
বিয়েবাড়ির সাজ।
।।শান্তিলতা।।
পাত্র ম্যাকিনন-ম্যাকেঞ্জি কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট-এর জুনিয়র এক্সিকিউটিভ। মাইনে-কড়ি ভালো। সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারবে। কোম্পানির শিপিং ছাড়াও নানান ব্যবসা। স্ট্র্যান্ড রোডে বিরাট ম্যাকিনন-ম্যাকেঞ্জি বিল্ডিং। বিনয় জানতেন ১৮৪৭ সালে কলকাতার এই কোম্পানির শুরু। স্কটল্যান্ডের উইলিয়াম ম্যাকিনন-এর এই কলকাতাতেই পরিচয় হল স্বদেশেরই উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে। তাঁরাই তৈরি করলেন ম্যাকিনন-ম্যাকেঞ্জি। হালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম ন্যাভিগেশনের সঙ্গে কাজ করে এরা।
১৯৫৫ সালে ধুমধাম করে বিয়ে হল শান্তিলতার। বছর ঘুরতেই শান্তিলতার কোল আলো করে এল বিনয়-স্বর্ণময়ীর প্রথম নাতি। বসুন্ধরার পুতি সৌরভ। তবে সৌরভের জন্মের পর থেকেই বিনয়কান্তি বুঝতে পারত মানুষ চিনতে তার হয়ত একটু ভুল হয়ে গিয়েছে। প্রবোধ ছেলে হিসেবে ভালো। সৎ। কিন্তু সে উদ্যমী নয়। নিজের অবস্থার উন্নতির জন্য সে পরিশ্রম করতে রাজি নয়। সে রোজগারের অনেকটা টাকাই শেয়ার কেনাবেচায় খরচ করে। সংসারের টাকা শেয়ারে চলে যায়। বিনয় এসব নিয়ে স্বর্ণ বা বসুন্ধরা কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তারা দুজনেই শান্তিলতার পাত্র পছন্দের ব্যাপারে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু বিনয়ের সিদ্ধান্ত অটুট ছিল। এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় হয়তো একটু অপেক্ষা করলে হতো। উপযুক্ত পাত্র হয়তো পাওয়া যেত। বিনয়কান্তির এতদিনকার অভিজ্ঞ চোখে এখন যেন ধরা পড়ে বসুন্ধরা ভিলার ঐশ্বর্য-বৈভব দেখেই তার একমাত্র জামাই প্রবোধ হীনমন্যতায় ভোগে। মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ক যে ভালো নেই — সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। বিনয়ের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একা প্রবোধ ঘরে ডেকে বলে ‘এই ঐশ্বর্য এই সম্পত্তি এই সম্মান কোনওকিছুই একদিনে হয়নি। এই প্রত্যেকটা জিনিসের পেছনে জমে আছে অনেক কান্না ঘাম অনেক অনেক অপমান। অনেক যন্ত্রণা অনেক ঝুঁকি। অনেক অনেক বিনিদ্র রজনী।’ কিন্তু বলা হয় না। নিজের কথা এভাবে কাউকে বলা যায় না। লড়াইটা একেকজনের একেকরকম।
সকলের অজান্তে বিনয় কয়েকবার ভেবেছে প্রবোধকে কিছু টাকা দিয়ে কোনও একটা ব্যবসা শুরু করতে বলবে। ব্যবসাটা সে, সেই মূলধন দিয়েই শুরু করুক। তার ভাইয়েরা ব্যবসায় পরিশ্রম করুক। ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সকলেই সুবিধা পাবে। কিন্তু সে ব্যাপারে না স্বর্ণ’র সঙ্গে আলোচনা করতে পারছে, না মায়ের সঙ্গে। অনেক ভেবেচিন্তে বিনয়কান্তি তারক নিয়োগীর কাছে দিকনির্দেশ চাইলেন। বসুন্ধরা ভিলার কালপুরুষ বা অরিয়ন জানালেন — ‘এ পথ সঠিক নয়। ভুল!’ বাবু জানালেন—এতে বিনয়কান্তির মেয়ে শান্তিলতা অপমানিত বোধ করতে পারে। মনে করিয়ে দিলেন উইলিয়াম পিটারসন বিকেডিকে বলেছিলেন ‘নিজের সহায়-সম্বল জড়িয়ে না থাকলে ব্যবসার মর্যাদা দেওয়া যায় না’। তাই স্ত্রী ও মায়ের গয়না বিক্রি করে যথাসর্বস্ব পিটারসনকে দিতে হয়েছিল।
বিনয়কান্তি সে সর্বনাশ থেকে পরিবারকে রক্ষা করতে পারেননি। শেয়ারে সর্বস্ব খুইয়ে অফিসের ভিতরে বাইরে পাওনাদারের জ্বালায় জর্জরিত শান্তিলতার স্বামী প্রবোধ সেনগুপ্ত অফিস ছুটির পর এক সন্ধ্যেবেলা ম্যাকিনন-ম্যাকেঞ্জি বিল্ডিং-এর চারতলার বড় জানলা খুলে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া রক্তাক্ত মাংসের তাল থেকে মাত্র বছর ৩৫-এর প্রবোধকে শনাক্ত করা শক্ত হয়ে পড়েছিল। বিনয়ের নির্দেশ মেনে তারক নিয়োগী কাগজে বসুন্ধরা ভিলার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও সংযোগ উল্লেখ করতে দেননি। পুলিশ নিয়মমাফিক ময়নাতদন্ত করে দেহ সৎকারের জন্য দিয়েছিল গগন ও বিকাশকান্তিকে। প্রবোধের ভাইয়েরা ছিল। দেহ চেতলার বাড়ি থেকে কেওড়াতলা শ্মশানে দাহ হয়েছিল বসুন্ধরা ভিলায় আসেনি। সবটা নিখুঁত ভাবে সামলে ছিলেন বাবু। তবে সবটা সামলাতে পারেননি। বারে বারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা শান্তিলতাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়েছিল। আর ৬১ বছর বয়সে প্রথম কার্ডিয়াক অ্যাটাকে ধরাশায়ী বিনয়কান্তি দত্তকে নিয়ে ক্লাইভ রো থেকে অ্যাম্বুলেন্স ছুটল উডল্যান্ড হসপিট্যালে। ১৯৬৭তে বেলভিউ তৈরি হবার পর অবশ্য বিনয়কান্তি ও বসুন্ধরা ভিলার বাকি সকলের চিকিৎসা সেখানেই হতো।

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪৫: বসুন্ধরা এবং…

দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

বাইরে দূরে: অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি
‘প্রবোধের ভাইদের বল দাহকাজ কাজ করতে। ব্যবস্থা যা করার তোমরা কর। বিনুর হাসপাতাল থেকে তারক আসবে শ্মশানে। তাকে আমি বলে দিয়েছি। মাকে এখন কোন ব্যাপারে বিরক্ত কোরো না। শান্তির এই অবস্থা। বিনুর শরীর ভালো নয়। স্বর্ণর মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। তুমি বাড়ির বড় ছেলে। নিজে বুদ্ধি করে সিদ্ধান্ত নাও। বাবা কেমন করে কাজ করতেন সেটা তুমি কাছ থেকে দেখেছ। অসুবিধে হলে আমার ঘরের নম্বরে ফোন করবে — মাকে নয়।’
চেতলার বাড়িতে শ্রাদ্ধশান্তির কাজ হয়েছিল। গগন আর বিকাশ নিয়ে গিয়েছিল বোনকে। সৌরভ গৌরব বসুন্ধরা ভিলাতে ছিল। বসুন্ধরার কথা মেনে সাহায্য করেছিল প্রবোধের পরের ভাই সুবোধ। শান্তিলতা আগাগোড়া শ্রাদ্ধে উপস্থিত ছিল। তার ও দু-ছেলের ভুজ্জি সে-ই নিবেদন করল। এই ‘ভুজ্জি’ শব্দটা লেখার পর সুবর্ণ মনে হল—আধুনিক প্রজন্মের জন্য একটু বিশদে বলা দরকার। কথাটা শুনে এসেছে। ব্যাপারটা আসলে কী সেটা জানা দরকার। ‘ভুজ্জি’ শব্দটা এসেছে ভোজ্য থেকে। শ্রাদ্ধে পরলোকগত মানুষের উদ্দেশ্যে অন্ন ও ভোজ্যদ্রব্য নিবেদন করাকেই— ভুজ্জি দান বলে।

কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-১: পোড়া গাছের ডাল থেকে নেমে এল সে! ভাটার মতো সবজে চোখ, ধোঁয়াটে শরীর…

খাই খাই: চিতল মাছের তো খেয়েছেন, এবার চিংড়ির মুইঠ্যার স্বাদ নিন, রইল সহজ রেসিপি

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩১: স্বাদ-বৈচিত্র্যে অতুলনীয় মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
বিনয় সুস্থ হবার পরে নিজে গিয়েছিল প্রবোধের মা-বাবা ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে। তাদের কাছে করজোড়ে অনুরোধ জানিয়েছিল—মেয়ে এবং নাতিদের বিনয়কান্তি নিজের কাছে রাখতে চায়। প্রবোধের মা-বাবা ছেলের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য যথেষ্ট বিব্রত ছিল। তাঁরা কোনও আপত্তি করলেন না। এরপর শান্তিলতা ও তার ছেলেদের পাকাপাকি ঠিকানা হল বসুন্ধরা ভিলা।
এ জন্যই হয়তো বলে, বৈবাহিক সম্পর্ক সমানে সমানে করা উচিত। তাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে উদ্যোগপতি বিনয়কান্তি দত্ত যখন মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন তখন প্রবোধের মা-বাবা যথেষ্ট অবাক হয়েছিল। গায়ে-হলুদের তত্ত্বের বহর দেখে চমকে উঠেছিল সেনগুপ্ত পরিবার। ছেলের বিয়েতে প্রবোধের মা আসেননি। কিন্তু বিয়েতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা দেখে প্রবোধের বাবা-ভাই মামাদের ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। সে সময়ে কলকাতায় পংক্তিভোজই রীতি ছিল। নিমন্ত্রিতরা ঘুরেফিরে সাজানো খাবার দেখে দেখে পছন্দ মতো খাবার ডিসে তুলে নিচ্ছে। এমন ব্যুফে পদ্ধতি সেই সময়ে কল্পনাতেও ছিল না কারও। কলাপাতায় লুচি লম্বা বেগুনভাজা ছোলার ডালে অভ্যস্ত বরযাত্রীরা সারসার টেবিলে থরেথরে সাজানো সুগন্ধি ভাত, পোলাও বিরিয়ানি, অথবা লুচি কচুরি পরোটার নানান পদ বা রকমারি মাছ এবং মাংসের সম্ভার কিংবা হরেক কিসিমের চাটনি আচার টপকে সন্দেশ রসগোল্লা পান্তুয়া দই রাবড়ির চেনা চেহারা ছাড়িয়ে অসংখ্য অচেনা দিশি-বিলিতি মিষ্টি বা কেক-পেস্ট্রির আয়োজনে হতবাক। সেনগুপ্তদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মাসখানেক গল্পকথা ছড়িয়ে পড়েছিল বসুন্ধরা ভিলায় প্রবোধের বিবাহ আয়োজনের। বিয়ের রাতে বাড়ি ফিরে প্রবোধের বাবা তাঁর স্ত্রী মানে শান্তিলতার হবু শাশুড়ি-মাকে বলেছিলেন— “বিয়ে তো দিলুম খোকার মা!! এখন তেলে-জলে মিশ খেলে হয়!!”

শাশ্বতী রামায়ণী: পর্ব ২৬: ‘সত্যেরে লও সহজে’—রাজসুখ ছেড়ে কি তবে বনবাসী মন?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২১: ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ শুটিংয়ে সিউড়ির বাঁশবনে দু’ দুটি বাঘ আনিয়েছিলেন সত্যজিৎ

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৪: বনের পথে গল্প রাশি রাশি— যাত্রাপথ যত এগোয় তত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে ওঠে পাণ্ডবদের
‘কিরে ছুঁড়ি বিয়েতে মতো আছে তো? দেখিস বাবা পরে আবার লোক হাসাস নি।’

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব -২৪: ন্যাশনাল থিয়েটারে মধুকবির ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র গিরিশচন্দ্রের নাট্যরূপ মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের

ভালো-বাসা: বাড়ির ছাদ বারান্দাতেই আম, কলা, নারকেল, সবজি ফলাতে চান? মাথায় রাখুন এই দশটি টিপস

ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি বিল্ডিং (ছবি: সংগৃহীত)।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
বসুন্ধরা যেন নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি আবার দেখতে পাচ্ছে। তফাৎ শুধু এইটুকু বসুন্ধরার স্বামী দেশান্তরি হয়েছিল। তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। শান্তিলতার স্বামী চিরদিনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বিনয়কে ডেকে বসুন্ধরা আলাদা করে বলে। শান্তির নামে একটা আলাদা করে ব্যবসা বা কিছু করে দে। যাতে সে কিছুটা রোজগার করতে পারে। দেখিস তার আত্মসম্মানে যেন কোনওদিন ঘা না লাগে।…বারোটা বছর আমি নিজে এই যন্ত্রণা সহ্য করেছি। আমি চাই না শান্তিলতা একই কষ্টে গুমরে মরুক।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।