খেলনা ঘোড়ার মতোই বাধ্য ফুলমণি
কাশী
বসুন্ধরার ভয় ভয় করছিল। যতই হোক মাঝ রাস্তায় জানোয়ারের মাথা যদি বিগড়োয়—টাঙা উলটে যদি এই বয়সে হাত পা ভাঙে? —বিনয় টাঙাওয়ালাকে বলল যে, তার মা গাড়ি চড়তে ভয় পাচ্ছে। টাঙাওয়ালা বসুন্ধরাকে নিশ্চিন্ত করে বলল—এ ঘোড়াটি তার সন্তানের মতো। আজ ১২ বচ্ছর তার আর তার পরিবারের রুটিরুজি জোগাচ্ছে এই ফুলমণি—কক্ষনো বেইমানি করেনি। খেলনা ঘোড়ার মতোই সে অবাধ্য হয়নি।
—আমরা ওকে আমাদের পরিবারের মানুষজনের মতোই যত্ন করি। মানুষের মতো জানোয়ারের তকলিফ হয়। তখন ওদের খাটালে ওদের দিমাগ খারাব হয়। না হলে জানোয়ার কখনও বেইমানি করে না। বেইমানি মানুষ করে মা!!
টাঙাওয়ালা বক্তিয়ার খানের সহজ সরল জীবন দর্শন শুনতে শুনতে রামকৃষ্ণ মঠের গেটে গিয়ে পৌঁছল বিনয় ও তার মা বসুন্ধরা। হোল্ডল সুটকেশ নিয়ে মঠের গেটে ঢোকার সময় বিনয়কান্তি একবার ফিরে তাকাল। ফুলমণিকে আদর করছে বক্তিয়ার খান।
সামনে অফিসঘরে একজনকে বিনয় বলল, তারা বাচ্চা মহারাজের চিঠি পেয়ে কলকাতা থেকে এসেছে। বাচ্চা মহারাজের পাঠানো সেই চিঠিটা বিনয় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। লোকটি মাকে নিয়ে অফিস বেঞ্চে বসতে বলল। খানিক পরে এলেন সৌম্যদর্শন এক সন্ন্যাসী মহারাজ। সুঠাম চেহারা—বড় বড় চোখ—আর শিশুর মতো পবিত্র নির্মল তাঁর হাসি। সার্থক নাম তাঁর।
স্বামী নিখিলানন্দ ওরফে বাচ্চা মহারাজ জানালেন বিনয়ের বাবা শ্যামসুন্দর রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের হাসপাতালে রয়েছেন। এটা অদ্বৈত আশ্রমের অফিস। হাসপাতাল কাছেই। তবে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা বেজে যাবে। সকাল ৯টা থেকে ১১টা বাড়ির লোকেরা রোগীদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আবার বিকেল চারটে থেকে সাতটা দেখা করার সময়। তারা গোটা রাত রেলে এসেছেন। এখন ক্লান্ত। তাদের সেবাশ্রমের অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে—স্নান খাওয়া সেরে দুপুরটা একটু বিশ্রাম করে বিকেলে চারটের সময় এই অফিসঘরে চলে আসতে হবে। এখান থেকে লোক সঙ্গে গিয়ে হাসপাতালে শ্যামসুন্দরবাবুর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবে। ওই সময় তিনিও হাসপাতালেই থাকবেন।
গাছগাছালিতে ভরা বড় শান্ত সুন্দর পরিবেশ মঠের—অতিথিশালা যাবার পথেই মন্দির পড়ল। সঙ্গের লোকটিকে মা জিজ্ঞেস করলেন এখন ঠাকুর-এর দর্শন করা যাবে কি না। লোকটি জানাল তখনই যেতে। সাড়ে এগারোটার পর মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে আবার বিকেলে খুলবে।
গেরুয়া রঙের সুন্দর মন্দির। সবুজ রঙের জানলা দেওয়া। মন্দিরের গেট খোলা। মাঠ থেকে সাদা সিঁড়ি উঠে গেছে গেটের চাতালে। মন্দিরের দরজা টপকে ভেতরে যেতেই সমস্ত শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। দু’পাশের খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ধূপ চন্দন আর অগরু মিশিয়ে একটা অদ্ভুত মন ভালো করা গন্ধ চারদিকে। দূরে সাদা বেদিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রমাণ সাইজের সাদাকালো বাঁধানো ছবি। দু’পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ছবি—সারদা মা আর স্বামীজির। ছবির সামনে সামান্য সাদা ফুল। বসুন্ধরা ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন৷ তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল নেমে আসছে। বিনয় এর আগে কখনও রামকৃষ্ণ মঠে যায়নি। কথামৃত পড়তে পড়তেই রামকৃষ্ণ পরমহংস স্বামীজি আর সারদা মায়ের ওপর একটা ধারণা হয়েছিল। আজ বেনারসের এই রামকৃষ্ণ মঠে এসে মনে হল— জীবনের সমস্ত ঘটনার ইতিবৃত্ত ঈশ্বর নির্ধারিত করে রেখেছেন। বাখুণ্ডা থেকে গুহবাবুদের সঙ্গে কলকাতার ফড়েপুকুরে আসা, গুহুবাবুর বড়ছেলের সঙ্গে জাহাজঘাটায় যাওয়া, জাহাজঘাটায় পিটারসন সাহেবের সঙ্গে আলাপ, পিটারসন টি কোম্পানিতে কাজ পাওয়া, তেলিপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িতে যাওয়া, মঠ থেকে বাবার সংবাদ পাওয়া—রেলে বেনারস আসা, সবকিছুই আগের থেকে ঠিক হয়ে আছে। জগদীশ্বর ঠিক করে রেখেছেন।
—কী হল? আজকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ?
ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতেই দরজার কাছে শ্রীতমা৷ লকডাউনের কড়াকড়ি একটু কম হতে ছেলে ঋজু মামার বাড়ি গিয়ে মাকে নিয়ে এসেছে। বালিগঞ্জ প্লেস থেকে রাসবিহারী একটুখানি রাস্তা । কিন্তু লকডাউনের কড়াকড়ি টেলিভিশনে দেখে শ্রীতমা নিজেই আসতে চায়নি। ঘরনি ঘরে ফিরলে সেটা উপলব্ধি করা যায়। সুপর্ণকান্তি’র ফেভারিট অ্যাক্টর অমিতাভ বচ্চন একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন স্ত্রী জয়া বচ্চন সম্পর্কে। সুবর্ণ এখন সেটা বুঝতে পারে।
ল্যাপটপ বন্ধ করার সময় শ্রীতমা এসে জিজ্ঞেস করে
—কতদূর পৌঁছলে?
—সবে বেনারস। ওই অদ্বৈতাশ্রম।
লেখা নিজের ভাবনা বটে কিন্তু উপযুক্ত কারও সঙ্গে সে নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারলে লেখাটা বেশ তরতর করে এগোয়। সুবর্ণকান্তি তো আগে কখনও লেখেনি। লকডাউনের একঘেয়েমি কাটাতে যখন বসুন্ধরা ভিলার কথা লিখবে মনস্থ করল— তখন শ্রীতমাই প্রথম খুব উৎসাহ দিয়েছিল। তখন অবশ্য বাপের বাড়িতে গিয়ে হঠাৎ আটকে পড়েছে—যেদিন রাতে লকডাউন শুরু হল সেদিন ওদের বাড়িতে সন্ধেবেলা কী একটা পুজো ছিল। পুজো না মিটিয়ে আর ফিরতে পারেনি। দুদিন পর দুপুরের খাওয়ার শেষে সুবর্ণ টেলিফোনে জানিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত নৈঃশব্দ্য।
—বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলছ? তাহলে আর এগোব না।
—দুর্দান্ত হবে। শুরু করে দাও। আমি গিয়ে শুনব।
হ্যাঁ বা না—কিছু না বললেও—বসুন্ধরা ভিলার গল্প যে এভাবে বড়ঠাম্মি বসুন্ধরা, দাদু বিনয়কান্তি’র সংগ্রামের কথা হয়ে উঠবে—প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দুই বাংলার পটভূমিকায়—সময়ের কথা হয়ে উঠবে—সেটা সুবর্ণ ভাবেনি। এরমধ্যে সে পেয়েছে অমলকান্তির লেখা অপ্রকাশিত আত্মকথা। ফলে কাহিনি এখন আপন আনন্দে সময়ের স্রোতের টানে বয়ে যাচ্ছে। লেখকের হাতে শুধু হালটুকু ধরা আছে। তাই শ্রীতমা মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয় কতদূর পৌঁছলে।
সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসা ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
—শেষ যে অজানা! অচেনা!
আমরা সৌভাগ্যবান সর্বকালের সেরা একজন দার্শনিক লেখক আমাদের এই বাংলা ভাষাতেই গল্পে গানে কবিতায় উপন্যাসে বা প্রবন্ধে তাঁর জীবনদর্শন, তাঁর অনন্যসাধারণ উপলব্ধির কথা কালের সঞ্চয়ে রেখে গেছেন।
খাবার টেবিলে আবার প্রশ্নটা আসে শ্রীতমার কাছ থেকে।
—বেনারসে কোন সমস্যা?
—একথা কেন মনে হচ্ছে?
—তোমার শব্দেরা তোমার প্লট, যখন তোমার বশে থাকে তখন তুমি বেশ রেলিশ করে খাও। কিন্তু কোথাও একটু গন্ডগোল থাকলে খাওয়ার সময় সেই মজাটা পাও না, খাওয়াটা এনজয় করো না, মন পড়ে থাকে সেখানে।
—সাইকোলজির ডক্টরেট করে ফেলতে পারতে। একদম কারেক্ট অ্যানালাইসিস। একটা খটকা লাগছে। একটা ছোট্ট ডিটেল।
—কী খটকা?
—আমি লিখেছি অদ্বৈত আশ্রমের মন্দিরে ঠাকুর সারদা মা আর স্বামীজির ছবি রাখা আছে। রামকৃষ্ণ মঠের অনেক জায়গায় যেমন ব্যাঙ্গালোরে চেন্নাইতে আমি দেখেছি ঠাকুরের মূর্তি থাকে তার সঙ্গে মা স্বামীজির ছবি থাকে। প্রশ্ন হল বিনয়কান্তি মা বসুন্ধরাকে নিয়ে যখন বেনারসের অদ্বৈত আশ্রমে গিয়েছিলেন, সেটা ধরো ১৯২৭-২৮ বা ১৯৩০—তখন বেনারস রামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রমে ঠাকুরের ছবি ছিল না মূর্তি?
—আচ্ছা এরকম অবস্থায় আমার শ্বশুরমশাই সাহিত্যিক অমলকান্তি কী করতেন?
—বাবার কথা আলাদা। মা’র কাছে শুনেছি রেফারেন্সের জন্যে তিনি সরাসরি চলে যেতেন—কথা বলতেন। বাবার ব্যাপারটাই অন্যরকম ছিল—’লালবাড়ির বারান্দা’ লেখার সময় বাবা দিনের পর দিন লালবাজারের সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতেন। সেরকমই একজনকে নিয়ে গল্প।
—তুমি ফোন করো, কথা বলো।
—বেনারসে?
০৫৪২ দিয়ে শুরু বেনারসের লাক্সা রোডের অদ্বৈতাশ্রমের ল্যান্ড লাইন নম্বর। ক্রমাগত চেষ্টা করেও যোগাযোগ হল না—শেষে নেটে অনেক খুঁজে একটা মোবাইল নম্বর পাওয়া গেল। অফিসের যে ছেলেটি ফোন তুলল সে ভাতে-মাছে বাঙালি। প্রশ্ন শুনে সে স্বচ্ছ হিন্দিতে বলেছিল ‘আপনি অধ্যক্ষ মহারাজের সঙ্গে কথা বলুন। উনি আপনার প্রশ্নের ঠিকঠিক জবাব দিতে পারবেন। উত্তর ভারতের অবাঙালিরা ‘মহারাজ’ উচ্চারণের সময় ম-এ অল্পমাত্রায় হালকা একটা আকারান্ত ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু বাঙালির জিহ্বার ছোঁয়ায় সেটাই নিটোল ‘মোহারাজ’।
—আপনি বাঙালি?
—হ্যাঁ৷ মোবাইল নম্বরটা লিখে নিন।
অধ্যক্ষ মহারাজ অতি সজ্জন মিষ্টভাষী। জানালেন,
—ঠাকুরের কৃপায় আপনার কল্পনা সঠিক। যে সময়কালের উল্লেখ করছেন সে সময়ে এই অদ্বৈতাশ্রমে ঠাকুরের ছবিই ছিল। মূর্তি নয়। তবে বারাণসী রামকৃষ্ণ অদ্বৈতাশ্রমের মূর্তির এক ইতিহাস আছে। এই মূর্তি সারা ভারতের রামকৃষ্ণ মঠের ঠাকুরের প্রথম মূর্তি। ১৯৩৬-এ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকীতে এ মূর্তি কলকাতায় বেলুড় মঠের জন্যে নির্মিত হয়। এই মূর্তির প্রাথমিক মডেলে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজ ও অন্যান্য যাঁরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁরা দেখলেন ঠাকুরের দু-কান, দু-চোখের সমান উচ্চতায় করা হয়েছে। সাধারণভাবে আমাদের সকলের ক্ষেত্রে এরকমই হয়। ভাস্কর সেরকমই করেছিলেন। কিন্তু ঠাকুরের দু-কান, দুচোখের থেকে নীচে ছিল। আর আমরা দুহাত জানু স্পর্শ করে বসলে শরীর অল্প সামনে ঝুঁকে থাকে—মেরুদণ্ডও সেই অনুযায়ী সামনে বেঁকে থাকে। মূর্তিতে তেমনই করা হয়েছিল কিন্তু স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজ জানিয়েছিলেন ভঙ্গি বদলাতে হবে। কারণ তাঁর গুরু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব কখনও ঝুঁকে বসতেন না। চিরকাল মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতেন। কিন্তু হাত পৌঁছে যেত জানুতে। কারণ ঠাকুরের দু-বাহু ছিল আজানুলম্বিত। মূর্তিতে বদল করার পরও শ্বেতপাথরে দাগ দেখা গেল—তখন সিদ্ধান্ত হল মূর্তি বারাণসী শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈতাশ্রমে স্থাপিত হবে। হয়তো এ ছিল ঠাকুরের ইচ্ছে। প্রথম তিনি পবিত্র বারাণসীধামে অধিষ্ঠিত হবেন।
দুপুরের পর বিনয় বুঝতে পারে মায়ের খাওয়াদাওয়ায় মন নেই—শুধু চারটে বাজার অপেক্ষা। তাই চারটের একটু আগেই তারা অফিসে পৌঁছে গেল। যে হাসপাতালে নিয়ে যাবে সে অফিসেই ছিল।
হাসপাতাল হাঁটাপথে মিনিট আষ্টেক। বিনয় লক্ষ করে বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে মা ততই অস্থির হয়ে উঠছে। মায়ের সেই অনুভূতি চেষ্টা করেও বিনয় উপলব্ধি করতে পারবে না। নিজের সবথেকে প্রিয় মানুষটিকে দীর্ঘ উনিশ বছরের জন্য হারিয়ে ফেলে—হঠাৎ ফিরে পাওয়ার অদ্ভুত অনুভূতি আশঙ্কা উৎকণ্ঠা মিলিয়ে মিশিয়ে একটা অস্থিরতা মাকে গ্রাস করছে।
ছোট হাসপাতাল। কিন্তু ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দুটি তলা। সঙ্গের লোকটি আমাদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে—হাসপাতাল অফিসে গেল। আশপাশের সবই স্থানীয় লোকজন। হিন্দিভাষী। উনিশ বছর আগে হারিয়ে ফেলা তাদের প্রিয়জনকে দেখতে কে আর বিনয়দের মতো কলকাতা থেকে ছুটে আসবে।
অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং বাচ্চা মহারাজ।——চলবে
সবই ঈশ্বর স্থির করে রাখেন
—কাশীতে এসেছ। বাবা বিশ্বনাথের ধাম… মাকে নিয়ে বিশ্বনাথের মন্দির— ….দশাশ্বমেধ ঘাট দর্শন করে এসো।
—আজই !!
—হ্যাঁ—কবীরের দোঁহা আছে না। কাল করে সো আজ কর/ আজ করে সো অব। পল মে পরলয় হোএহী/ বহুরি করেগা কব।