মনখারাপের মেঘ
বিশ্বনাথধাম
—হ্যাঁ। তোমার মা আজ ১৯ বছর পর তাঁর স্বামীকে পেয়েছেন। তাই ওঁর সামনে চিকিৎসার খুঁটিনাটি আলোচনা করতে আমি চাইনি। শ্যামসুন্দরবাবুর খুব কঠিন ধরনের ব্রংকিয়াল নিউমোনিয়া হয়েছে। তাই চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, গুরুতর অসুস্থ। এখন কতদিন ওঁকে চিকিৎসাধীন থাকতে হবে আমরা কতটা সুস্থ করে তুলতে পারব সেটা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমি একটা হপ্তা আমাদের অতিথিশালায় তোমার আর তোমার মায়ের থাকার ব্যবস্থা করেছি। বাবার চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হবে না—যত দিন যা চিকিৎসা লাগবে সে ব্যবস্থা মঠের পক্ষ থেকে করা হবে। তবে তোমাদের যদি বেশি দিন বেনারসে থাকার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে তোমাদের মানে তোমাকে আর তোমার মাকে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে। মঠে তো অনেক ভক্তরা আসেন তাই বেশিদিন থাকার সুবিধা আমরা করতে পারি না।
বিনয় জানাল, তার কোনও আপত্তি নেই। শুধু মহারাজ তার বাবাকে সুস্থ করে দিন।
—কাশীতে এসেছ। বাবা বিশ্বনাথের ধাম। যাও ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে আজ সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে বিশ্বনাথের মন্দির—অন্নপূর্ণা মন্দির মণিকর্ণিকা ঘাট দশাশ্বমেধ ঘাট দর্শন করে এসো।
—আজই !!
—হ্যাঁ—কবীরের দোঁহা আছে না। কাল করে সো আজ কর/ আজ করে সো অব। পল মে পরলয় হোএহী/ বহুরি করেগা কব।
লাকসা রোড ধরে হেঁটে গেলে বিশ্বনাথ মন্দির এক কিলোমিটার রাস্তা—বিনয় একা থাকলে হেঁটেই যেত। অন্য সময় হলে মাকেও হেঁটেই নিয়ে যেত। মা-র কোনও শারীরিক অসুবিধা নেই। যেটা আছে সেটা হল দুশ্চিন্তা, মানসিক কষ্ট। কিন্তু আজ বাবাকে দেখার পর মা-র পক্ষে হেঁটে বিশ্বনাথ মন্দির যাওয়া সম্ভব হবে না বলেই বিনয় টাঙা নিল। মা চুপ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিলেন। বিনয়ও ভাবছিল। ভাবছিল বাচ্চা মহারাজের কথাগুলো।
—বাবার ঠিক কী হয়েছে আমাকে যদি একটু বুঝিয়ে বলেন৷
—তুমি ফুসফুস কেমন দেখতে হয় জানো তো?
বিনয় সম্মতি দেয়।
—তাহলে তো জানো যে আমাদের এই শ্বাসনালি গলা দিয়ে নেমে এসে বুকের কাছাকাছি দুদিকে দুটো ফুসফুসের দিকে চলে যায়৷
নিজের বুকে হাত দিয়ে শ্বাসনালির বর্ণনা দিতে থাকেন বাচ্চা মহারাজ।
গলার নীচের থেকে নেমে এল ট্রাকিয়া, সেখান থেকে প্রথম দুটো ভাগ হল প্রাইমারি ব্রঙ্কি। সেখান থেকে গাছের শেকড়ের মতো আবার যে ভাগগুলো তাকে আমরা বলি সেকেন্ডারি ব্রঙ্কি। গাছের শেকড় যেভাবে শিরা-উপশিরা তার থেকে আরও উপশিরায় ভাগ হয়ে যায় ঠিক তেমনিভাবে শ্বাসনালিও ভাগ হতে থাকে— সেকেন্ডারির পর টার্শিয়ারি ব্রঙ্কি—তারপর ব্রংকিওলস। একেবারে শেষে ফুলের মতো অংশে গিয়ে শেষ। যাকে অ্যালভিওলাই বলে।
—ও বিনু! আমরা মন্দির পৌঁছে গেছি রে।
মা-র ডাকে সংবিৎ ফিরল বিনয়ের।
বাচ্চা মহারাজ একজন মহন্তের নাম বলে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে পৌঁছতেই তিনি একজন বয়স্ক লোককে সঙ্গে দিয়ে দিলেন—নাম কল্পেশ শুক্লা—৬০/৬৫ বছর বয়স। তাঁর সঙ্গে ভিড় এড়িয়ে সরাসরি বিশ্বনাথ দর্শন হল—পুজো দেওয়া হল— বয়স্ক এই লোকটি গড় গড় করে পুরাণে কাশীর উল্লেখ থেকে, বারাণসীর অতীত ইতিহাস বলতে পারেন। মা শুক্লাজিকে ‘বাবা’ সম্বোধন করে স্পষ্ট বাংলায় কথা বলছিলেন। অদ্ভুত কাণ্ড আমার সঙ্গে শুদ্ধ হিন্দিতে কথা বললেও—মা-র কথার সব উত্তর শুক্লাজি ভাঙা ভাঙা বাংলাতেই দিচ্ছিলেন।
এদিকে আমার কানে বাজছে বাচ্চা মহারাজের বলা কথাগুলো…
এমন অনেক অনেক অ্যালভিওলাইয়ের ছোট ছোট থলি দিয়েই আমাদের ফুসফুস তৈরি। ইনফেকশন হলে অ্যালভিওলাইয়ের থলিগুলোর মধ্যে ফ্লুইড জমে সেগুলো ফুলে ওঠে—বুকে ব্যথা হয় ভার লাগে দম নিতে কষ্ট হয়।
বাবাজি ইয়ে দেখো ‘গিয়ান বিয়াপী মসজিদ’…
দেখলাম চলতে চলতে নিজের অজান্তেই এসে পৌঁছেছি মন্দির চত্বরে, মন্দিরের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানব্যাপী মসজিদের সামনে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে সেই ধ্বংসাবশেষ দিয়েই নাকি এই মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল। মন্দির ও মসজিদের মধ্যে আছে জ্ঞানব্যাপী কুঁয়া। কথিত আছে, ঔরঙ্গজেব যখন মন্দির আক্রমণ করেন তখন শিবলিঙ্গটি নাকি এই কুঁয়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শুক্লাজির কথাতেই জানা গেল—কাশী বিশ্বেশ্বর এই মন্দির সেই ১১৯৪ সাল থেকে বারবার ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। মোহাম্মদ ঘোরী কুতুবুদ্দিন আইবক ফিরোজ শাহ তুঘলক এবং ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করেছেন আর একজনের পর একজন এই মন্দিরকে আবার গড়েছেন। ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করার পর ১৭৮০ সালে মারাঠা মালওয়া রাজ্যের মহারানি অহল্যাবাই হোলকার, এই মন্দির আবার গড়ে দেন। যুদ্ধে স্বামী পরে শ্বশুরমশাই এবং ছেলের মৃত্যুর পর তাঁকে রাজ্যের শাসনভার নিতে হয়েছিল। শুক্লাজির কাছে দুটো আশ্চর্য বিষয় শুনলাম। ১৭২৫ সালে অহল্যাবাইয়ের জন্ম আহমদনগরের এক গ্রামে। অহল্যাবাইয়ের বাবা মেয়েকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। তার মানে এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগেও স্ত্রীশিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হত। দ্বিতীয়টা তো আরও আশ্চর্যের। ১৭৫৪ সালে অহল্যাবাইয়ের স্বামী খান্দের রাও হোলকার কামানের গোলার আঘাতে মারা যান। কিন্তু অহল্যাবাইয়ের শ্বশুরমশাই মল্লার রাও হোলকার ২৯ বছরের পুত্রবধূকে সতী হতে দেননি। সত্যি আশ্চর্য হতে হয়।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উঁচু চূড়ার পুরোটাই সোনা দিয়ে মোড়া। ১৮৩৫ সালে পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং মন্দিরের ১৫.৫ মিটার মানে প্রায় ৫১ ফুট উঁচু চূড়াটি ১০০০ কেজি সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।
অন্নপূর্ণা মন্দির বিশ্বনাথ মন্দির দেখার পর—বিশালাক্ষী মন্দির মণিকর্ণিকার ঘাট ঘুরে আমরা যাচ্ছি দশাশ্বমেধ ঘাট। নৌকোতে। শুক্লাজির পরিচিত মাঝি নিখরচায় আমাদের নৌকোবিহার করাল। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস এই মণিকর্ণিকা ঘাটে সৎকার করা হলে পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পেয়ে আত্মা মোক্ষ লাভ করে। এটি একটি শক্তিপীঠ। এখানে সতীর কর্ণ-কুন্তল বা মণিকর্ণ পড়েছিল।
মণিকর্ণিকা ঘাটের পাশেই বিশাল শ্মশানভূমি। সার সার মৃতদেহ জ্বলছে।
দেখলাম মা মুখটা গঙ্গার দিকে ফিরিয়ে রেখেছেন—বাতাসে ছাই উড়ে আসছে গঙ্গায়। তাই কি কাশীতে মহাপ্রয়াণ এত পুণ্যের!! পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এতদিনের সযত্নলালিত দেহ। একটু আঘাত একটু চোটে অস্থির হয় মানুষ। একটু বঞ্চনা গঞ্জনায় সামান্য অপমানে মন ভেঙে যায়—সেই দেহ সেই মন, সেই গর্বের কান্তি, সেই প্রখর বুদ্ধির মস্তিষ্ক সেই তীক্ষ্ণ জ্ঞান—সব টুকরো টুকরো খানখান হয়ে যাচ্ছে। গোটা মানুষটাকে গিলে খাচ্ছে—লেলিহান আগুন নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে তার সব পার্থিব অস্তিত্ব—ধোঁয়ায় ছাইয়ে ধুলো হয়ে যাচ্ছে একটা জীবন।
সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে আবার মনে পড়ে যাচ্ছে বাচ্চা মহারাজের শেষ কথাগুলো…
দেখো বিনয়—তুমি বড় হয়েছ। মা-বাবার সব দায়িত্ব এখন তোমার। তোমার বাবা দীর্ঘদিনের অনিয়মে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নানারকম অসুস্থতা বা বয়সজনিত কারণেও যখন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে তখন সহজেই ফুসফুসে এ ধরনের ইনফেকশন হয়। মন শক্ত করো—ওঁর সঙ্গে তোমাদের যে শেষ অবধি দেখা হল এটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধরে নাও। আমরা চেষ্টা করছি—শেষ পর্যন্ত করব। ওঁর আয়ু লেখা থাকলে উনি তোমাদের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যাবেন।
ধীরগতিতে নৌকো বাইছে মাঝি। শুক্লাজি ভাঙা ভাঙা বাংলায় মাকে শুনিয়ে চলেছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের পৌরাণিক কথা। মা এখন শুক্লাজির কথা একমনে শুনছেন। বিনয় জানে অস্থির মনকে পুরাণের কথায় শান্ত করতে চাইছেন মা!!
শিব যেখানে এই জ্বলন্ত জ্যোতিস্তম্ভ হিসেবে বিরাজ করেন সেস্থান হল জ্যোতির্লিঙ্গ। যার প্রকৃত সংখ্যা ৬৪ তবে ১২টি শিবস্থানকে মহাজ্যোতির্লিঙ্গের মর্যাদা দেওয়া হয়।
শিবমহাপুরাণ-এ আছে একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছিল। দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটাতে মহাদেব নাকি এক আদিঅন্তহীন জ্যোতির্লিঙ্গে পরিণত হন। সেই আলোকস্তম্ভ ত্রিলোক বিদীর্ণ করল। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু সেই আলোক স্তম্ভের উপরে এবং নীচে দু’দিকের অন্ত খুঁজতে গেলেন। বিষ্ণু ফিরে এসে জানালেন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এ জ্যোতিস্তম্ভের কোনও অন্ত তিনি খুঁজে পাননি। অথচ ব্রহ্মা জানালেন তিনি এই জ্যোতিস্তম্ভের অন্ত দর্শন করেছেন। মহাদেব বুঝতে পারলেন ব্রহ্মা মিথ্যাভাষণ করেছেন। কুপিত মহাদেব ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন যে জগতের স্রষ্টা হয়েও এই মিথ্যা ভাষণের জন্য ব্রহ্মা কোনওদিন পূজিত হবেন না। এই সঙ্গে শুক্লাজি এও বলে দিলেন পদ্মপুরাণে কথিত আছে অন্য পৌরাণিক কাহিনি।
একবার ব্রহ্মার হাতের পদ্ম থেকে কয়েকটি পাপড়ি মাটিতে পড়ে যায়। সেই পাপড়ি মাটিতে পড়ে সেখানে কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন দিঘির সৃষ্টি হল। ব্রহ্মা পৃথিবীতে এসে এই জায়গার নামকরণ করলেন পুষ্কর। কর থেকে পতিত পুষ্প—পুষ্প কর বা পুষ্কর। এভাবেই নাকি সৃষ্টি হল পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর আর কনিষ্ঠ পুষ্কর। ব্রহ্মা চাইলেন সেখানে তিনি একটি যজ্ঞ করবেন—সহধর্মিণী ছাড়া যজ্ঞ সম্পন্ন হবে না তাই দেবর্ষি নারদ গেলেন দেবী সরস্বতীকে আবাহন করে আনতে। এদিকে দেবী সরস্বতী পার্বতী ইন্দ্রাণী লক্ষ্মী দেবীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেরি করে ফেললেন।
যজ্ঞের বিহীত সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে কুপিত ব্রহ্মা গায়ত্রীকে বিবাহ করে, গায়ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যোগ্য সম্পন্ন করলেন। দেবী সরস্বতী যজ্ঞস্থলে পৌঁছে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন—ব্রহ্মা কখনও পূজিত হবেন না। পরে বিষ্ণু ও শিবের পরামর্শে দেবী সরস্বতী জানালেন পুষ্কর ছাড়া মর্তের অন্যত্র তাঁর পুজো হবে না আর তিনি গায়ত্রীকে চিরকাল এক অংশ গাভি ও অপর অংশে নদী হওয়ার অভিশাপ দিলেন। ব্রহ্মা পরে দেবী গায়ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে কাউকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে গায়ত্রীকে সর্বদা স্মরণ করতে হবে।
ফেরি থেকে দেখা যাচ্ছে। দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়ির ধাপে ধাপে অজস্র অসংখ্য মাটির দীপ জ্বলছে—গঙ্গার হাওয়ায় সেই শয়ে শয়ে দীপের শিখা থরথর করে কাঁপছে। দশাশ্বমেধ ঘাট কাশীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট। ব্রহ্মা নাকি শিব ও পার্বতীর অভ্যর্থনায় এই ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। এখানকার পবিত্র যজ্ঞে তিনি নাকি দশটি অশ্বের আহুতি দিয়েছিলেন তাই নাম দশাশ্বমেধ।—চলবে
কাশীধাম, ছবি: সংগৃহীত
যে শাড়ি একটি মেয়ের জীবনের সব থেকে সেরা দিনটিতে তাকে সবার সেরা করে তোলে—সব থেকে উজ্জ্বল আলোয় ভরিয়ে তোলে সেই শাড়ি তৈরি হচ্ছে প্রায়ান্ধকার একটি ঘরে। অবশ্য জীবনের এ এক অদ্ভুত পরিহাস। যে বই মানুষকে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে তা ছাপা হয় অন্ধকারের কালিমাখা একটি প্রেসে। যে স্বর্ণালংকার থেকে উজ্জ্বলতা ঠিকরে পড়ে সেই অলংকার তৈরি হয় অন্ধকারে, একটি প্রদীপের সামনে।