মুকুন্দ সেনগুপ্ত বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। শয্যাশায়ী ছিলেন অনেকদিন। শেষদিকে খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার কবিরাজ সকলেই জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। কথা বলতেন যখন জড়িয়ে ক্ষীণস্বরে। কিছুই প্রায় বোঝা যেত না। একদিন ভোরবেলায় ঘুম ভাঙিয়ে মা দাদুর ঘরে নিয়ে গেলেন। বিনয় গিয়ে দেখল মামামামিরা সব গোল হয়ে বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা’র সঙ্গে দাদুর পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বিনয়। দাদুর তখন কোনও সাড় নেই—আধবোজা চোখ। শুধু ঠোঁটদুটো নড়ছে। বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। রোগে ভুগে দাদুর সুন্দর চেহারা কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। আগে দাদুর গলাটা নিটোল গোল ছিল—ইদানীং শরীর ভেঙে গিয়ে কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গলার উঁচু ধুকধুকিখানা দেখা যেত। দাদুকে যে কবিরাজ দেখতে আসতেন—তিনি নাড়ি ধরে বসেছিলেন। এক সময় মাথা নাড়িয়ে মামাদের দিকে তাকিয়ে হাতে কী একটা ইশারা করলেন। মামামামিরা একটা পেতলের ঘটিতে জল নিয়ে ভাগাভাগি করে—দাদুর নড়তে থাকা মুখের মধ্যে ঢেলে দিল। তারপর মামাতো ভাইবোনেরা জল দিল। সবশেষে মা’র দিকে ঘটিটা এগিয়ে দিল বড়মামি। মা কাঁদতে কাঁদতে বিনয়ের হাতটা ধরে দাদুর মুখে জল দিল—সে জলটা ঠোঁটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল। কবিরাজমশাই দুই দিকে দুই হাত সরিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। মামিরা যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিলেন—সকলে সুর করে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। মা একহাতে খাটের ছত্রিটা ধরে চোখ বুজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল—মায়ের অন্য হাত বিনয়ের কাঁধের ওপর যেন চেপে বসেছিল। বড়মামা মেজমামা—আলতার শিশি এনে তড়িঘড়ি দাদুর পায়ের চেটোতে মাখিয়ে কাগজে ছাপ নিয়ে নিল। ছোটকা যখন নৌকাডুবিতে মারা যান—তার পায়ের ছাপ কি নেওয়া হয়েছিল? বিনয় জানে না। তখন যে সে মাত্র ছ’মাসের শিশু।

সন্ধ্যারতি দেখতে দেখতে আজ কেন এসব কথা মনে পড়ছে?
উপস্থিত ভক্ত মহারাজ সকলে সমবেতভাবে আকুল হয়ে গাইছেন—

“খণ্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দ, বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়।।”

এই সান্ধ্যসংগীতে কোনও এক ভক্ত বা মহারাজ হারমোনিয়ামের একটা সুর ধরে থাকেন—তালে তালে গুম গুম করে মৃদঙ্গ বাজে। আর ঝমঝম করে ঝাঁঝের মতো একটা জিনিস বাজে—সেটা খঞ্জনির থেকে অনেক বড়। খঞ্জনিকে বড় থালার মতো করে দিলে যেমন হয়। পরে জেনেছে পূজাতে যে এই ধরনের বাদ্য ব্যবহার হয়, এর নাম তাল। এই সান্ধ্যসংগীত যখন চলে তখন যেন মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। বিনয় দেখল সামনের সারিতে বসে গলা মেলাচ্ছেন বাচ্চা মহারাজ। হাসপাতালে নানান রোগীর নানান সমস্যা থাকে তাই রোজ সন্ধ্যারতিতে মহারাজকে দেখা যায় না। আজ যদি সুযোগ পায় মহারাজকে বাবার শরীরের কথা কাশীতে থাকার বাড়ি নেবার কথা জিজ্ঞেস করবে। পরশু দিনই তবে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

আরতির শেষে বাচ্চা মহারাজ নিজেই এগিয়ে এলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য সারনাথ ভ্রমণ বা জাতিপুরায় বেনারসি তৈরি দেখার ব্যাপারে কোনও কথাই বললেন না।

—আরতি দেখলে বিনয়? সন্ধ্যাসংগীত শুনলে?

বিনয় মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

—এ’ কদিন আমরা রোজই আসি তবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি।

—না. আমি তো হাসপাতালে ব্যস্ত থাকি—তাই সময় করে উঠতে পারি না—আর আমিও হাসপাতালে রোগীদের সেবা মানে ঈশ্বরের সেবাই করি।

—এই যে গানটা এখানে শুনি এই গানটাই কি সব রামকৃষ্ণ মঠে হয়?

বাচ্চা মহারাজ আবার শিশুর মতো হাসেন।

—হয় বইকি। রোজ একই সময়ে হয়। সর্বত্র। গানটা কার লেখা জানো?

—কোন এক মহারাজের!

—কোন এক মহারাজ নন, স্বয়ং স্বামীজি মহারাজের। স্বামী বিবেকানন্দ।

বসুন্ধরা চুপ করে দাঁড়িয়ে বিনয় ও বাচ্চা মহারাজের আলোচনা শুনছিলেন—হঠাৎ বলে ওঠেন—

—এই গান স্বামী বিবেকানন্দের লেখা?

বাচ্চা মহারাজ বললেন—

—হ্যাঁ মা। গানের কথা সুর সমস্ত স্বামীজির। মিশ্রকল্যাণ রাগ, তালফেরতা মানে চৌতাল, তিনতাল একতাল। বিনয় এসব বোঝো? গান জানো নাকি?

মাথা নিচু করে বিনয় মাথা নাড়ায়৷

—আজ্ঞে না—গান জানি না। বুঝিও না। তবে গান শুনতে ভালো লাগে—

দুই হাত তুলে হইহই করে বাচ্চা মহারাজ বলে ওঠেন—

—তাহলেই হবে—সুর আর স্বর মিলেই তো ঈশ্বর! ফুল শিশু সংগীত সেবা—এ সবেতেই ঈশ্বরের অনুভূতি। আর জানো বিনয়, এই রামকৃষ্ণ অদ্বৈতাশ্রম-এর সঙ্গে স্বামীজির আত্মিক যোগাযোগ ছিল।

বিনয় ভাবে বাচ্চা মহারাজ বাবার শরীরের সম্বন্ধে কোনও কথা বলছেন না—কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। দুদিন বাদে কাশীতে বাড়ি খুঁজতে হলে তো… বিনয়কে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে বসল মা।

—আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ওঁকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। বিনুর বাবা কেমন আছেন মহারাজ? কেমন বুঝছেন—

বিনয় দেখল মহারাজ চুপ করে মা’র দিকে তাকিয়ে আছেন—কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মহারাজ বললেন—

—মা, আমি বিনয়কে সমস্ত বিষয়ে জানিয়ে রাখি। সুস্থ আর অসুস্থ মানুষের এই যে একটা বড় তফাত মা। শরীরের ভিতরের কলকবজা যতক্ষণ ভালোভাবে চলছে ততক্ষণ তার কোনও শারীরিক সমস্যা নেই—একমাত্র দুর্ভাগ্য আর নিয়তি তাকে থামিয়ে দিতে পারে। কিন্তু অসুস্থ মানুষ যে বড় অসহায়। তার সুস্থতা যে সাময়িক। সে সুস্থতা স্থিতিশীল নয়। ওষুধপত্র ডাক্তারবদ্যি তার অসুস্থতাকে কমাতে চেষ্টা করে। সুস্থতাকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। আমরাও চেষ্টা করছি মা—কিন্তু আজ দুপুরে হঠাৎ ওঁর হার্টের প্যালপিটিশন বেড়ে গিয়েছিল—শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাই আমরা তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ছিলাম। আমি মঠের একজন সন্ন্যাসী এবং ডাক্তার। আমি অকারণ ভয়ও দেখাব না মিথ্যে আশ্বাসও দেব না। আমরা আমাদের করণীয় সবটুকু করব—আমাদের তরফে থাকবে নিরন্তর চেষ্টা—সে চেষ্টার ফলটা ঈশ্বরের হাতে। আপনারা ঈশ্বরকে ডাকুন আমরাও ডাকছি। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সুস্থতার জন্য বিখ্যাত সব ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। সারাটা জীবন যিনি মানুষের দুঃখে-কষ্টে বিপদে-আপদে তাঁর বরাভয় নিয়ে সকলকে রক্ষা করে গেছেন—তিনিও মানবলীলায় ডাক্তারদের হাত জড়িয়ে ধরে বলতেন ভালো করে দিতে। আবার নিজেই যেহেতু অবতার তাই উপলব্ধি করতেন তা হবার নয়—ঠাকুর সারদামাকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে। শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।… কারও কাছে একটি পয়সার জন্য চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাতকাপড়ের অভাব হবে না।’’ স্বয়ং ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব মানব জীবনের এই যন্ত্রণা এই উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে গেছেন মা—নিজেকে পূর্ণভাবে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করুন। আপনার দীক্ষা হয়ে থাকলে আপনার গুরুর পায়ে—না হলে যে দেব বা দেবীকে আপনি পুজো করেন। মাদুর্গা কালী ভোলা মহেশ্বর তাঁর সিদ্ধান্তের উপরে পুরোপুরি নির্ভর করুন।

একটানা কথাগুলো বলে গেলেন বাচ্চা মহারাজ। এরপর বিনয়ের দিকে তাকিয়ে মহারাজ বললেন—

—আপনার ছেলের মনে অনেক প্রশ্ন। একটামাত্র প্রশ্নের উত্তর এখন আমি দেব৷ বাকি প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় এখনও আসেনি। কাশীতে থাকার বিষয়ে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছ কেন? ভক্ত সমাগম সেরকম হলে তখন ব্যবস্থা করা যাবে। এখন বাড়ি নিয়ে এত উতলা হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সেরকম প্রয়োজন হলে আমি নিজে সে ব্যবস্থা করে দেব।

অনেক রাত হয়ে গেছে। তবু ঘুম আসছে না। কলকাতায় পিটারসন কোম্পানির স্টোর্স-এর কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা হয়। বিনয়ের জায়গায় নিশ্চয়ই তারাপদবাবুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিনয় ভাবতে থাকে নদীর মতোই জীবন চলে অজানা পথে। রোজই তো গুহবাড়ির বড়ছেলের সঙ্গে জাহাজঘাটায় যেত। সাহেবসুবোর সঙ্গে প্রয়োজন হলে কথাও বলত। কিন্তু তার মধ্যেই যে উইলিয়ম পিটারসন ছিলেন। সেই সূত্র ধরেই তো তারাপদবাবুর মতো একজন নির্ভেজাল ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। বিনয় তো অফিস-কাছারির কাজ কিছুই জানত না। গুহবাড়ির ব্যবসার কাজে তো সে কেবল হিসেবের খাতা লিখত। তারাপদবাবু একটু একটু করে চা-গুদামের কাজ শেখালেন। তারপর কাশী আসার আগে গোডাউনের দুই দারোয়ান, মুটেদের সর্দার আর মুটেরা তারা সকলে মিলে সাহায্য না করলে যে… তারপর বাচ্চা মহারাজ… কি কল্পেশ শুক্লা—এদের কাউকেই তো বিনয় চিনত না, জানত না। কে তাঁদের বিনয়ের চলার পথে একে একে এনে দিলেন? আমরা যেমন জানি না পরক্ষণে কী ঘটবে—তেমনই জানি না পরক্ষণে কে আছে অপেক্ষায়?

তারাপদবাবুর দেওয়া ঘড়িটায় রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।

মা শোয়নি। ঘর অন্ধকার—মা বিছানায় বসে পাশের খোলা জানলা দিয়ে—অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিনয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ নজর গেল অফিসের দিক থেকে মন্দির টপকে অতিথিশালায় আসার রাস্তায় কে যেন একটা দ্রুতপদে এগিয়ে আসছে। বিনয় দেখছে ছেলেটি মুখ তূলে তাঁকে বারান্দায় দেখতে দেখতে গেট দিয়ে ঢুকে এল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ছেলেটি কি তাদের কাছেই আসছে?

অন্ধকার রাস্তায় মাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের দিকে প্রায় ছুটে চলেছে বিনয়। আগে আগে চলেছে মঠের অফিসঘরের সেই ছেলেটি। হঠাৎ বাবার শরীরের অবনতি হয়েছে—বাচ্চা মহারাজ মাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বাবা কি তবে? কোন বিপদ ওত পেতে আছে?

কোন বিপদ ওত পেতে আছে? ছবি: সত্রাগ্নি

পরের পর্ব আগামী রবিবার

বাচ্চা মহারাজের কথাই কি ঠিক? আমরা সকলেই কি ঈশ্বর নির্ধারিত ভবিতব্যের দিকে এগিয়ে যাই? না হলে হিন্দুধর্মে কথিত সবচেয়ে পবিত্র শ্মশানভূমে তার বাবা শ্যামসুন্দর দত্তের দাহব্যবস্থা সে করল কী করে? বেনারসে তার না আছে কোনও আত্মীয়-স্বজন না পরিচিতি।

* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content