বাখুন্ডায় শ্যামসুন্দরের ভিটে বাড়ি।
চা-গুদামের কেরানি
পকেট থেকে সাদা ধবধবে রুমাল বের করে চশমার কাচ মুছতে মুছতে টেবিলে রাখা চিত্তর চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললেন—
এটা বলেই শেষ করব। ফর্মুলা নম্বর এক হল, কাজ হাতে করার আগে আগাপাশতলা মাথায় করে ফেলবে। না হলে দেখবে কাজটা সুতলির জটের মতো জড়িয়ে যাচ্ছে—কিন্তু শেষ হচ্ছে না। আর দু’নম্বর হল, কেজো লোকের কাজ বেশি—কিন্তু কাজকে খবরদার কোমরের উঁচুতে উঠতে দিও না—কাজের ঢেউয়ের মধ্যে দম আটকে যাবে। আজকের কাজ আজ না করে রেখে দিলে—কাল সে কাজ ছোবল মারবে—পরশু তরশু তিন দিন পর সে কাজই তোমায় গোটা গিলে খাবে।
বিনয় কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিল তারাপদবাবু কাজ শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতা উপলব্ধি উজাড় করে দিতে চাইছেন—নিজেকে গড়তে গেলে এই প্রৌঢ়ের প্রতিটি কথাকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে।
গীতায় যেমন আছে ধর্ম-দর্শন—তারাপদবাবুর কথাগুলো বিনয়কান্তির জীবনে গীতার মতোই কর্মদর্শন। আজীবন ভোলেননি এই কথাগুলো।
তারাপদবাবু ক্লাইভ রো অফিসে চলে যাবার পর—বিনয়কান্তি একটা সপ্তাহ নিল ঘর গোছাতে। গুছিয়ে বসার আগে সে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখতে পায় তার সারা মাসের কাজ। গোটা গুদামের কোথায় কোথায় টিনের চালে ফুটো ফাঁকফোকর আছে সেগুলো খুঁজে বের করে ফেলল। এরপর চায়ের জাত অনুযায়ী দামের, চায়ের পেটি সাজিয়ে ফেলল যাতে পুরনো মাল বেশিদিন পড়ে না থাকে। আগের চায়ের পেটি আগে পরের পেটির চা যাতে পরে বাজারে যায়। সমস্ত খাতাপত্র তারিখ নম্বর দিয়ে ঝকঝকে করে গুছিয়ে ফেলল।
দুসপ্তাহ বাদে স্বয়ং পিটারসন সাহেব এলেন গোডাউন দেখতে। সঙ্গে পুরনো ক্লার্ক তারাপদ পাল। সাহেব কিছু বলার আগেই তারাপদবাবু বলে উঠলেন—
মাত্র ১৫ দিন আগে ছেড়ে যাওয়া আমার নিজের কাজের জায়গা আমি চিনতে পারছি না সাহেব। একথা ঠিক যে আমি খুব যত্ন করে বিনয়কান্তিকে কাজটা শিখিয়েছি। কিন্তু ওর কর্মক্ষমতায় ও এই গোটা গোডাউন যেন বদলে দিয়েছে। সত্যি সাহেব, কোম্পানিতে আপনি একজন রত্ন নিয়ে এসেছেন।
পিটারসন হাসতে হাসতে শুদ্ধ বাংলায় উত্তর দিয়েছিলেন—
আমি উনাকে জাহাজঘাটা থেকে ধরিয়া আনিয়াছি বাবু!! আপোনাদের পুরাণে আছে—পুরাকালে সমুদ্র মন্থন করিয়া, রত্নরাজি অমৃৎ উঠিয়াছিল।
বিদেশি সাহেবরা বাংলায় এসে বাংলা ভাষাটা রপ্ত করার চেষ্টা করত। সরকারি সাহেবসুবোদের তো রীতিমতো বাংলা পড়তে হত, পরীক্ষা দিতে হত—কিন্তু ব্যবসার সূত্রে আসা অন্য সাহেবরাও বাংলা ভাষার কদর করত। ভারতীয় দেবদেবী পুরাণের ওপর উইলিয়াম পিটারসনের যে একটা ব্যুৎপত্তি ছিল বিনয়কান্তি সেদিন সেটা উপলব্ধি করল। প্রথম মাসের মাইনে নেবার সময় হলে সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন—টাকা নিয়ে সে কী করবে?
উত্তরে বিনয় জানিয়েছিল একটা ধুতি চাদর আর একখানা ভালো তাঁতের শাড়ি কিনবে। সাহেব বলছিল নিশ্চয়ই মা-বাবার জন্যে? বিনয় বলেছিল ছোট থেকেই তার বাবা দেশান্তরি একথা সাহেবকে জানানো হয়নি কারণ তার মা এখনও বিশ্বাস করেন যে বাবা ফিরে আসবেন। আর মায়ের জন্য শাড়ি সে এখন কিনবে না।
অবাক হয়ে সাহেব জিজ্ঞেস করেছিল তাহলে এই ধুতি চাদর শাড়ি কার জন্য? মাথা নামিয়ে বিনয় উত্তর দিয়েছিল যাঁদের দাক্ষিণ্যে আজ আপনার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি সেই কত্তাবাবু আর কত্তামার জন্য। তাঁদের পায়ের কাছে এই ধুতি চাদর শাড়ি আর মিষ্টি নামিয়ে রেখে প্রণাম করবে বিনয়। জানাবে চাকরি পাবার সুখবর। আর মাকে নিয়ে ফড়েপুকুর থেকে ভাড়া বাড়িতে উঠে যাবার অনুমতি চাইবে।
লালমুখো আমেরিকান সাহেবের দু’চোখ জলে ভিজে গিয়েছিল। একটানে চোখের সরু ফ্রেমের গোল চশমা সরিয়ে সাহেব বলেছিল—তুমি একেবারে অন্যরকম বিকেডি। তোমার মধ্যে দারুণ কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে।
সানন্দে মাকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে যাবার সম্মতি দিয়েছিলেন গিরিজাশঙ্কর গুহ এবং তাঁর স্ত্রী। বলেছিলেন ভবিষ্যতে কোনও দরকারে বিনয়কে যেন পাওয়া যায়। আর ভবিষ্যতে কখনও কোনও সাহায্য লাগলে বিনয় নির্দ্বিধায় কর্তাবাবুর কাছে আসতে পারে।
যোগাযোগ ছিল। আরও প্রায় বছর দশেক বেঁচেছিলেন গিরিজাশঙ্কর গুহ। তার কিছুদিন বাদে কত্তামা চলে গেলেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই কর্তাবাবুর বড়ছেলে ফড়েপুকুরের বাড়ি বিক্রি করে ফরিদপুরের বাখুন্ডায় ফিরে গিয়েছিলেন।
অবশ্য সে গল্প পরে করা যাবে।
সে সময়টা ক’দিন বাবা লিখছেন না। সোফায় বসে তখন বাবা এন্তার বাংলা সিরিয়াল দেখতেন। সব। কোনও বাছবিচার নেই। কেউ জিগ্যেস করলে বলতেন, বাংলা ভাষা—কত কত সংলাপ। কত ধরনের বিন্যাস—ঠিক ভুল বিচার না করে মাথায় নিয়ে নিচ্ছি—অসারটুকু ফেলে দেব—আজ দেখব কাল ভুলে যাব। আমার মাথা আমার মন যেটা রাখবার রাখবে। আম হল আমজনতার। আপেল হল অ্যারিস্ট্রোক্যাসি। আম পেট ভরে খাওয়া যায়। আপেল একটা কি দেড়খানা। আমের গোনাগুনতি নেই।
সেটা ১৯৯৫—আমার বিয়ের ঠিক পরপর। সন্ধেবেলা বাবা নীচের ড্রয়িংরুমে মন দিয়ে একটা দূরদর্শনের ধারাবাহিক দেখছেন। এখনকার মতো প্রাইভেট চ্যানেলের ভিড় ছিল না তখন। মামাবাড়ির সূত্রে এক আত্মীয় যিনি বাবারও সম্পর্কে গুরুজন এসে বসলেন, মা আর আমার আনকোরা নতুন বউ শ্রীতমা এল। সঙ্গে কাজের দিদির হাতে ট্রে-তে চা এবং কিছু সান্ধ্যকালীন ‘টা’। বাবার মন টিভিতে—একটা থ্রিলার গোছের কিছু চলছে। একবার সেই মানুষটির দিকে ভদ্রতার টুকরো হাসি হেসেছেন। ব্যাস ওইটুকুই। মানুষটি আর না পেরে বলে উঠলেন—
কী এত দেখচ ?
ওই যা দেখাচ্ছে।
তুমি এসব দেকো? আমি তো কোয়ালিটি প্রোগ্রাম ছাড়া টিভিই খুলি না৷
আজ্ঞে আমি সর্বভুক—যা পাই খাই। যা দেখায় দেখি। যা পাই পড়ি। এই তো আর পাঁচটা মিনিট পরেই আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।
মা আন্দাজ করেছেন মেঘ ঘনাচ্ছে—মা আমার দিকে তাকালেন। সে মানুষটি ছাড়বার পাত্র নন।
কী এটা?
বাংলা সিরিয়াল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প। নাম চোখ।
চোখ?! আচ্ছা যতদূর মনে পড়চে—কিচুদিন আগে কি নাক না কান বলে কিচু একটা বেরিয়েছিল?
বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন—
আজ্ঞে আমি আমার যৎসামান্য চর্চায় বাংলা সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে নাক বা কান খুঁজে পাইনি—আপনার যেটা মনে হচ্ছে সেটাও ‘চোখ’। উনিশশো বিরাশিতে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী তারই গল্পে ‘চোখ’ পরিচালনা করেন। আপনি তো ফি বছর বইমেলার শেষদিনে পাঁজা-পাঁজা বই এনে সুটকেস বোঝাই করেন—একটু খুঁজে দেখবেন তো নাক বা কান খুঁজে পান কি না? না পেলে জানাবেন। এই বছরই দুটো পুজোবার্ষিকীতে আমি পাঠকদের একটা করে নাক আর কান উপহার দেব।
এরপর মা-যে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সুবর্ণ এবার লিখবে বিনয়কান্তির ভাড়াবাড়ির কথা।
তেলিপাড়া লেন
হাতিবাগানের কাছে তেলিপাড়া লেনে একটা এজমালি বাড়ির একতলায় ঘুলঘুলি বারান্দা দেওয়া এককামরা ভাড়া করে মাকে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল বিনয়কান্তি। সারা বাড়িতে অনেক লোকের বাস—তাই বিনয়ের মধ্যে একটা কুণ্ঠা কাজ করছিল। এ কোথায় নিয়ে এসে ফেলল মাকে? বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে কি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল? মাইনেটা একটু বেশি হবার পর বছরখানেক পরেও তো ভাড়া বাড়িতে উঠে যেতে পারত। তারা নয় আরও একটা বছর ফড়েপুকুরে থাকত। কর্তাবাবু কত্তামা কি তাতে রাজি হতেন না? হ্যাঁ, তাতে মাকে আরও একটা বছর রাঁধুনির কাজ করতে হত!! কিন্তু ফড়েপুকুরের গুহবাড়িতে এর থেকে অনেক ভদ্র পরিবেশ ছিল, অনেক আব্রু ছিল সেখানে। প্রথম রাত্রিটা ঘুমোতে পারে না বিনয়। এত বড় ভুল করে বসল শুরুতেই?
নাঃ! কালই আপিস ফেরতা যেতে হবে ফড়েপুকুরের গুহবাড়িতে।
পাশ ফিরতে গিয়ে দেখে মা-ও ঘুমোয়নি। বিনু জেগে দেখে, বসুন্ধরা তার মাথায় হাত রেখে বললেন—
একটা কথা বলি বিনু!
ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে বিনয়কান্তি৷ মা-ও কি ফড়েপুকুরে ফেরার কথা ভাবছে?
মায়ের মন। তিনি তো ছেলের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছেন।
আমার কষ্টের কথা ভাবছিস বিনু। তোর কাকা নৌকাডুবিতে মারা যাওয়ায় চারদিনের মাথায় শ্রাদ্ধের কাজ সেরে ফেলতে হল। দুপুরে শ্রাদ্ধের কাজ শেষ করে সেইদিন মাঝরাতে তোর বাবা দেশান্তরি হলেন—তারপর থেকে তো কোনওদিন নিজেদের বাড়িতে থাকিনি। বিয়ের পর বাবার কোটালীপাড়ার বাড়ি তো আমার ছিল না। সে ছিল আমার বাপের বাড়ি। আমার ভাইদের বাড়ি। হ্যাঁ বাবা চলে যাবার পর বাখুন্ডা ফিরে মাত্র দিনকতক আমার স্বামীর ভিটেতে বাস করেছি বটে—কিন্তু ওখানে নাবালক ছেলে নিয়ে আমি টিকতে পারতুম না। তাই সব বেচেবুচে রান্নার কাজ নিয়ে বাখুন্ডায় গুহবাড়িতে আশ্রয় নিলুম। ভবিষ্যতের সম্বল বলতে ওই ভিটেবেচা সামান্য ক’টা টাকা।
বাড়ির মালিক গোপালকৃষ্ণ ঘোষ—কপালে তিলককাটা—গলায় কণ্ঠী। আধবোজা চোখ। মুখে সর্বদা হরিনাম। ডানহাতের কবজিতে হরিনামের মালা রাখার গেরুয়া রঙের কাপড়ের ছোট্ট ঝুলি—ভাড়ার টাকা হাতে নেন না। উঠতে বসতে হরি হরি করছেন। টাকা মেঝেতে দিলে বাম হাতে তুলে ক্যাশবাক্সে রাখেন—কিন্তু জগদীশ্বরের প্রকৃত ভক্তের ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রমাণ দেখাতে এত লোকদেখানো আচারবিচার লাগে না।
ফড়েপুকুরে কর্তাবাবুকে রাতে শোবার আগে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত পড়ে শোনাতে হত। বিদ্যাসাগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরে রিপন কলেজের অধ্যাপক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বিশেষ পণ্ডিত মানুষ। এজন্য শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীতে তাঁকে মাস্টারমশাই বলা হত। শ্রীরামকৃষ্ণদেবও তাঁকে মাস্টার, মহেন্দ্র মাস্টার বলে ডাকতেন। পরে সারদা মায়ের আদেশে ‘শ্রীম’ ছদ্মনামে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন নিয়ে প্রথমে ইংরেজিতে পরে বাংলায় কথামৃত রচনা করেন। কিছুটা শুনতে শুনতেই কত্তাবাবুর ঘুম এসে যেত। লেখকের বিস্তৃত পরিচিতিও খুঁটিয়ে পড়ে ফেলত বিনয়। কথামৃত পড়েই প্রকৃত ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে বিনয়কান্তির ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। রোজ রাতে পড়তে পড়তে একটা সময় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
ভক্তির উপায় পরিচ্ছেদে শ্রীম জানতে চাইলেন—ঈশ্বরে কী করে মন হয়? —চলবে
ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি
মাঝরাতে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল—জানলা দিয়ে শেষ রাতের চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। বিনয় আবিষ্কার করল, তার মা খাটের নীচে তোরঙ্গ টেনে বের করেছে। তোরঙ্গের ভেতর থেকে বিয়ের সময়ের কনের মাথায় দেওয়ার লাল ভেল-সিঁদুর চুপড়ি বের করে—সেগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদছে বসুন্ধরা। কিন্তু কেন?
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com