১৮৭৪ থেকে হাওড়ার পুরোনো ভাসমান সেতু (ছবি: সংগৃহীত)।
ছুটির দরখাস্ত
—আজ্ঞে কাশী যাবার আগে আমি চারটে দিন হাতে রাখছি৷ আমি দিনরাত গুদোমেই থাকব—দারোয়ান থাকবে মুটেরা থাকবে৷ এমন তো নয় যে দিনরাত মাল ওঠাতে নামাতে হবে৷ বাগান থেকে চায়ের পেটি এল তো ওরা নামিয়ে রাখল—তারপর খানিকটা বিশ্রাম করে নিল৷ যখন দরকার পাইকারের মাল তুলে দিল৷ আমি ভোর ভোর গঙ্গা স্নান করে নেব৷ কাজ গুছিয়ে ফেলেছি মনে হলে আপনাকে রেল টিকিটের জন্য বলব তারাপদবাবু৷ আমার কাশীতে যাওয়াকে যাওয়া হবে কোম্পানির কাজটাও আটকে থাকবে না৷ তারাপদবাবু এগোনোর পথ আছে—হ্যাঁ মানছি সে পথ পাথুরে—কষ্ট হবে—হোক! আমি তৈরি৷
এরপর থিয়েটার বায়োস্কোপে যেমন হয়—সেই অনুযায়ী পিটারসন সাহেবের বিনয়কে দুহাতে জড়িয়ে ধরার কথা৷ কিন্তু তা হল না৷ পিটারসন তাঁর ঘরের বড় জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ সেই জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন—
—বিকেডি তুমি যেই দিন তোমার মাতৃদেবীকে লইয়া কাশী যাইবে—সেই দিন হইতে তোমার ছুটি মঞ্জুর হইল৷ আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি৷ তুমি তোমার টিম লইয়া—গোডাউনে কাজ করিতে পারো৷ দারোয়ান এবং পোর্টাররা ওভারটাইম পেমেন্ট পাইবে৷ কিন্তু কোম্পানি তোমাকে ওভারটাইম পেমেন্ট দিতে পারিবে না৷
সাহেবের কথা শুনে বিনয়ের কোনও প্রতিক্রিয়া হল না—কিন্তু তারাপদবাবু উসখুস করতে লাগলেন৷
জানলা থেকে ঘরের দিকে ফিরে পিটারসন ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন বিনয়কান্তির সামনে৷ বিনয়ের দুকাঁধে হাত রেখে সাহেব বললেন—
—তারাপদবাবু ওয়জ রাইট৷ জাহাজঘাটায় সেদিন আমি সত্যই অমূল্য রত্ন পাইয়াছি৷ ইউ আর মাই মোস্ট প্রেসিয়াস জেম৷ তাই তোমার হাতে ওভারটাইম বাবদ সামান্য কটা টাকা আমি দিতে পারিব না৷ তোমার এই এক মাসের ছুটি সবেতন হইবে৷ ইউ উইল গেট ফুল স্যালারি৷ এবং তোমার ও তোমার মাতৃদেবীর কাশী যাতায়াতের সম্পূর্ণ খরচ কোম্পানি বহন করিবে৷ আর তোমার পিতার চিকিৎসাবাবদ যা খরচ হইবে তার কিছু অংশ কোম্পানি খরচ করিবে৷
তিন দিন তিন রাত বিনয় বাড়ি ফেরেনি৷ একবার আধঘণ্টার জন্যে গিয়ে মাকে বুঝিয়ে এসেছিল কেন সে কদিন বাড়ি ফিরতে পারবে না—মাকে বলেছিল বিছানা বাক্স গুছিয়ে রাখতে—যাতে বিনয় অফিস-ফেরতা ফিরে মাকে নিয়ে সরাসরি রেল স্টেশনে পৌঁছোতে পারে৷
তারাপদবাবু কথা রেখেছিলেন৷ মাত্র একদিনের মধ্যে পাঞ্জাব মেলে টিকিট করিয়ে দিয়েছিলেন৷ আর পিটারসন সাহেবের নির্দেশে টিকিট করা হয়েছিল সেকেন্ড ক্লাসে৷ ছেলের কথামতো বসুন্ধরা শতরঞ্চির মধ্যে বালিশ চাদর কম্বল দিয়ে মুড়ে বিছানা বেঁধে নিয়েছিল—আর ওদের পুরোনো টিনের তোরঙ্গখানায় দুজনের জামাকাপড় গায়ে দেওয়ার চাদর নিয়েছিল৷ বিনয় সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছিল—বসুন্ধরা অবাক হয়ে দেখলেন ছেলের হাতে একটা ঝকঝকে নতুন চামড়ার সুটকেস৷ খবরের কাগজে মোড়া৷
—এটা কী রে বিনু?
—টিনের তোরঙ্গের দিন গেছে মা৷ যা মালপত্তর ধরে তার থেকে মালের বাক্স ভারী৷ তাই এই নতুন সুটকেস কিনে আনলুম৷ আর শতরঞ্চি মুড়ে আর বিছানা বালিশ নিতে হবে না—তার জন্য ক্যাম্বিসের মোটা কাপড়ের আলাদা বিছানা নেবার ব্যাগও আছে৷ তার নাম হোল্ডল৷
কাগজ সরিয়ে দড়ি কেটে সুটকেস খুলে ফেলল বিনয়৷ ভেতর থেকে বের হল ঘন জলপাই রঙের হোল্ডল৷ বসুন্ধরা আবার নামটা সড়গড় করে নেন৷
—হোল্ডল?
—হ্যাঁ মা হোল্ড অল, এর মধ্যে তোমার গোটা সংসার ভরে নিতে পারবে৷
—আর ওইটা কী?
—এটা জল রাখার বোতল৷ মিলিটারিদের বোতল—সাহেবরা নাকি ক্যান্টিন বটল বলে৷ এনামেল-এর বোতল বাইরেটা মোটা ফেল্টের কাপড় দিয়ে মোড়া৷ ঢাকনা এঁটে দিলে, ব্যাস একফোঁটা জল বাইরে পড়বে না৷ ভিতরে জল ঠান্ডা থাকবে৷
—আমি তো সব গুছিয়ে রেখেছিলুম৷ বিছানা বেঁধে রেখেছিলুম! খামোকা কতকগুলো টাকা নষ্ট করলি তো?
—এসব টাকা আমায় কোম্পানি দিয়েছে মা৷ বাবার অসুখ শুনে সাহেব আমায় এক মাসের সবেতন ছুটি দিয়েছেন৷ রেলের যাতায়াতের ভাড়াও কোম্পানি দিচ্ছে৷ বাবার চিকিৎসা খরচবাবদ কিছু টাকা দেবেন বলেছেন৷
—বলিস কীরে বিনু৷ সাহেবের এত দয়া!!
—পিটারসন সাহেব যথেষ্ট ভদ্র এবং দয়ালু—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু মা এসব আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করেছি—আমি না থাকাকালীন কোম্পানির কাজের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তার জন্য আমি দিনরাত এক করে খেটেছি৷ এভাবে কোম্পানির স্বার্থ দেখার কথা কোনও কর্মচারী বা পিটারসন সাহেবও কখনও ভাবেননি৷ তাই তিনি আমার স্বার্থ দেখেছেন৷
বসুন্ধরা অবাক হয়ে তার ছেলেকে দেখছিল তার কথা শুনছিল৷ ছোটবেলার সেই ছোট্ট বিনু কবে যে এত বড় হয়ে গেল সেটাই বুঝতে পারছে না বসুন্ধরা৷ আরও অবাক হল তার পরের কথাগুলো শুনে৷
আর মা, টাকাপয়সা হল আঁজলা ভরা জল—হাতে জমিয়ে রাখা যাবে না—আঙুলের ফাঁকফোকর দিয়ে হাতের চেটোর খাঁজ গলে সেই এক আঁজলা জল একটু একটু শেষ হয়ে যাবে—একটুখানি বাঁচবে৷ তাই অপেক্ষা কোরো না তেষ্টা পেলে চুমুক দাও—ক্লান্ত হলে মুখেচোখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দাও—যতটা পারো নিজের কাজে নিজের প্রয়োজনে লাগাও৷ বাকি যতটুকু সম্ভব সঞ্চয় করো৷ আর এগিয়ে চলো—দাদু যে বলতেন ‘চরৈবেতি’৷
বিনয়ের খুব ইচ্ছে ছিল মাকে ট্রামে চড়াবে৷ কিন্তু হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রাম তো যায় না৷ আহিরীটোলা ঘাট থেকে ফেরিতে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ার সালকে বাঁধাঘাট পৌঁছানো যায়৷ মা তো টানা রিকশায় উঠবে না৷ তেলিপাড়া লেন থেকে আহিরীটোলা ঘাট হাঁটাপথে মিনিট পঁচিশ৷ কিন্তু মাকে নিয়ে হোল্ডল সুটকেস সঙ্গে করে ফেরি পেরোনোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না৷ তারপর ওপারে সালকে থেকে হাওড়া স্টেশনের রাস্তাও জানা নেই—সময়ও লাগবে৷ অগত্যা ঘোড়ার গাড়ি ভরসা৷ ঘোড়াগাড়ি মা চড়েছে৷ বাখুন্ডা থেকে যেবার ওরা কলকাতা এল তখন রেলস্টেশন থেকে ফড়েপুকুরে গুহবাবুদের বাড়ি পর্যন্ত ঘোড়া গাড়ি করেই গিয়েছিল৷ হোল্ডল সুটকেস নিয়ে কাঁধে ওয়াটার বটল মাকে নিয়ে বিনয় ঘোড়াগাড়ি চাপল৷ সন্ধেবেলার রেল কিন্তু হাতে বেশ একটু সময় নিয়েই বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়ল৷ হাওড়ার এই ‘পন্টুন ব্রিজ’ বা ভাসমান সেতুর কোনও ভরসা নেই৷ নীচে নৌকো উপরে পাটাতন৷ স্টিমার এলেই কেলেঙ্কারি৷ গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে ব্রিজের মাঝখানটা খুলে যাবে। ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে করতে স্টিমার পেরিয়ে গেলে আবার ব্রিজ জুড়বে৷ তারপর ব্রিজ চালু হবে৷ এছাড়া টোলের পয়সা দিতে লম্বা লাইন পড়বে৷ তারাপদবাবু বলছিলেন আগে তো খুব ঝঞ্ঝাট ছিল৷ দেখ্ না-দেখ্ ব্রিজ বন্ধ৷ তখন রাতে ব্রিজ খোলা হত না৷ ইদানীং রাতে ব্রিজ খোলা হয় তখন লঞ্চ-স্টিমার বেশি চলাচল করে৷ কোম্পানির কাজে এই হাওড়া ব্রিজ দিয়ে সে প্রায়ই রেলের মাল গুদামে যায়৷ হেঁটেই যাতায়াত করে৷
বসুন্ধরা অবাক চোখে কলকাতা শহরকে দেখছে—হাতিবাগান ছাড়িয়ে কলেজ স্ট্রিট হ্যারিসন রোড হয়ে চলেছে তারা৷ বিনয় জায়গাগুলো দেখিয়ে নাম বলে বলে যাচ্ছে৷ বাঁকের মুখে বসুন্ধরার খেয়াল হল পিছনে একটা ট্রাম৷ বিনয় জানাল ওটা ট্রাম৷ ইলেকট্রিকে চলে৷
‘তো আমরা ওখানে কেন উঠলাম না? ভাড়া বেশি?’
‘আমাদের রাস্তায় ট্রাম যাবে না৷ তবে কিছুদিন পরে হয়তো যাবে৷ এই পুরোনো ব্রিজ আর টানতে পারছে না সরকার বাহাদুর নতুন ব্রিজ বানাবার কথা ভেবেছেন৷’
‘কদ্দিন লাগবে?’
‘সে কি বলা যায় মা—এই যে ব্রিজটা দেখছ—নৌকার উপর ভাসছে৷’
‘সে কীরে নৌকো সরে গেলে?’
‘সে সব বুঝেই বানানো হয়েছে৷ মালপত্তর সব বিলেত থেকে জাহাজে করে এসেছিল মা৷ নতুন যে ব্রিজ বানানোর কথা চলছে সেটা ইস্পাত দিয়ে তৈরি হবে ঝুলন্ত ব্রিজ৷’
আজ ব্রিজ কোনও সমস্যা করেনি—তরতর করে পেরিয়ে গেল তারা৷ বিকেল থাকতেই বিনয় মাকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে ঢুকে পড়ল৷ কুলির দল ছোঁকছোঁক করছিল—কিন্তু একহাতে নতুন চামড়ার সুটকেস অন্যহাতে নতুন হোল্ডল নিয়ে সে এগিয়ে যেতে লাগল—বসুন্ধরা ছেলের হাত ধরে পাশে পাশে চললেন৷ হাওড়া স্টেশনে হালে এক বড় ঘড়ি লাগানো হয়েছে৷ লোকজনকে খুঁজে পেতে সুবিধে৷ তার তলায় মালপত্র রেখে বিনয় মাকে মালের উপর বসতে বলে—বলল ‘চোখকান খোলা রেখো—আমি একটু চায়ের জোগাড় দেখি রেলের এখন দেরি আছে৷’ —চলবে
১৯৪৩ থেকে নতুন হাওড়া ব্রিজ।
—এটা নিতে তোমার যত কুণ্ঠা৷ তার চেয়ে বেশি কুণ্ঠা আমার এই পুরনো জিনিসটা তোমায় দিতে৷ পারলে আমি তোমায় একটা নতুন ঘড়িই কিনে দিতুম৷ আসলে এটা আমার বাবার বিলিতি রিস্টওয়াচ৷… পিটারসন সাহেব বলেছে—আমিও বিশ্বাস করি তুমি একদিন অনেক আগে এগিয়ে যাবে৷ সেদিন আমি হয়তো থাকব না—কিন্তু আমার বাবার এই পুরনো ঘড়িটা হয়তো চলবে৷ এটা তখন তোমায় আমার কথা মনে করিয়ে দেবে বিনয়৷