শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

।।কীরা কাকিমা।।

সেদিন আমার কলেজ ছিল না। সবে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফার্স্ট ইয়ার। আমি মায়ের ঘরে রাখা সেই গ্রে স্ট্রিটের কেদার পালের শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া আদি-অকৃত্রিম গোলাপ-তোড়া ডিজাইনের পালঙ্কের হেডবোর্ডে পা তুলে দিয়ে সিলিংমুখো হয়ে বিছানায় শুয়ে। অরণ্যদেব আর করোটিগুহার জমজমাট কমিকস পড়ছি—মা বলল, সু!

চিনুদাদা ঠিক ক্যারামের স্ট্রাইকার রিবাউন্ড করিয়ে ঘুঁটি ফেলার মতো আমায় টার্গেট করল। আর ক্যারামের তেকোণা পকেটের জালে টুপ করে পড়া দলছুট ঘুঁটির মতো বেজার মুখ করে কমিকস নিয়ে ঘর ছেড়ে গেলাম। খানিক পরে দেখলাম একটু আগে মুখ শুকিয়ে ঘরে আসা চিনুদাদা ম্যানেজমেন্টের কাছে দাবিদাওয়া আদায়ের পর ইউনিয়ন লিডারের মতো ঝকঝকে বিজয়ীর হাসি নিয়ে আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাবা তখন লাইব্রেরি ঘরে লিখছেন। শার্লক হোমসের মতো যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বাবার জন্যে বরাদ্ধ পরের কফিটা মা নিজে বানিয়ে নিয়ে গেলেন। কফি খাওয়ার ব্যাপারে বাবা এক্কেবারে সাহেব ছিল না। ভাতে মাছে দই-রাবড়ির বাঙালি। কনডেন্স মিল্ক দিয়ে করা কড়া ইনস্ট্যান্ট কফি। তাতে অল্প চিনি দিতেই হবে। বাবা প্রায়ই বলতো মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়! এই ‘মৌতাত আর মেজাজ’ এরাই আসল সৃষ্টিকর্তা আমি খাজাঞ্চির মতো হিসেব রাখি। মধু কমে গেলে বাড়াই, বেড়ে গেলে কমাই। কিছু মেজাজটা চটকে গেলে সব শেষ।’
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৫: “এই যে যন্ত্র দেখছিস, এটা সেগুন কাঠের, এখান থেকেই সুর আসে…”

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

আসলে ১৯৭২-এ সলিল দত্তের বিখ্যাত বাংলা ছবি ‘স্ত্রী’ রিলিজ করেছিল। বিমল মিত্রের উপন্যাস। জমিদার মাধব দত্তের ভূমিকায় উত্তমকুমার আর আশ্রিত সীতাপতির চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের’র দারুণ অ্যাক্টিং ছিল। আমি সেটা পরে দেখেছি। কিন্তু বাবার ঘরে রেডিওগ্রামে গমগম করে মান্না দে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডের গানগুলো বাজত। বাংলার আরেক কিংবদন্তি গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ও স্ত্রী ছায়াছবির জন্যে গান লিখেছিলেন। কিন্তু ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’ গানে বাংলার অন্যতম সেরা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন সেই আইকনিক লাইন। ‘মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়।’ তারপর থেকে মানে এই ছবিটা দেখে আসার পর থেকেই বাবা গানের এই লাইনটা খুব বলতো।
আমি তখন অনেক ছোট হলেও পরিষ্কার মনে আছে ৭২ সালে বছরের প্রথম দিন পয়লা জানুয়ারি, শনিবারে এই ছবির রিলিজ করেছিল। বাবা মাকে উত্তমকুমার নিজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন ছবি দেখতে যাওয়ার জন্য।

যাই হোক, সেই মেজাজটা ধরে রাখার জন্যেই মা নিজে কফি নিয়ে গিয়েছিল নাকি অন্য কোনও কারণে সেটা পরে জানতে পেরেছিলাম। কে বা কারা শুনছে সেটা খেয়াল না করেই বাবা হইহই করে লাইব্রেরি ঘর থেকে বেরোতে বেরোতেই বললেন, আমি বলেছিলাম অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। এখন দেখলে তো। আর এও বলেছিলাম হাজরা ল কলেজে পড়ে অর্ধেক পলিটিশিয়ান হয়ে গিয়েছে। না হলে বউঠানকে কিছু না বলে প্রথমেই কাকিমাকে এসে ম্যানেজ করে। এতো গুরু কন্যাকে প্রেমবিবাহের প্রস্তাব— মডার্ন কচ ও দেবযানী। বলি শুক্রাচার্য কি জানে না জানেন না?
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

ব্যাপারটা হল কিশোর বয়স থেকেই সরোদের শিক্ষাগুরু পণ্ডিত দেবপ্রসাদ বসুর বড় মেয়ে সুপ্রিয়ার সঙ্গে চিনুদাদার গভীর প্রেম। আর সরোদ নয় সুপ্রিয়া বউদির জন্যেই চিনুদাদা সরোদ ক্লাস মিস করত না। তবে সুপ্রিয়া বৌদি ভীষণ ভালো। ওকে দেখে কেউ অপছন্দ করতে পারবেই না। বড়জেঠিমারও পছন্দ হল আর পণ্ডিত দেবপ্রসাদ বসু বসুন্ধরা ভিলায় আত্মীয়তা করতে আপত্তি করেননি। ধুমধাম করে চিনুদাদা আর সুপ্রিয়া বৌদির বিয়ে হয়ে গেল। বড় ঠাম্মি থাকতে থাকতেই বড়নাতির বড় ছেলে মানে পুতির বিয়ে দেখে গেলেন। তখন বিয়েতে কবিতা লেখা সেকেলে হয়ে গেলেও বাবা ছড়া লিখেছিলেন।

চিনোবাবু বর
সরোদ নিতবর
সুপ্রিয়াকে করল বিয়ে
কোঁচাটি দুলিয়ে।
সুরে তারে প্রেম
দীর্ঘকালের গেম
বড়ঠাম্মি খুশি হল
তাঁর পুতিরও বউ এল
আজকে বউভাত
বর-কনেকে দুহাত তুলে
করো আশীর্বাদ।।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৮: মাতৃভাষায় লিঙ্গ বৈষম্য-বিরোধ জবানি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

চিনুদাদার বিয়েটা খুব এঞ্জয় করেছিলাম। বিয়ের পরে ওরা শিমলাতে হনিমুন সেরে এল। বিয়ে হয়ে যাবার পরও চিনুদাদাকে নিয়ে বাবার ঠাট্টা, ইয়ার্কি বন্ধ হয়নি। বলত—
কি মাতৃভক্ত ছেলে তোমার বৌঠান! মা সরোদ শিখতে পাঠাল নিজে বাজনাটা ম্যানেজ করতে না পেরে আস্ত একটা সরোদিয়া বউ নিয়ে এনে হাজির করল!
মা সামলাত।

আঃ এখন ছেলেটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর নতুন বউটাই বা কি ভাববে?

কী আবার ভাববে? ভাববে এই গোমড়ামুখো কলমচি বাংলায় থাকলেও হুঁকোমুখো হ্যাংলা নয়। হাসি-মস্করা করতে জানে। আর সুপ্রিয়ার সরোদের হাত খুব মিষ্টি। আমাদের সুপ্রিয়া হল বসুন্ধরা ভিলার আগামী বিজয়া সম্মেলনীর নবতম সংযোজন।

বাবার জন্যেই বৌদিকে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যেবেলায় বসুন্ধরা ভিলার পেল্লায় ছাতে সরোদ নিয়ে বসতে হতো। শতরঞ্চি ফরাস পেতে আমরা নতুন বৌদিকে ঘিরে সবাই বসেছি। বৌদি পূরবী বা দেশ রাগের আলাপ বাজাচ্ছে। বাবার কথার রেশ ধরেই রাগের নাম বা বাজনার ধীর কিংবা দ্রুতলয়ের ব্যাপারটা তখন জেনে গিয়েছি। বাবা ছাতের আলো জ্বালাতে মানা করত। চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে অন্ধকার ছাতে। আশেপাশের স্কাইস্ক্র্যাপারে ধাক্কা খেয়ে ছাতে উথাল-পাথাল হাওয়া। বৌদির আঙ্গুলের ছোঁয়ায় সরোদে সন্ধ্যা রাগের মূর্ছনা। একেবারে অন্যরকমের স্মৃতি।

কীরা কাকিমার সঙ্গে মা’র নিয়মিত চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। প্রতি বছর বিজয়ার পর একাদশীর দিন কীরা কাকিমার ট্রাঙ্ককল আসত। আমরা বুঝতে পারতাম। ফোনটা মা নিজে রিসিভ করত।

ও-প্রান্ত থেকে থেমে থেমে কীরা কাকিমা সাবধানে বলত—
“দিদি! সুবো বিজায়া। প্র’-নাম বালোবাসা।”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

বছরের আরেকদিন নিয়ম করে প্রায় মাঝরাতে বারোটায় কাঁটা ছোঁবার আগে ফোন বাজত। সে ফোনটাও মা ধরতো। ১৮ জুন। মায়ের জন্মদিন। মা- কীরা কাকিমাকে ৫ মার্চ কাকিমার জন্মদিনে আর ক্রিসমাসে ফোন করত। আমার আর সানন্দার জন্মদিনে প্রতিবার সুন্দর সুন্দর কার্ড পাঠাত কীরা কাকিমা। পরের দিকে বাবার ছোট গল্পের সংকলনের ইংরিজি অনুবাদ করেছিল দিল্লির এক প্রকাশনা সংস্থা। তাদের লন্ডনে অফিস ছিল। বাবার অনুরোধে তারাই কীরা কাকিমার ঠিকানায় এক এক করে বাবার গল্পের তিন খণ্ডের ইংরেজি সংস্করণ পাঠিয়ে দিত।

আমার বড় অদ্ভুত লাগত। একটা মানুষের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে। পুরো পরিবারের সঙ্গে না হলেও দাদা-বৌদি’র সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগটুকুও রয়েছে। এতকিছু থাকলেও বৈবাহিক যোগাযোগটুকু থাকল না কেন? আমার ঠাম্মির সঙ্গে বাবার যেমন খুব সহজে সম্পর্ক ছিল। আমার সঙ্গে আমার মায়ের সম্পর্কটাও তেমন। তাই আমার এই ক্রমাগত খটকা’টা বসুন্ধরা ভিলার সবুজ লনে হাঁটতে হাঁটতে একদিন মার কাছে বলেই ফেললাম। মা খানিক চুপ করে রইল। তারপর ধীর পায়ে আমাদের লনের অনেক পুরনো একটা নিমগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালো।

মানুষের মন বড় বিচিত্র সু। সবসময় সব হিসেব মেলানোর মতো সরলরেখায় জোড়া যায় না। ফুলঠাকুরপো বা কীরা দু’জনেই আলাদা আলাদাভাবে খুব ভালো মানুষ। কিন্তু তারা দুজনেই দু’জনের কাছে একে অপরের পরিপূরক নয়। তারা ভেবেছিল তাদের জীবন বোধহয় একে অপরের সঙ্গে মিলবে। কিন্তু কাছাকাছি থেকেও সেটা মেলেনি। আমার কাছে পাঠানো অসংখ্য চিঠি পড়ে আমার মনে হয়েছে দু’জনের ব্যক্তিত্ব ওদের দুজনকে কাছাকাছি আসতে দেয় না। কিন্তু দূর থেকে ওরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। কাছে এলে দুজনেই হয়তো একটা অদ্ভুত বদ্ধতা অনুভব করে। ইংরেজিতে যাকে ক্লস্টোফোবিক ফিলিং বলে।—চলবে

ছবি: প্রতীকী।

ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৭

“এই যে যন্ত্র দেখছিস, এটা সেগুন কাঠের। এই যে মুগুরের মতো অংশটা, এটা ফাঁপা। এখান থেকে আওয়াজ আসে। এটাকে সাউণ্ড বোর্ড বলে, এটা টান করে পাতলা ছাগলের চামড়া দিয়ে ছাওয়া। মনে থাকবে, আর ভুল হবে না?’ বুঝতে পারছি চিনুদাদা গুরু দেবপ্রসাদ বসু বা তার কোন সিনিয়র ছাত্রের ক্লাস নেওয়ার ধরনকে কপি করছে।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content