
পরম্পরা ও শৃঙ্খলা। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।
রুচি পরম্পরা ও শৃঙ্খলা
এ বাড়িতে আসার পরেরদিন থেকেই ঋতু ভীষণ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম মা হওয়ার শারীরিক ধকলের কারণে দূর্বল হয়ে গিয়েছে। আমরা ভুল ভেবেছিলাম। ২৬ তারিখ স্বামী না ফেরার পর ঋতু তাঁর ঘরের আলমারিতে রাখা ম্যাচেস্টারের কনফারেন্সের কাগজপত্র খুঁজে সেখানে ঠিকানা ফোননাম্বার খুঁজে তার বাবাকে খোঁজ নিতে বলে। ঋতুর বাবা দীপক গুহ মজুমদার ট্রান্সপোর্ট সেক্রেটারি। সরাসরি সরকারি সূত্রে বিদেশমন্ত্রক মারফৎ খবর নেবার ব্যবস্থা করলেন।
সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ পেয়ে আর স্থির থাকতে না পেরে সস্ত্রীক ছূটে এলেন বসুন্ধরা ভিলায়। মা-বাবার উদভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে বুদ্ধিমতী ঋতুরআর কিছু বুঝতে বাকি ছিল না। কিন্তু এই পুরো দূর্ঘটনাটা একটা আগাম আঁচ যে ঋতুর মা-বাবাকে বসুন্ধরা ভিলার তরফে দেওয়া উচিৎ ছিল সেটা কারও খেয়াল ছিল না। খেয়াল ছিল না যে তন্ময়কান্তি দত্ত যতটা বসুন্ধরা ভিলার বংশধর ঠিক ততটাই শ্রী ও শ্রীমতি মজুমদারের সন্তানসম জামাতা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে বিনয়কান্তি দত্ত ও তার স্ত্রী স্বর্ণময়ী ঋতুর মা-বাবাকে করজোড়ে জানিয়েছিলেন—
—আমাদের ভুলের কোনও ক্ষমা হয় না। অনেক পারিবারিক সঙ্কট পেরিয়ে এসেছি কিন্তু এমন দুঃসময়ে কখনও পড়িনি। আমাদের বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল। খালি ভেবেছি এ বিপদ আমাদের একার। আপনাদের সামিল করতে পারিনি। আমাদের সকলকে মার্জনা করবেন।
ভদ্রতা মার্জিত ব্যবহার এগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক পরম্পরা বা সহবৎশিক্ষা সবসময় যে সকলকে লোভ ঔদ্ধত্য অহংকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে এমনটা নয়। একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বা সহোদর ভাই বা বোনেরাও ভিন্ন রুচির হতে পারে। ভিন্ন রুচির হয়। এমন প্রমাণ বসুন্ধরা ভিলাতেও আছে।
কিন্তু সেই সময়ের রাজ্যের পরিবহন সচিবের দায়িত্বে থাকা দীপক গুহ মজুমদার যে একজন অত্যন্ত ভদ্র সভ্য মার্জিত মানুষ তার প্রমাণ তিনি তাঁর পরবর্তী কথাতেই রাখলেন।

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৩: দেশপ্রিয়পার্কে বড় হয়ে ওঠা সুরঙ্গমার পক্ষে এ সব জানার সম্ভব ছিল না

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু
এই ভয়ংকর দুঃসংবাদ ঋতুর শারীরিক ক্ষতি না করলেও তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। বসুন্ধরা ভিলাতে বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য আয়া থাকতো। ঋতুর বাচ্চার জন্য আয়া ছিল। কিন্তু ঋতুর বাচ্চার সব কাজ নিজে করত। সবসময় ভয় পেত কোনও একটা ভুলভ্রান্তি বা অসাবধানে হয়তো বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে যাবে। বসুন্ধরা ভিলায় অন্নপ্রাশন হয় না। তবে ছ-মাস কেটে যাবার পর শিশুর নামকরণ করা হয়। ঋতু মাকে বলেছিল তার ছেলের নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। আমার মা বাচ্ছার নাম রেখেছিলেন ঋতম। ঋতু তন্ময় মিশিয়ে। ঋতু ঘর থেকে বের হতো না। কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিত না। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে কথা বলতো। কখনও নন্দা এলে নন্দার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতো। মৃন্ময়কান্তি ঋতুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করত কিন্তু ঋতু নিজেকে বদলে ফেলেছিল।
দাদু বা অন্যরা বলা সত্বেও স্বর্ণময়ী মনে করতেন এ সমস্ত ঘটনার জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী। দিল্লির প্রবাসী বাঙালি সুজাতা বসুরায় বসুন্ধরা ভিলার জন্যে একেবারেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। আর সুজাতার জন্যই এতটা দুর্বিনীত উদ্ধত অসভ্য তৈরি হয়েছে তার ছেলে প্রণয়কান্তি। যার সঙ্গে বসুন্ধরা ভিলার কোন ছেলে-মেয়ের মিল নেই।
তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ফলে শ্রীতমার মারফত এমন কিছু কথা জানতে পারতাম যা পারিবারিকভাবে হয়ত জানা যেত না। সেগুলো জানার পর প্রণয় সম্পর্কে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল। মানসিকভাবে প্রণয় খুব দূর্বল ছিল। অন্য সকলের সব কিছু ভালো হচ্ছে। কিন্তু তারবেলায় সেটা হচ্ছে না। চোখের সামনে গৌরবের ঝকঝকে সাফল্য তাকে আরও দূর্বল করে দিয়েছিল। ছোট থেকে আমার ন’কাকিমা সুজাতা গৌরবের সাফল্যকে উদাহরণ করে ছেলে প্রণয়কে আরও সচেতন হয়ে পরিশ্রম করার উৎসাহ দেননি। উলটে তাকে হিংসে করতে শিখিয়েছেন। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে একে ফোমো বলে- ফিয়ার অফ মিসিং আউট পেছিয়ে পড়া, বাদ পড়ে যাওয়া, না পাওয়ার ভয়। আর এই ভয় থেকে মুক্তি পেতেই তৈরি হয় তীব্র হিংসা। অপরের ভাল থাকার খুশি থাকার তোফা জীবন কাটানোর মনগড়া কল্পনা থেকেই আসে রাগে মেশানো হিংসার সবুজ হলাহল। বাংলায় যাকে মাৎসর্য্য বলে।

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি
এরপর থেকে বাবলির ওপর প্রণয় আর ন’কাকিমা সুজাতার রাগ আরও বাড়ল। ন’কাকিমা তো সরাসরি বলতেন বাবলি জাদুটোনা জানে। এঁর সঙ্গে যোগ হল বাবলির পরিচিত দিল্লির এক পারিবারিক বন্ধু – অরুণাভকে নিয়ে প্রণয়ের অযথা সন্দেহ। —চলবে।
