শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


।। চিন্ময় ও সুপ্রিয়া ।।

গগনকান্তি মানে আমার বড় জ্যাঠামণির বড় ছেলে চিনু দাদা ওকালতি নিয়ে পড়েছিল। হাইকোর্টের প্র্যাকটিস শুরু করেছিল। বসুন্ধরা ভিলায় চিনুদাদা ছাড়া আইন নিয়ে নাড়াচাড়া কেউ করেনি। কিন্তু বসুন্ধরা গ্রুপের এত ধরনের আইনি কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হতো তাকে যে, বাইরের কেস নেবার সময়ই পেত না চিনু দাদা। কোর্ট চালু থাকলে হাইকোর্টে দিনের বাকি সময়টা বসুন্ধরা গ্রুপের ল ডিপার্টমেন্ট সামলাতে হতো চিন্ময়কান্তিকে। চা বাগান জুটমিল এটা সেটা আইনি ঝামেলা লেগেই থাকত। অথচ আমার বড় জেঠিমা আরতি চিনুদাদাকে শান্তিনিকেতনে কলাভবন বা সংগীত ভবনে পড়াতে চেয়েছিলেন। আর্টিস্ট করতে চেয়েছিলেন।

আসলে তাঁর বাপের বাড়ি মানে বেলেঘাটার মিত্র বাড়িতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের একটা প্রভাব ভীষণভাবে ছিল। কিন্তু চিনুদার শান্তিনিকেতনে পড়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। তবু স্কুল থেকেই চিনুদাদাকে সরোদ শেখাতে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল প্রখ্যাত সরোদবাদক দেবপ্রসাদ বসুর কাছে। কিন্তু এতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া নয়, যন্ত্রসঙ্গীত শিখতে ভয়ংকর ধৈর্য আর অধ্যবসায় লাগে। নিরবিচ্ছিন্ন তালিম লাগে। কথাটা লিখেই খটকা লাগল।
তার মানে গান শিখতে কি ধৈর্য আর অধ্যবসায় লাগে না? আসলে তর্করত্নদের তর্ক করাই নেশা-পেশা ধ্যান-জ্ঞান। তাই তারা তর্কের জাগ-প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে যে কথাটুকুতে বেশ জগঝম্প তর্ক হতে পারে ঠিক ততটুকুই বেছে নেয়। তার আগে পরের কথাটা ইচ্ছে করে খেয়াল করে না। আসলে খুব ভালো গান গাইতে গেলে একইভাবে ধৈর্য অধ্যবসায় নিবিড় তালিম সবই লাগে। কিন্তু প্রথাগত তালিম না থাকলেও রাগ সুর তাল এসব না বুঝে শুধু কানে শুনেও কেউ কেউ চালিয়ে দেবার মতো গাইতে পারেন।

কিন্তু এ ভাবে যন্ত্রে সুর বাজানো যায় না। আর তাই সুরে গাওয়া আর সুরে বাজানোর মধ্যে তফাত অনেকটা। যেমন সুবর্ণের মা খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গান শুনে নয় তিনি রীতিমত বাড়ির কাছে “দক্ষিণী”তে তালিম নিয়ে গানকে ভালোবেসে গানটা শিখেছেন। কিন্তু চিনুদাদা মায়ের ইচ্ছেতেই বাক্স থেকে বের করে ছয় পেগের এই সেগুন কাঠের তার যন্ত্র নাড়াচাড়া করত, টুংটাং করত। আবার বাক্সবন্দি করে তুলে রাখত। কোনওদিন পুরো একটা পিস বাজাতে শুনিনি চিনুদাদাকে।

প্রতি রোববার সকাল সকাল চিনুদা দেবপ্রসাদ বসুর চারু অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে সরোদ শিখতে যেত। দুপুরে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে চিনু দাদা আমাদের মানে ছোট ভাইবোনদের সরোদ নিয়ে এন্তার জ্ঞান দিত। রাগ সুর তাল এসব নিয়ে নয়। সেগুলো তো শিখতে হবে মনে রাখতে হবে। সরোদ নিয়ে গপ্পো কথা শোনাতো। মানে যন্ত্র নিয়ে কথা। তার ইতিহাস। যেগুলো মনে রাখা তেমন কঠিন কিছু নয়। চিনু দাদা বলতে পারে ভালো। ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে বাবা খুব ঠাট্টা মশকরা করতো। আসলে বয়সের বাধা ভেঙে বাবা খুব সহজে মিশে যেতে পারত। তাই বোধহয় এত ভালো লিখত। বলতো চিনোটা এতো ভালো বলতে পারে তাকে বড় বৌঠান জোরজার করে সরোদ শিখতে পাঠালে। ছোটবেলা থেকে উৎসাহ দিলে চিনু একটা নামকরা পলিটিশিয়ান হতে পারত।

বসুন্ধরা ভিলায় বিপ্লবী আছে কিন্তু একটাও পলিটিশিয়ান নেই। এই বিপ্লবী কথাটা আমার পিসতুতো দাদা সৌরভের উদ্দেশ্যে বলা। মা-বাবাকে সামলাত। সৌরভদাকে এসব বললে সে ভীষণ ক্ষেপে যেত তার যথেষ্ট কারণ আছে বলে সে মনে করে। এসব নিয়ে বিস্তারিত পরে বলা যাবে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৪: তেমন কিছুই করি না, সামান্য একটু লেখালেখি করি…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২: এসেছে দৈব পিকনিকে

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ

পরে যখন চিনুদাদা যখন ওকালতি পাশ করে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে যাতায়াত শুরু করল, তখন বাবা বলত যাক পুরো না হলেও হাফ পলিটিশিয়ান হল। ওকালতি আর রাজনীতি পাশাপাশি যায়।

এমনকি মায়ের বারণ না শুনে নিজে সম্পর্কে শ্বশুরমশাই তবু সেসব বাধা-বিধান না মেনেই চিনু দাদার বিয়ে ঠিক হবার পর একটা সাংঘাতিক মশকরা করত। বাবার বলার ভঙ্গি এমন ছিল যাতে সকলেই খুব মজা পেত। কেউ কিছু মনে করতো না। তবে সেটা বলার আগে চিনুদার গল্পটা শেষ করি।

দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া শেষে চিনুদাদা ওর ঘরে বিছানায় সরোদ নিয়ে বসে আর আমরা এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। চিনুদা গম্ভীরভাবে বলে চলেছে তখন সে সব মাথাতেই ঢুকছে না প্রশ্ন করার তো কোনও সুযোগই নেই। মার কাছে শুনেছি সংগীতের পরীক্ষায় হাতে-কলমে গান বাজনা করে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে থিওরিটাও জানা জরুরি। পরে বুঝেছি আসলে এসব বলে বলে চিনুদাদা সরোদ ক্লাসের পড়া মুখস্ত করত।

সরোদ যন্ত্রটা এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে। রবাব নামের তারযন্ত্র বাজাত পারস্য আফগানিস্তানের লোকজন। সরোদের তুলনায় রবাব তীক্ষ্ণ স্বরের। সরোদ নাকি আরও গম্ভীর। ১৮ শতকের মাঝামাঝি ভারতে এই যন্ত্রটি নিয়ে আসেন মোহাম্মদ হাশমি খান বঙ্গাস। তাঁর ছেলে গুলাম আলি বঙ্গাস রবাব থেকে সরোদ বানালেন। সেই প্রথম যুগের সরোদের থেকে আজকের সরোদ অনেক বদলে গিয়েছে। কিছু বুঝলি?

সত্যিই আমাদের দূর্বোধ্য বিষয়। মাথা নাড়ানো দেখে চিনুদাদা বিজ্ঞের মতো হাসত। ভাবখানা এমন এখনও তো শুরুই করিনি। আবার শুরু হল সরোদ জ্ঞান। যন্ত্র দেখিয়ে বলা চালু হল এবার।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৭: কুডার ছুঁয়ে শিরপুর

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭: ঈশ্বরের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিলে তবেই ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?

স্বাদে-আহ্লাদে: সকালে জলখাবারে থাক নতুনত্ব, বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালক পনির পরোটা

এই যে যন্ত্র দেখছিস এটা সেগুন কাঠের। এই যে মুগুরের মতো অংশটা এটা ফাঁপা। এখান থেকে আওয়াজ আসে। এটাকে সাউণ্ড বোর্ড বলে এটা টান করে পাতলা ছাগলের চামড়া দিয়ে ছাওয়া। মনে থাকবে, আর ভুল হবে না? বুঝতে পারছি চিনুদাদা গুরু দেবপ্রসাদ বসু বা তার কোন সিনিয়র ছাত্রের ক্লাস নেওয়ার ধরনকে কপি করছে।

এতে সেতার বা গিটারের মত ফ্রেট বা পর্দা নেই। তাই সরোদ ঠিক পর্দায় বাজানো খুব কঠিন। আবার ফ্রেট নেই বলে মিড়ের কাজ সরোদে খুবই ভালো হয়। এখন মুশকিল হল মিড় কি? খায় না মাথায় দেয় সেটা তো আমরা জানি না।

বিছানায় সরোদ কোলে বসে চিনুদাদা নয়। যেন স্বয়ং গুরুদেব পণ্ডিত দেবপ্রসাদ বসু কথা বলছেন, মিড় হল গড়িয়ে যাওয়া। কচুপাতায় যেমন দাগ না রেখে জল গড়িয়ে যায়, তেমনি সুর যখন কোন রাগের এক স্বর থেকে স্বরে গড়িয়ে যায় তাকে মিড় বলে।

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যখন মাইহার রাজসভায় ছিলেন তখন তিনি আর তাঁর ভাই ওস্তাদ আয়েত আলি খান এই যন্ত্রে তারের সংখ্যায় কিছু বদল আনেন। তাই সরোদে ১৭ থেকে ২৫টা তার ব্যবহার হয়। এটায় দেখ চারটে মেন তার দুটো ড্রোন, দুটো চিকারি। আর নটা সিম্প্যাথেটিক তার। মোট ১৭টা তার। মাথায় এই কাঠের প্যাঁচগুলো তার সুরে বাঁধবার খুঁটি ইংরিজিতে পেগ। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সু্যোগ্য পুত্র ওস্তাদ আলি আকবর খান এই যন্ত্রবাদনে কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন। মাইহারের মতোই গোয়ালিয়র বঙ্গাস ঘরানার উত্তরসূরী হলেন আরেক কিংবদন্তি সরোদশিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলি খান।

এঁদের বাজাবার ধরণ ও ঘরানা আলাদা। বাঁ হাতের আঙ্গুলের ডগা বা নখ দিয়ে স্টিল বা নিকেলের ফিঙ্গার বোর্ডে তার চেপে ধরে ডানহাতে ধরা পুরোনো সিজন্ড নারকেল মালার তিনকোণা প্লেক বা জাভা দিয়ে তারে ঝংকার দিয়ে সরোদ বাজাতে হয়। ব্যস একদিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে। বেশি হলে বদহজম হবে।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৪: জ্ঞানবৃদ্ধ অষ্টাবক্র জনকের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পেলেন?

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩০: গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মনের বাঁক যাবে তো?” ঠাকুর বললেন, “যাবে, ঠিক যাবে”

হেলদি ডায়েট: ডার্ক চকোলেট হার্টের অসুখ-সহ নানা রোগের দাওয়াই, কতটা খাবেন, কেন?

চিনুদাদা যে শুধু গুরুকে কথা বলায় নকল করেছিল তা নয়, শিল্পীদের মতো বড় বড় পণ্ডিত ওস্তাদদের নাম বললেই কানে হাত দেওয়ার পোশাকি ধরণও নকল করেছিল। শুধু বাজনাটাই আর হয়ে উঠল না। মানে ধৈর্যে কুলোলো না। কিন্তু স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বা কোন আত্মীয়স্বজনের বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানে কলকাতার বাইরে যেতে না হলে চিনুদাদা ঝড়-জল-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সরোদের ক্লাসে যাবেই। এক-দু’বার বাদ দিয়ে গুরুজি কলকাতার বাইরে অনুষ্ঠানে গেলেও চিনুদাদা সরোদ ক্লাস বাদ দিত না। গুরুজি কলকাতায় না থাকলে তাঁর ফেভারিট স্টুডেন্টরা ক্লাস নিত। নামী সঙ্গীতজ্ঞ ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এটা চালু নিয়ম।

সবাই বলত চিনুর চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। বাবা শুধু বলত এই অস্বাভাবিক অধ্যবসায় কিন্তু যথেষ্ঠ চিন্তা-উদ্রেককারী। মা রাগ করত কেন বলোতো সারাক্ষণ ছেলেটার পেছনে খুটখুট করছো ?

কিন্তু বাবার অনুমান সত্যি হয়ে গেল। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সবে প্র্যাকটিস শুরু করা চিনুদাদা কাঁচুমাচু মুখ করে একদিন ভর দুপুরবেলা সেজকাকিমা মানে আমার মা সুরঙ্গমার কাছে এসে এদিক ওদিক দেখে বলল, কাকিমা তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। —চলবে
ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/ পর্ব-৬

“মানুষের মন বড় বিচিত্র সু । সবসময় সব হিসেব মেলানোর মতো সরলরেখায় জোড়া যায় না। ফুলঠাকুরপো বা কীরা দু’জনেই আলাদা আলাদাভাবে খুব ভালো মানুষ। কিন্তু তারা দুজনেই দুজনের কাছে একে অপরের পরিপূরক নয়।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content