শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


কেকে’র নেশা শ্যামবাজারের নাটক আর ময়দানের ফুটবল। ছবি: সংগৃহীত।

।।অন্দর মহলের কথা।।

খেলাধুলোয় সেভাবে নাম করতে না পারলেও বসুন্ধরা ভিলার চূড়ান্ত খেলা পাগল মানুষটির নাম কে কে। কমলকান্তি। আমাদের প্রিয় ছোটকা। আজ্ঞে হ্যাঁ! সদ্যপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নথের জন্মের ২২ বছর আগে ৪৬-র দাঙ্গার আশেপাশে ছোটকা কমলকান্তির জন্ম। আর কুড়ি বাইশ বছর থেকেই বন্ধুমহলে ছোটকা কে কে নামে পরিচিত হয়ে গেলেন। আসরের ছোটকা ছিল খুব ভালো সংগঠক। আজকের ভাষায় ইভেন্ট ম্যানেজার। কমলকান্তির বহুমুখী প্রতিভা। ছোটকা ফুটবল ক্রিকেট খেলত। ক্রীড়ামহলে পরিচিত ছিল। অন্তত গোটা দশেক ক্লাবের কমিটি মেম্বার। সেখানে ক্রিকেট ফুটবলের সঙ্গে সাঁতার টেবিল টেনিস ব্যাডমিন্টন ছিল। ছোটকা গান ভালোবাসত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। নিজে একটু আধটু সেতার বাজাতে পারত। এছাড়াও একটা সখের নাটকের দলও ছিল ছোটকা ও তার বন্ধুদের। কিন্তু একসঙ্গে এতকিছু করার জন্যে কোন একটা বিষয়ে সঠিক সময় দিতে পারেনি কমলকান্তি। আর এত ব্যস্ততার মধ্যে পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক করা হয়নি। পাশকোর্সে বিকম পাশ করেছিলেন।

সেসময় ফুটবলে স্পনসর্শিপ ছিল না। ক্লাবের সদস্যপদ ও ক্লাবের প্যাট্রন বা পৃষ্ঠপোষকরা ক্লাব চালাতেন। তখন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান স্পোর্টিং-এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কয়েকটি ছোট ফুটবল ক্লাব উদ্দীপিত ফুটবল খেলত এবং প্রায়শই অঘটন ঘটিয়ে দিত। এরিয়ান, রাজস্থান, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, কালীঘাট ক্লাব, খিদিরপুর স্পোর্টিং, বিএনআর, টালিগঞ্জ অগ্রগামী, ভ্রাতৃসংঘ, ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট, জর্জ টেলিগ্রাফ, কুমারটুলি…এই দলগুলো আর কিছু ফুটবল কোচ অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরাজ ঘোষ, সাত্তার, অরুণ ঘোষ, নিখিল নন্দীর মতো আর অনেকে তথাকথিত বড়দল, তাদের কর্মকর্তা আর সেইসব দলের স্টার কোচদের রাতের ঘুম কেড়ে নিত।

কুমারটুলি দলে আমার ছোটকা ‘কে কে’ ছিলেন অন্যতম বিশিষ্ট কর্মকর্তা। বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে নানান আর্থিক সাহায্য জোগাড় করা, বিজ্ঞাপন জোগাড় করা এসবে সিদ্ধ ছিলেন ছোটকা। অনেক সময় বাবাও তার চেনাপরিচিত অনেককে চিঠি লিখে ছোটকাকে মানে ছোটকার ক্লাবকে সাহায্য করেছে।

দেশ স্বাধীন হবার পর ঠাম্মি নাকি বাবাকে একটা খুব গোপন কথা বলেছিল। দাদু মানে বিনয়কান্তি দত্ত গোপনে নেতাজি সুভাষের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা বিভি-তে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। সেটা গ্রে স্ট্রিটে থাকার সময়। তখনও মালিক নন বিনয়কান্তি। সামান্য অংশীদার মাত্র। তখনই একটা মহান কর্তব্য পালন করেছিলেন দাদু। স্বাধীনতার সংগ্রামে তাঁর মতো করে যোগদান করেছিলেন।

এক সময় উত্তর কলকাতার পেশাদারী মঞ্চে জনপ্রিয় বাঙলা নাটকের রমরমা ছিল। নামী-দামী চিত্র-মঞ্চখ্যাত শিল্পীদের অভিনয় দেখতে প্রতি বৃহস্পতি সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা শনি-রবি ও ছুটির দিন তিনটে ও সাড়ে ছ’টায় আম-বাঙালির ভিড় উপচে পড়ত। কলকাতার স্টার থিয়েটার রংমহল, মিনার্ভা থিয়েটার, বিশ্বরূপা, রঙ্গনা বা কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে সে সময় বিকাশ রায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন দিলীপ রায় অনুপ কুমার প্রেমাংশু বসু, তরুণ কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, বঙ্কিম ঘোষ, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষের মতো নামী শিল্পীরা অভিনয় করতেন। তার আগে উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, তুলসী লাহিড়ী, জহর গাঙ্গুলি, সরযুবালা, শিশিরকুমার অহীন্দ্র চৌধুরীও পেশাদার মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। একই সঙ্গে সিনেমার আউটডোর বা ইনডোর শুটিং সামলে উত্তর কলকাতার পেশাদার মঞ্চে ছুটতেন শিল্পীরা। এই নামী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছাড়াও টিকিট কাউন্টার থেকে মঞ্চের পেছনে নানান কর্মীরা সেট মেকআপ ড্রেসার আলো বা শব্দ প্রক্ষেপণের লোকেরা আর একঝাঁক অচেনা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়মিত রুজিরোজগার ছিল পেশাদার থিয়েটার। এখানে পরিচিতি অনুযায়ী শিল্পীদের বাঁধা মাইনে ছিল।

রীতিমত আইনী চুক্তি করে কাজ করানো হত শিল্পীদের। কখনও হল মালিক নাটক চালাতেন কখনও-বা নাট্যপ্রযোজক হল লিজে নিয়ে নাটক শুরু করতেন। নাটক বেশিদিন চললে নাট্য প্রযোজনার প্রাথমিক লগ্নির টাকা উঠে আসত। প্রযোজক লাভের মুখ দেখতেন। নাটক ভালো চললে কোনও কোনও প্রযোজক হয়ত কর্মীদের সকলকে পারিতোষিক দিতেন। নামী শিল্পীদের সামান্য সুযোগসুবিধে বাড়ত। কোন একটি নাটকে দর্শক আনুকূল্য বাড়লে স্টার শিল্পীদের মাসমাইনে বাড়াতে হতো, নাহলে থিয়েটার ছেড়ে যাবার প্রবণতা দেখা দিত। কিন্তু নামী-দামীরা কেউই মালিকদের চটাতেন না। জনপ্রিয়তা বিক্রির চড়া দাম পাওয়া যেত। তাছাড়া শিল্পীদের মধ্যে তারিফ পাবার একটা ভয়ংকর নেশা জন্মে যায়। তাই শরীরের ছোটখাট অসুখ-বিসুখকে আমল না দিয়ে ক্রমাগত রাতের পর রাত অভিনয় করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তার জায়গায় অন্য শিল্পী অভিনয় করতেন। একটু সুস্থ হয়ে আবার মঞ্চে ফিরতেন পুরোনো শিল্পী।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৫১: বসুন্ধরা এবং…

কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-৭: একানড়ে ফিসফিস করে ছড়া কাটছে—পোঁড়া গাঁছের বেঁল, দাঁঠাকুরের খেঁল, গঁরিব চাঁষার…

ফুটবল খেলার টানটান ৯০ মিনিটের উত্তেজনার মতো নাটকেও একটা উত্তেজনা থাকত। মঞ্চে থাকার সময়টুকুর উত্তেজনা। কোন এক বিশেষ দৃশ্যের অভিনয় আলো ও শব্দ মিলেমিশে গড়ে ওঠা কয়েকমূহুর্তের কোনও ম্যাজিক। বা কোন বিশেষ সংলাপে হাসি বা কান্নায় দর্শকের স্বতস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। দিনের পর দিন, শো-এর পর শো একই ভাবে ইউফোরিয়া সৃষ্টি করত শিল্পী কলাকুশলী বা প্রযোজক পরিচালকের মনে। যা সব মান-অভিমান অসুবিধে কষ্ট ক্ষোভ মিটিয়ে দেয়। তাই পারফর্মিং আর্টে পারিশ্রমিকের সঙ্গে সঙ্গে এই এনার্জি টনিকও দরকার।

কিন্তু মঞ্চের ঝকঝকে আলোয় ঝলমলে পোশাক আর চড়া মেকআপের আড়ালে লুকোনো থাকত জীবনের ঘন অন্ধকার। নাটকের ব্যবসায় গিয়ে ‘কেকে’ তেমনি এক অন্ধকারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছিলেন।

৬৭-তে ফুলকাকা ডাক্তার বিমলকান্তি দেশ ছেড়ে যাবার আগে আমার ঠাম্মি স্বর্ণময়ী ঠিক করেছিলেন ছেলের বিয়ে দিয়ে পাঠাবেন। আর তাই দিল্লির কর্নেল শুকদেব বসু রায়ের আধুনিকা মেয়ে সুজাতার সঙ্গে ফুলকাকার সম্বন্ধ করেছিলেন। ভেবেছিলেন বেশ কইয়ে-বলিয়ে স্মার্ট, ভালো চেহারা, ইংরেজি ভালো বলতে পারে। ইংরেজি গান জানা এমন পাত্রী সহজেই বিলেতে মানিয়ে নেবে। সুতরাং ছেলের মতামত না নিয়েই ঠাম্মি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। সম্বন্ধটা আবার ঠাম্মির মেজদিদি সুলক্ষণার সূত্রে পাওয়া। ঠাম্মির মেজদিদি-জামাইবাবু আর কর্ণেল বসু রায়রা একই গুরুর শিষ্যশিষ্যা। দুই পরিবারের বাসস্থান দিল্লি আর বোম্বে হলেও গুরুদেব তাদের যোগাযোগের সূত্র। ফুলকাকার সঙ্গে পাত্রীর বয়েসের ফারাক বেশি না হলেও গুরুদেব পাত্র-পাত্রীর জন্মছক দেখে বলেছেন এরা রাজযোটক হবে। বিয়ের মাসখানেক আগে দিল্লি থেকে শুকদেব বসু রায় এবং তার পরিবার যখন কলকাতায় তাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বাড়িতে এসে উঠেছেন। তখন সব জেনে ফুলকাকা এককথায় বিয়ে নাকচ করে দিল। স্বর্ণময়ীকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল সে বিদেশে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে সুতরাং সে মুহূর্তে বিয়ে করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ঠাম্মি পড়লেন মহাবিপদে। একে এর মধ্যে তার নিজের মেজদিদি-জামাইবাবু জড়িয়ে রয়েছে। তার ওপর পাত্রীপক্ষ কলকাতায় এসে উপস্থিত। তারা অবশ্য পাত্রকে চোখে দেখেনি কিন্তু শুনেছে পাত্র ডাক্তার। সাতপাঁচ না ভেবেই ন’ছেলে তরুণকান্তিকে বললেন সুজাতাকে বিয়ে করার জন্যে। ন’কাকা তরুণকান্তি নির্বিরোধী মানুষ। ব্যবসার কাজের ফাঁকে সময় পেলে নিজের ছবির জগতে ডুবে থাকেন। ন’কাকা বুঝলেন মা খুব বিপদে পড়েই তাকে এই অনুরোধ করছে। তিনি রাজি হলেন। ফুলকাকার যাওয়ার ছিল কিছুদিন পরে। কিন্তু এই বিয়ের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে বিয়ের আগেই কলকাতা ছেড়ে পালালেন।
পরিস্থিতির চাপে বা অনুমানের ভুল থেকে অনেক সময় বিচক্ষণ মানুষও বড়সড় গন্ডগোল করে ফেলেন। যাঁদের কথা বলব তাঁরা দুজনেই আমার ভীষণ শ্রদ্ধেয় এবং অতি বিচক্ষণ মানুষ।একজন এই পরিবারের প্রাণপুরুষ আমার দাদু বিনয়কান্তি দত্ত অন্যজন বসুন্ধরা ভিলার প্রাণপ্রতিমা ঠাম্মি স্বর্ণময়ী। আর বড়ঠাম্মি বসুন্ধরা তো এই গোটা পরিবারের চালিকাশক্তি। বড় ঠাম্মি এই ব্যবসা এই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ির ভিত্তি।

পিটারসন সাহেব বিনয় কান্তিকে বলতেন, exceptional son of an awesome mother!! বিনয় নিজে বলতেন, ‘খুঁজলে বিনয়ের মত ছেলে হয়তো অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু বসুন্ধরার মত মা একটাও পাওয়া যাবে না।’ ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার প্রথাগতভাবে স্কুলে না-পড়া সাধারণ মেয়ের ছিল সাংঘাতিক দূরদর্শিতা। তাই বসুন্ধরা ভিলার শুরুর সময় তার ভাঙন রোধের কথা ভেবে রেখেছিলেন বসুন্ধরা নিজে। বসুন্ধরা এ পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যের সেতু।

বিনয়কান্তি যখন মেয়ে শান্তিলতার সঙ্গে চেতলার মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবোধ সেনগুপ্ত সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন তখন তার মত মানুষেরও অনুমানে ভুল হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন ছেলেটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা উদ্যমী উদ্যোগী পুরুষ। ভুল হয়েছিল। পিসেমশাই উদ্যম দিয়ে নয়, সহজে অর্থ রোজগারের রাস্তা করতে চেয়েছিলেন।

ঠাম্মি স্বর্ণময়ী ভেবেছিলেন ন’ছেলের সঙ্গে সুজাতার বিয়ে দিয়ে তিনি বসুন্ধরা পরিবারকে এক বড় অমর্যাদা থেকে বাঁচিয়েছেন। ভুল ভেবেছিলেন। ফুলকাকা ডাঃ বিমলকান্তির বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল আর ন’ কাকা তরুণকান্তির বিয়েটা প্রথম থেকেই চিড় ধরেছিল। সেই চিড়টা ফাটল হয়েই বাকি জীবন থেকে গেল। ফুলকাকা আর ন-কাকীমা সুজাতা পরস্পরকে আজীবন এড়িয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২: প্রসঙ্গ ছত্তিসগড়

হেলদি ডায়েট: আপেল খেতে ভালোবাসেন? পুষ্টিগুণ বেশি পেতে দিনের কোন সময়ে খেতে হবে জানেন?

বসুন্ধরা ভিলা তৈরি হবার পর চারতলায় বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে বাস্তুশাস্ত্র মেনে বড় ঠাকুরঘর বানানো হয়েছিল। ঠাকুরঘরে এক মানুষ উঁচু একটা প্রকান্ড ফোটোফ্রেমে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছবি লাগানো হয়েছিল। বসুন্ধরার চেহারা ভারী নয়, বয়স বাড়লেও পরিশ্রম কমাননি। বাড়িতে অনেক কাজের লোক থাকলেও নিজের কাজ নিজেই করতেন। প্রথমদিকে সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় গিয়ে পুজোপাঠ সারতেন। কিন্তু শরীর হালকা হলেও বয়স বাড়ার কারণেই চারতলায় উঠতে সময় লাগত। বিনয়কান্তি ঠিক করলেন বাড়িতে লিফট বসাবেন। কিন্তু বাড়ি তৈরির সময় লিফটের পরিকল্পনা ছিল না। বিনয়ের বিশিষ্ট বন্ধুর লিফট কোম্পানির লোকজন এসে সিঁড়ি বরাবর লিফট বসানোর ব্যবস্থা করল। ততদিন চারতলার উপরের ঠাকুরঘরের ঠিক নিচে একতলার একটা ঘর ঠাকুরঘর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হল। বসুন্ধরা ভিলায় লিফট বসল ১৯৬০ সালের শেষে বসুন্ধরার বয়েস তখন ৭০।

বসুন্ধরা ভিলায় সুখ ছিল স্বাচ্ছন্দ্য ছিল সেই সঙ্গে দানা বাঁধছিল স্বার্থ। তরুণকান্তির স্ত্রী সুজাতার স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমশ বাড়ছিল। মায়ের সবটুকু বদগুণ নিয়ে ক্রমশ দুর্বিনীত উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছিল তরুণকান্তি ও সুজাতার একমাত্র সন্তান প্রণয়কান্তি দত্ত। সুজাতার ধারণা স্বর্ণময়ী এবং বসুন্ধরা ভিলার গোটা পরিবার তাকে এবং তাদের পরিবারকে ঠকিয়েছে। বলা হয়েছিল পাত্র ডাক্তার এবং ইংল্যান্ডে থাকে। অথচ বিয়ে দেওয়া হয়েছে তার দাদার সঙ্গে এবং সেটা জানানো হয়েছে বিয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে। যখন সুজাতার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এসে গিয়েছে বিয়ের সব জোগাড় হয়ে গেছে তখন। সেই ক্ষোভ সেই রাগ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সুজাতা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তরুণকান্তি সরাসরি ব্যবসায় যুক্ত নয়। স্বাভাবিকভাবে প্রণয়ের ধারণা তাই তার ততটা গুরুত্ব নেই। আসলে গুরুত্ব পাবার মত বিশেষত্বের অভাব ছিল প্রণয়ের। যেটা ছিল সেটা অসংযমী স্বভাব, তীব্র হিংসা, আর হীনমন্যতার জ্বালা। দাদু বিনয় কান্তি দত্ত বা পরে বড়জেঠামণি গগনকান্তি বা মেজ্জাঠামণি বিকাশকান্তি যোগ্য বলেই আমাদের পিসতুতো ভাই গৌরবকে বসুন্ধরা গ্রুপের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর করেছিলেন। আর এখানেই সুজাতা এবং প্রণয়কান্তির মূল আপত্তি। দত্তদের পারিবারিক ব্যবসায় সেনগুপ্ত এসে ছড়ি ঘোরাবে কেন? প্রণয়ের বউ বাবলি খুব ভাল মেয়ে । বোধহয় প্রজাপতির অন্যমনস্কতায় ওদের বিবাহ নির্ঘণ্ট স্থির হয়েছিল।

প্রথমদিকে বিকাশকান্তি ফাইন্যান্স দেখতেন। ক্রমে ব্যবসা এত বড় হয়ে গেল। বয়সজনিত কারণেও তিনি একা সামলাতে পারতেন না। গৌরব আমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোট। ভীষণ কর্মঠ আর নির্ভরযোগ্য। একেবারে শাণিত ইস্পাতের মতো। ওর বউ আভেরি গুজরাটি। দুজনেই লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিকস থেকে পড়াশোনা করেছে। সেখানে আলাপ বোম্বেতে বিয়ে। লন্ডনেই ফিরে যাবার কথা ছিল। দাদুর অনুরোধে থেকে গেল। ওদের সন্তান আসার আগে আভেরিও অফিস করত। এখন আর করে না।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৮: মাছের ডিম বার্ধক্যের ছাপ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়! মাছের ডিমের এই অবাক করা গুণের কথা জানতেন?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২: গণমাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য এবং রাজনীতি

গৌরবের বড়দা সৌরভও ভালো ছাত্র ছিল। চেতলা বয়েজে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর যোধপুর পার্ক বয়েজে ভর্তি করানো হল। অথচ এতো আওতার মধ্যে বড় হয়ে ক্লাস টেনের ছাত্র উগ্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। সে এক অন্য অধ্যায়।

‘৬৫ সালে বিনয় কান্তি কলকাতার শেরিফ নির্বাচিত হলেন। ভারতে একমাত্র মুম্বই এবং কলকাতায় এই অরাজনৈতিক উপাধিমূলক পদটি রয়েছে। সম্মানের হিসেবে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র বা মহানাগরিক-এর ঠিক পরেই শেরিফের গুরুত্ব। কলকাতার কোনও এক বিশিষ্ট নাগরিককে এক বছরের জন্য এই পদে নির্বাচিত করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টে শেরিফের একটি অফিস থাকে। নিজস্ব কর্মী থাকে কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতা থাকে না। ১৭৭৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ রয়েল চার্টার প্রকাশ করে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনা করলেন। এই দলিলে বলা হল ইংল্যান্ডের হাই শেরিফের মতোই সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচিত তিনজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে থেকে একজনকে গভর্নর জেনারেল এদেশে নির্দিষ্ট শহরের শেরিফ নির্বাচিত করবেন। শুরুর সময়ে শেরিফের আইনি ক্ষমতা ছিল ধীরে ধীরে সে ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। স্বাধীনতার পর শেরিফ শহরের বিভিন্ন কার্যাবলী ও সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকারের বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা করেন। ১৮৭৩ সালে প্রথম ভারতীয় শেরিফ ছিলেন মানেকজি রুস্তমজি। ‘৭৪ এ প্রথম বাঙালি শেরিফ হলেন হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও -এর অন্যতম শিষ্য রাজা দিগম্বর মিত্র।

কিছুদিন বাদে কলকাতার একটি নামী চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন বিনয় কান্তি দত্ত। বিনয়ের আগে সেই চেয়ারে বিদেশিরাই বসেছেন। বিনয়ই প্রথম দেশীয় সভাপতি। চারতলা ঠাকুর ঘরে তখন দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন বসুন্ধরা। ঈশ্বরের অসীম কৃপা ও করুণায় কৃতজ্ঞ বসুন্ধরার দুচোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে যেত।

বসুন্ধরা ভিলা সংযুক্ত নানান চরিত্রকে জড়িয়ে আছে নানান গল্প তাতে সাফল্য ব্যর্থতা মনুষ্যত্বের উত্থান অবনমন প্রেম পরকীয়া ষড়যন্ত্র সব মানবিক প্রকৃতি-বিকৃতির অস্তিত্ব রয়েছে। বিনয়কান্তি শুরু করেছিলেন পথ থেকে। শেষ করেছেন প্রাসাদে। তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চালিকা শক্তি ছিল তার মা। বিনয়ের জেদ আত্মবিশ্বাস। বড় হবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অদম্য ইচ্ছে। কিন্তু পরের প্রজন্মর চাহিদা কিছু ছিল না সবকিছু পাওয়া হয়ে গিয়েছে তা তাই আরও পাওয়ার লোভ তাদের কাউকে কাউকে নীতিচ্যুত করে দিয়েছিল।

এই নিঃশব্দ পারিবারিক অবক্ষয় বসুন্ধরার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল বসুন্ধরা ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিলেন। কষ্ট বিনয়ের জন্য কষ্ট তাঁর উত্তরাধিকারের জন্যে … ১৯৮২ সালের এক ঝড়জলের রাতে ঠাকুরঘরে ঠাকুরের শয়নারতি করছিল স্বর্ণময়ী বসুন্ধরা পিছনে বসে আরতি দেখছিলেন। প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল খুব কাছাকাছি আচমকা শব্দে স্বর্ণময়ীর হাত থেকে প্রদীপ চলকে পড়ল মেঝেতে। অমঙ্গলের আশংকায় বসুন্ধরার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলেন অমঙ্গল ঘটে গেছে। ঠাকুর ঘরের মেঝেতেই ঢলে পড়েছেন বসুন্ধরা। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেই রাতেই শহরের নামী-দামী ডাক্তারেরা ছুটে এল। বসুন্ধরা সময় দেননি। ৯২ বছরে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন তাঁর স্বামীর কাছে।

শেষ হল একটি অধ্যায়। শেষ হল একটি যুগ। আগামীতে কোন পথে এগোবে বসুন্ধরা ভিলা?—চলবে

বসুন্ধরাই এই পরিবারের এক যোগসূত্র।

চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি
 

পরের পর্ব আগামী রবিবার

এরপর?
শুরু হতে চলেছে ‘বসুন্ধরা এবং…’-এর ২য় খণ্ড। দুই বাংলার পটভূমিকা, এক শতকেরও বেশি সময়ের প্রেক্ষাপট, শুরু হবে এই মহা-উপন্যাসের আধুনিক অধ্যায়। আগামী ২২শে জানুয়ারি ২০২৩ থেকে প্রতি রবিবার।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content