সেকেলে রেলগাড়ি। ছবি: সংগৃহীত
স্বর্ণময়ী
মাঝবয়সি ভদ্রলোককে সিটে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ভদ্রলোক খুব ঘামছেন—আর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকে হাত দিচ্ছেন৷
বিনয় তার মায়ের দিকে তাকায়, বসুন্ধরাও ঘাবড়ে রয়েছে। বিনয় বাইরের দিকে তাকায়—তখনও প্ল্যাটফর্ম দেখা যাচ্ছে৷
—দেখুন রেল কিন্তু এখনও প্লাটফর্মেই আছে। আপনারা চাইলে এখুনি আমি চেন টেনে গাড়ি থামাতে পারি। এখনও ওঁর ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানো যাবে।
মেয়েটি এবং মেয়েটির মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মেয়েটি বগির দরজার কাছে গিয়ে বেতের ব্যাগ আর ছোট কিটব্যাগটা নিয়ে আসে৷ দ্রুত হাতে কিট ব্যাগের চেন খুলে ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে মেয়েটি। বিনয় এবার সরাসরি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে—
—আপনার কি বুকে ব্যথা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে বুকে।
ভদ্রলোক বিনয়কে হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন—আর মেয়েটি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ছোট্ট কাঠের বাক্স বের করতে করতে বলে—
—আপনি চিন্তা করবেন না। বাবার এই বুক ধড়ফড়ানি রোগটা অনেকদিনের। আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে৷
মেয়েটি অভ্যস্তভাবে একটি হোমিওপ্যাথিক শিশি থেকে ওষুধ ফোঁটা ফোঁটা করে তার বাবার মুখে ঢেলে দেয়। বিনয় গিয়ে হোল্ডলটা আর সুটকেস দুটো নিয়ে এসে সিটের তলায় ঢুকিয়ে দেয়—মেয়েটি লক্ষ করে কুণ্ঠিত হয়৷
—ছি ছি! আপনি আনতে গেলেন কেন? এমনিতেই আমাদের দোষে আপনাকে যথেষ্ট হয়রান হতে হয়েছে।
—মানুষকে বিপদে সাহায্য করাটা হয়রানি নয়৷
মেয়েটির মা বেতের ব্যাগ থেকে বড় কাচের জলের বোতল আর শালপাতার একটা প্রসাদের টুকরি বের করেন৷
—আপনারা তো গাড়ি ধরতে আসছিলেন হঠাৎ আপনার বাবা এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন কী করে?
—আসলে রেল মিস করবে সেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল। তারপর প্ল্যাটফর্মের এতটা দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে তো… সব মিলিয়ে বাবার প্রবলেমটা আবার শুরু হয়েছিল।
মেয়েটি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ ওই ব্যাগ থেকেই একটা ছোট তোয়ালে নিয়ে বাবার ঘাম মুছিয়ে দেয়৷ বিনয় তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে বলে—
—আপনি এবার বসে পড়ুন।
ভদ্রলোকের শ্বাস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে মেয়েটির মা এতক্ষণ পর কথা বলে—
—হ্যাঁ বাবা তুমি বোসো৷ একটু জল দিই।
বসুন্ধরা একটু সরে গিয়ে বিনয়কে বসার ইঙ্গিত করে বলেন—
—না না ভাই, আমাদের কাছে জল আছে৷
—সে তো থাকবেই দিদি—জল ছাড়া তো আমরা রাস্তায় বের হতেই পারি না। এই আমার কাছে ঠাকুরের প্রসাদ আছে সেটা মুখে দিয়ে এই জলটুকু খাও—
জানা গেল ভদ্রলোক পেশায় ব্যারিস্টার। নাম আনন্দমোহন বসু। বরানগরে বাড়ি। ওঁর স্ত্রীর নাম কণিকা। তিন মেয়ে৷ সরোজিনী, সুলক্ষণা৷ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এটি ছোট মেয়ে নাম স্বর্ণময়ী। বড় দুই মেয়ের দূরে বিয়ে হয়েছে। বড়জামাই টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিতে কাজ করে। তারা জামশেদপুরে থাকে। মেজজামাই চাকরি করে বম্বের সেঞ্চুরি টেক্সটাইলে। সম্বন্ধ অনেক আসছে কিন্তু মা বাবার ইচ্ছে ছোট মেয়ের বিয়ে তাদের কাছাকাছি এই কলকাতাতেই হোক৷
ওঁরা চলেছেন মধুপুরে হাওয়াবদল করতে। মধুপুরে আনন্দমোহনবাবুর এক মক্কেলের বাড়ি আছে৷ সেখানে ওঁরা কটা দিন থাকবেন। কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল যে ওঁরা নিজেদের মোটর গাড়ি চেপে আসছিলেন ট্রেন ধরতে। ব্রিজের কাছে অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন কিন্তু মোটরগাড়ি ছেড়ে ব্রিজ পেরোতে ঘোড়াগাড়িতে উঠতেই হাওড়া ব্রিজের মুখে সাংঘাতিক যানজটে আজ এই অবস্থা৷
আনন্দমোহনবাবু তখন থেকে আর উঠে বসেননি। এখনও ঘুমাচ্ছেন৷
কথায় কথায় বিনয় জানাল, মাকে নিয়ে সে কাশীতে যাচ্ছে, সেখানে রামকৃষ্ণ মঠে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বসুন্ধরা তাকিয়ে ছেলেকে দেখল এবং বুঝতে পারল যে কোথায় কতটুকু কথা বলা উচিত সেটা তার বিনু ভালোই রপ্ত করেছে।
মেয়েটি এখন আর বেশি কথাবার্তা বলছে না। মুখের কাছে মলাট করা একটা বইয়ে চোখ দিয়ে বসে আছে৷ এবার কণিকাদেবী বেতের ব্যাগ থেকে ঢাউস পিতলের টিফিন ক্যারিয়ার বার করে খাবার অনুরোধ করেন৷
—আমি নিজে হাতে লুচি আলুর দম বানিয়ে এনেছি৷ আমাদের সঙ্গে একটু মুখে দিতে হবে৷
বসুন্ধরা বিনয়ের মুখের দিকে তাকায়৷ তারপর অনুনয়ের সুরে বলে—
—দেখুন আমরা তো বড় একটা বেরোই না—তাই রাস্তায় ভারী খাবারদাবার খেলে আমার সহ্য হবে না৷ আমার ছেলেও বলল খুব একটা কিছু না করতে—তাই একটু শুকনো চিঁড়ে মুড়ি নাড়ু এসব নিয়ে এসেছি। আপনারা খেয়ে নিন৷
—না বললে আমি শুনব না দিদি। ঠিক আছে আপনার বয়স হয়েছে আমি জোর করব না কিন্তু বিনয়ের তো জোয়ান বয়স—একটু লুচি আলুর দম খেলে ওর কোনও শরীর খারাপ হবে না৷
এতক্ষণে চোখ থেকে বই সরিয়ে কথা বলে উঠল স্বর্ণময়ী৷
—আর আপনার অস্বস্তির কোনও কারণ নেই বিনয়কান্তিবাবু। আপনার ভাগের নাড়ুটা আমি খেয়ে নেব। আর নারকেলনাড়ু খেতে আমি খুব ভালোবাসি৷
বিনয় কথার উত্তর না দিয়ে অন্যভাবে একটু মশকরা করল৷
—আপনার নারকেলনাড়ুর দিকে খেয়াল আছে—আমি তো দেখলাম বই খুলেই আপনি ভাব রাজ্যে চলে গেছেন৷ কী বই এটা?
—রবি ঠাকুরের ঘরে বাইরে৷ পড়েছেন?
—না৷ গল্প উপন্যাস পড়ায় মন বসাতে পারি না। ধৈর্য থাকে না৷
—আপনার কী করতে ইচ্ছে করে?
—অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। অনেক অনেক কাজ৷ যা থেকে যাবে৷
বিনয় খেয়াল করেনি ইতিমধ্যে আনন্দমোহনবাবু এপাশ ফিরে চোখ খুলে ওর কথা শুনছিলেন। তিনি বলে উঠলেন—
—বাহ! তোমার কথার মধ্যে স্বপ্ন আছে, একটা প্রত্যয় আছে। কী পড়ছ এখন?
—আমি ম্যাট্রিক পাশ করেছি তবে বিএ পড়াটা নানা কারণে হয়ে উঠেনি। আমি একটা সাহেবি চা কোম্পানিতে চাকরি করি। ক্লাইভ রো-তে আপিস। তবে ভবিষ্যতে সুযোগ পেলেই ইন্টারমিডিয়েট করে বিএ পরীক্ষাটা দিয়ে দেব৷
রেল বেশ জোরে ছুটছে। মধুপুর আসবে রাত এগারোটা নাগাদ। তার বেশ আগেই ওদের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলতে হবে৷ মধুপুরে লোক আসবে ওদের স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে। শরীর খারাপ হয়েছিল বলে আনন্দমোহনবাবু বিনয়দের চিঁড়ে-মুড়ি এবং নাড়ু খেলেন। স্বর্ণময়ী বেশ তারিয়ে তারিয়ে শুধু নারকেলনাড়ুই খেল৷ ফলে বিনয়কে বেশ অনেকগুলো লুচি আর অনেকটা আলুর দম খেতে হল৷
খাওয়াদাওয়ার পর ট্রেনের দুলুনিতে একটু তন্দ্রামতো আসে—তারাপদবাবুর প্রেজেন্ট করা ঘড়িটা বলছে এখন সবে রাত সাড়ে নটা। আনন্দমোহনবাবু অসুস্থ মানুষ তাই ট্রেনে ওঠা থেকেই আচ্ছন্ন—হয়তো ওই হোমিওপ্যাথি ওষুধের প্রভাব। ওঁর স্ত্রী কণিকাদেবী এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। হয়তো ছুটোছুটি করে ট্রেন ধরা—স্বামীর আচমকা অসুস্থতা—এসবের ধকলে তিনি ক্লান্ত। বিনয়ের মা ঝিমিয়ে আছেন প্রবল মানসিক দুশ্চিন্তায়। মনের যুদ্ধে মানুষ সহজেই এলিয়ে পড়ে। কোলের ওপর খোলা বই—জানলার পাশে ঘুমন্ত স্বর্ণময়ী। হাওয়ায় এলোমেলো চুলকে শাসনের বাঁধনে বাঁধতে একটা কালো সিল্কের স্কার্ফ মাথায় বেঁধে নিয়েছে সে৷ তাতে লাল-সবুজ ছোট ছোট ফুলের কাজ-করা৷ কালো রুমালের ঘেরাটোপে মেয়েটির কাটা কাটা চোখমুখ তার সোনার মতোই উজ্জ্বল ফরসা রং চোখে পড়ে৷ জানলার হাওয়ায় কপালে আর কানের পাশে উঁকিমারা দু-একগুছি অবাধ্য চুলের তিরতিরে কাঁপন দেখতে ভালোই লাগছিল। হঠাৎ স্বর্ণময়ীর ঘুম ভেঙে গেল—সে তার হাতের রিস্টওয়াচ দেখে নিশ্চিন্ত হল।
—মা ওঠো—আর বোধ হয় আধঘণ্টা।
বিনয় চোখের ওপর ডানহাতের কনুইটা চাপিয়ে রাখলেও স্বর্ণময়ীকে চোখের আড়াল করেনি।
মূলত আনন্দমোহনবাবুর ইচ্ছেতেই ঠিকানা বিনিময় হল৷ বসুন্ধরা বা বিনয় বুঝতে পারল এটা নিছকই ভদ্রতা৷ একটা খাতার পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে স্বর্ণময়ী বরানগরে গঙ্গার পাশে চৈতন্যঘাটের কাছে তাদের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিল৷ নীচের অংশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিনয়কে তাদের তেলিপাড়া লেনের বাড়ির ঠিকানা লিখতে হল৷ স্বর্ণময়ী নীচের অংশের কাগজ নিজের কাছে রাখল আর উপরের অংশটা বিনয়কে দিল। বিনয় ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তাই জানিয়ে দিল—
—কাশী থেকে ফিরে আমরা হয়তো ওই বাড়িটা পালটে অন্য কোথাও চলে যাব৷
আনন্দমোহনবাবু বললেন—
—তাহলে তোমার ক্লাইভ রো অফিসের ঠিকানাটা লিখে দাও। আমি তো ডালহাউসি স্কোয়ারে কাজেকম্মে যাই—কখনও যদি তোমাদের বাড়িতে যাবার মনস্থ করি তাহলে তোমার সঙ্গে দেখা করে নতুন ঠিকানা জেনে নেব।
বাড়ির ঠিকানা লেখার টুকরোটাতে বিনয় অফিসের ঠিকানা লেখার সময়ও বুঝতে পারছে নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই বসুপরিবার তাদের নাম-ঠিকানা নিয়ে রাখছেন৷ আনন্দমোহনবাবুরা কখনওই তার মায়ের কাছে আসবেন না—আর তাদের বরানগর যাওয়ার তো কোনও প্রশ্ন ওঠে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্রেনের সখ্যতা নেমে যাওয়া স্টেশনেই শেষ হয়ে যায়।
বিনয় মালপত্র নামিয়ে দিতে সাহায্য করল। মধুপুরের স্টেশনের অন্ধকারেই স্বর্ণময়ীরা হারিয়ে গেল৷
জসিডি ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, গতি আরও বেড়েছে। মা শুয়ে ঘুমোচ্ছে— স্বর্ণময়ীদের সিটে এখনও কোনও নতুন যাত্রী আসেনি। জানালার পাশে যেখানে স্বর্ণময়ী বসেছিল, সেখানেই বসে আছে বিনয়কান্তি। জায়গাটায় একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে, নাকি এটা বিনয়ের মনের ভুল। স্বর্ণময়ীর হাতের লেখা ঠিকানাটা একবার খুলে দেখল। আবার ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল৷—চলবে
স্মৃতির সুগন্ধ। ছবি: সত্রাগ্নি
এই সেই মোকামা জংশন যেখানে বীর প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু হয়। একজন বাঙালি পুলিশ ইন্সপেক্টর তাকে ধরিয়ে দেন। কী যেন নামটা? ইতিহাসের এই একটা সমস্যা। যোগ্য মানুষের সঙ্গেই অযোগ্য কুচক্রী অমানুষের নামটাও একই পংক্তিতে উচ্চারিত হয়। সিরাজউদ্দৌলা এলে তাঁর সঙ্গেই আসে মীরজাফর। প্রফুল্ল চাকীর মতো ভারতমায়ের বীর যোদ্ধার সঙ্গে বাঙালির লজ্জা নপুংসক সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জির নামও এসে যায়।