রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


তেলিপাড়া লেন

ঠাকুর বলছেন—
ঈশ্বরের নাম গুণগান সর্বদা করতে হয় আর সৎসঙ্গ। ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এঁদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর ও বিষয় কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মন হয় না। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন।
‘যখন চারাগাছ থাকে তখন তার চারদিকে বেড়া দিতে হয়, না দিলে ছাগল-গোরুতে খেয়ে ফেলে।’
‘ধ্যান করবে কোণে মনে ও বনে।’
সেখানেই ঠাকুর বলেছেন গৃহস্থ সন্ন্যাস-এর কথা। শ্রীম জানতে চাইলেন
সংসারে কীরকম করে থাকতে হবে?

ঠাকুর বলছেন—
‘সব কাজ করবে কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে।… বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ ক’চ্ছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন প’ড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতো মানুষ করে। বলে, ‘আমার রাম’ ‘আমার হরি’ কিন্তু মনে বেশ জানে এরা আমার কেউ নয়।… কচ্ছপ জলে চ’রে বেড়ায় কিন্তু তার মন কোথায় প’ড়ে আছে জানো? আড়ায় প’ড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে।

ঈশ্বর ভক্তি লাভ না করে যদি সংসার করতে চাও তাহলে আরও জড়িয়ে পড়বে।…. তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা না হলে হাতে আঠা জুড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ ক’রে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।’
এতটাই সহজ কথায় ঈশ্বরের উপস্থিতি ও উপলব্ধি বুঝিয়ে গেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। কথামৃতের পাতায় পাতায় সেসব অসাধারণ উদ্ধৃতি রয়েছে।

একতলায় কোণের ঘর, আলো-হাওয়া কম খেলে—তাই ভাড়াটা বিনুর সাধ্যের মধ্যে—সামনের বারান্দাটুকুতেই মা-ছেলের রান্নাবাড়ি। দেয়ালে খোপখোপ ঘুলঘুলি—সেখান দিয়েই তেরচা রোদের আলো এসে পড়ে আর ঘুঁটে কয়লার ধোঁয়া রান্নার ঝাঁজ বাইরে যায়। থান ইটের উপর তক্তপোশ পেতে শোয়ার বন্দোবস্ত—খাটের তলায় হাঁড়িকুড়ি তোরঙ্গ রাখা। বসার শোবার বা খাবার ঘর ওই একটিই। লম্বা লম্বা লোহার শিক লাগানো সবুজ রঙের জোড়া পাল্লার একটাই জানলা।
অথচ কী অবাক কাণ্ড—এই গোপালকৃষ্ণ ঘোষের মতো মুখোশ পরা ভেকধার্মিক লোকেও ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা বলেন—বাড়ির দুরবস্থার কথা তুললেই বলেন—

দেখো বাবা, হরির কৃপায় তোমরা এ বাড়িতে জায়গা পেয়ে গেছ। এই শ্যামপুকুর স্ট্রিট তেলিপাড়া লেন এসব পুণ্যভূমি সেটা তুমি জানো? অসুখ ধরা পড়ার পর কাশীপুরের বাড়িতে যাওয়ার আগে ১৮৮৫ সনের আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে টানা ৭০ দিন ঠাকুর সারদা মা শিষ্যদের নিয়ে ৫৫ নম্বর শ্যামপুকুর স্ট্রিটে থাকতেন। যাও যাও ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে ধোরো না। শ্রীহরির অশেষ দয়া তোমরা এ বাড়িতে জায়গা পেয়েছ।

তাহলে কামারপুকুর দক্ষিণেশ্বর তো ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র—তবে কি এসব জায়গায় কখনও কোনও স্বার্থপর ঠগ দুশ্চরিত্র মানুষ থাকতেন না?

যাইহোক থাকতে থাকতে বসুন্ধরা ও বিনয় দুজনেই তেলিপাড়া লেনের বাড়িতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। অসুবিধেগুলোও যেন কেমন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা ফড়েপুকুরের গুহবাড়ি থেকে জরুরি তলব এল। কত্তাবাবু গিরিজাশঙ্কর গুহ নিজে পত্র মারফত ডেকে পাঠিয়েছেন। মা ছেলে দুজনেই বুঝল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেরি না করে সেই রাত্তিরেই বিনয় ছুটল ফড়েপুকুরে গুহদের বাড়িতে।
বিনয়ের মা বসুন্ধরার নামে ফরিদপুরের বাখুন্ডার বাড়ির ঠিকানায় কাশী থেকে একটা চিঠি এসেছে। ভাগ্যক্রমে পোস্টমাস্টারমশাই জানতেন বসুন্ধরা ছেলেকে নিয়ে গুহবাবুদের সঙ্গে তাদের কলকাতার বাসাবাড়ি ফড়েপুকুরে গিয়ে আছে। তাই তিনি নিজে গিয়ে বাখুন্ডায় গুহবাড়িতে চিঠি দিয়ে এসেছেন। ভাগ্যিস গুহবাড়ির বড়ছেলে কলকাতা থেকে বাখুন্ডায় গিয়েছিল। না হলে ডাকে এলে আরও দু সপ্তাহ লেগে যেত।

কাশীতে কেউ থাকে বলে মায়ের কাছে কস্মিনকালেও কিছু শোনেনি বিনয়। তাই কাশী থেকে মায়ের নামে চিঠি আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার মুখ-আঁটা বন্ধ খামে গোটা গোটা অক্ষরে ঠিকানা লেখা আছে। মায়ের নামের নীচে লেখা আছে প্রযত্নে শ্যামসুন্দর দত্ত। মানে যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি বাবার দেশান্তরি হবার বিষয়টি জানেন না। আর চিঠির খামটায় রামকৃষ্ণ মঠ, বেনারসের একটা ছাপ লাগানো। তার মানে চিঠিটা যিনি লিখেছেন তিনি কি রামকৃষ্ণ মঠের কেউ?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটাপথে ফড়েপুকুর থেকে তেলিপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িতে পৌঁছে গেছে বিনয়কান্তি।
মা-ও চিঠি দেখে অবাক। তাঁকে কাশী থেকে কে পাঠাবে চিঠি? বিনয় মাকে খামবন্ধ চিঠিটা এগিয়ে দেয়।

তুই-ই পড় না বিনু!

না-মা, তোমার নামে চিঠি। তুমিই পড়ো!!

খামটা বাঁচিয়ে বিনু সাবধানে খামের মুখটা খুলে চিঠি বের করে মার দিকে এগিয়ে দেয়। বসুন্ধরা সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নারী নন—বাবা হেডমাস্টারমশাই ছিলেন—বসুন্ধরা রীতিমতো পড়াশোনা করেছে—বিনুকে ছেলেবেলায় তিনি পড়াতেন। কিন্তু মাত্র কয়েক লাইন চিঠি পড়ার পরেই বসুন্ধরা আঁতকে উঠলেন—টাল সামলে বিছানায় বসে পড়ে ছেলেকে চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন দেখ বিনু! কী সাংঘাতিক ঘটনা !!

চিঠি খুলল বিনয়।

মাননীয়া বসুন্ধরা দেবী,
আপনার স্বামী শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর দত্ত মহাশয় জীবিত আছেন। কিন্তু তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বেনারসের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের হাসপাতালে রয়েছেন। তিনি এতটাই অসুস্থ যে নিজের চিঠি নিজে লেখার ক্ষমতাটুকুও আজ তাঁর নেই। আমি মঠেরই একজন সন্ন্যাসী। আমি আমাদের আশ্রমে ‘বাচ্চা মহারাজ’ নামে পরিচিত।

জানি না, এতদিন বাদে আপনারা কী অবস্থায় আছেন! শ্যামসুন্দরবাবু আমাকে সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়েছেন। তবে এতবছর বাদে আজ তিনি ঘোর অনুতপ্ত! অসহায় স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে এভাবে ফেলে রেখে সংসার ত্যাগ করা যে তার উচিত হয়নি সেটা আজ তিনি উপলব্ধি করেছেন।

এই চিঠি কবে বা আদৌ কোনওদিন আপনাদের হাতে পৌঁছাবে কি না জানি না। বাখুন্ডায় আপনার স্বামী শিক্ষক হিসাবে অধিক পরিচিত হবেন। তাই প্রযত্নে তাঁর নাম উল্লেখ করলাম। তবে সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে, চিঠি পাওয়ামাত্র সন্তানসহ আপনি কাশীর উদ্দেশে রওনা দিবেন। শ্যামসুন্দরবাবু গুরুতর অসুস্থ—তিনি আপনাদের শেষ দেখা দেখতে চান।
ভবদীয়
স্বামী নিখিলানন্দ

চিঠি পড়া শেষ করে বিনয় তাকাল মায়ের দিকে। মা বসুন্ধরা স্থবিরের মতো বসে আছে, কোনও সাড় নেই যেন। বিনয় জানাল—কালই অফিসে গিয়ে ছুটির দরখাস্ত করতে হবে। এরকম একটা অবস্থায় পিটারসন সাহেব নিশ্চয়ই ছুটি দিতে অরাজি হবেন না। তবে তৈরি হতে এক দুদিন সময় তো লাগবে। রেলের টিকিট কাটা আছে, বাক্স বিছানা নেওয়া আছে। কখনও তো সেভাবে ওরা একা বেরোয়নি—সেই একবারই যা বাখুন্ডা থেকে গুহবাবুদের সঙ্গে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে লঞ্চে গোয়ালন্দ ঘাট তারপর রেলে করে কলকাতার শিয়ালদা স্টেশন। সেবার কোনও দায় নেই দায়িত্ব নেই—শুধু গুহবাবুদের সঙ্গী হয়ে আসা। কিন্তু এবার তো প্রথম একা একা বের হওয়া। তাই বাক্স বিছানা বেঁধেছেঁদে দিয়ে তৈরি থাকতে হবে। রেলের টিকিট পেলেই তখুনি যাতে বেরিয়ে পড়তে পারে৷

জালের আড়ালে সেকালের ট্রামচালক।

হাতে কিছু টাকাকড়িও দরকার! বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে কতদিন থাকতে হবে জানা নেই। বাবা কতটা অসুস্থ তার চিকিৎসায় কী খরচা হবে সেটাও জানা নেই। হতেই পারে তাঁর কিছু ধারবাকি রয়েছে। সেগুলো মেটানোর দায়িত্ব সন্তানের ওপর বর্তায়। কিন্তু এক্ষুনি এক্ষুনি টাকা কোথায় পাবে? ভিটেবেচা টাকা মা’র একমাত্র সম্বল। সে টাকায় কিছুতেই বিনয় হাত দেবে না। বাবার চিকিৎসা বা ধারবাকি থাকলে তার জোগাড় তো তাকেই করতে হবে। চাকরিতে ঢুকে মেরুদণ্ড সোজা করে গুহদের ফড়েপুকুরের বাড়ি থেকে মাকে নিয়ে চলে এসেছে। কত্তাবাবু-কত্তামা বলেছেন যে কখনও সাহায্যের কিছু দরকার পড়লে তাঁদের কাছে যেতে। কিন্তু বললেই তো আর গিয়ে বাবার অসুখের কথা বলে ফস করে টাকা চাওয়া যায় না। মানসম্মান বলে তো একটা ব্যাপার আছে। বিনয় যেন দায়িত্বের জালের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে! এগোতেও বাঁধছে আবার পেছোবারও উপায় নেই। কিন্তু পথ একটা বের করতেই হবে। তারাপদবাবুকে বলে পিটারসন সাহেবকে একবার… এইসব সাতসতেরো ভাবতে ভাবতেই মনে হল—দাদুর বলা কথা।
দাদুভাই! বিপদে আপদে কক্ষনো ভয় পাবে না। সবসময় জানবে, যিনি বিপদ দেন –সমাধান দেন তিনিই। তাই তিনি বিপদতারণ।
দাদুর কথা মনে হতেই—মনে সাহস এল বিনয়ের। দুচোখে জড়িয়ে এল ঘুম।

মাঝরাতে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল—জানলা দিয়ে শেষ রাতের চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। বিনয় আবিষ্কার করল—তার মা খাটের নীচে তোরঙ্গ টেনে বের করেছে। তোরঙ্গের ভেতর থেকে বিয়ের সময়ের কনের মাথায় দেওয়ার লাল ভেল—সিঁদুর চুপড়ি বের করে—সেগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদছে বসুন্ধরা। কিন্তু কেন? —চলবে

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি
পরের পর্ব আগামী রবিবার
কোনও ভণিতা না করে বিনয় সরাসরি সত্যি কথাটা বলল মুটেদের সর্দারকে। কী ভাগ্যিস আরও জনাতিনেক মুটেও এসেছিল। মুটেদের সর্দার এবং মুটেরা এককথায় বিনয়কান্তিকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এত বছরের জীবনে এই প্রথম কেউ তাদের সঙ্গে মানুষের মর্যাদা দিয়ে কথা বলেছে। গোডাউনের দুজন দারোয়ানও ‘বিনোয়’বাবুর কথায় রাজি।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content