শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


পরম্পরা ও শৃঙ্খলা। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

রুচি পরম্পরা ও শৃঙ্খলা

এ বাড়িতে আসার পরেরদিন থেকেই ঋতু ভীষণ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম মা হওয়ার শারীরিক ধকলের কারণে দূর্বল হয়ে গিয়েছে। আমরা ভুল ভেবেছিলাম। ২৬ তারিখ স্বামী না ফেরার পর ঋতু তাঁর ঘরের আলমারিতে রাখা ম্যাচেস্টারের কনফারেন্সের কাগজপত্র খুঁজে সেখানে ঠিকানা ফোননাম্বার খুঁজে তার বাবাকে খোঁজ নিতে বলে। ঋতুর বাবা দীপক গুহ মজুমদার ট্রান্সপোর্ট সেক্রেটারি। সরাসরি সরকারি সূত্রে বিদেশমন্ত্রক মারফৎ খবর নেবার ব্যবস্থা করলেন।

সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ পেয়ে আর স্থির থাকতে না পেরে সস্ত্রীক ছূটে এলেন বসুন্ধরা ভিলায়। মা-বাবার উদভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে বুদ্ধিমতী ঋতুরআর কিছু বুঝতে বাকি ছিল না। কিন্তু এই পুরো দূর্ঘটনাটা একটা আগাম আঁচ যে ঋতুর মা-বাবাকে বসুন্ধরা ভিলার তরফে দেওয়া উচিৎ ছিল সেটা কারও খেয়াল ছিল না। খেয়াল ছিল না যে তন্ময়কান্তি দত্ত যতটা বসুন্ধরা ভিলার বংশধর ঠিক ততটাই শ্রী ও শ্রীমতি মজুমদারের সন্তানসম জামাতা।

আমার দাদু বিনয়কান্তিকে সবটা জানিয়ে মা বলেছিল গোটা পরিবারের হয়ে মা সেদিন ঋতুর মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। দাদু রাজি হননি।
চেয়ার ছেড়ে উঠে বিনয়কান্তি দত্ত ও তার স্ত্রী স্বর্ণময়ী ঋতুর মা-বাবাকে করজোড়ে জানিয়েছিলেন—

—আমাদের ভুলের কোনও ক্ষমা হয় না। অনেক পারিবারিক সঙ্কট পেরিয়ে এসেছি কিন্তু এমন দুঃসময়ে কখনও পড়িনি। আমাদের বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল। খালি ভেবেছি এ বিপদ আমাদের একার। আপনাদের সামিল করতে পারিনি। আমাদের সকলকে মার্জনা করবেন।

ভদ্রতা মার্জিত ব্যবহার এগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক পরম্পরা বা সহবৎশিক্ষা সবসময় যে সকলকে লোভ ঔদ্ধত্য অহংকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে এমনটা নয়। একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বা সহোদর ভাই বা বোনেরাও ভিন্ন রুচির হতে পারে। ভিন্ন রুচির হয়। এমন প্রমাণ বসুন্ধরা ভিলাতেও আছে।

কিন্তু সেই সময়ের রাজ্যের পরিবহন সচিবের দায়িত্বে থাকা দীপক গুহ মজুমদার যে একজন অত্যন্ত ভদ্র সভ্য মার্জিত মানুষ তার প্রমাণ তিনি তাঁর পরবর্তী কথাতেই রাখলেন।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৩: দেশপ্রিয়পার্কে বড় হয়ে ওঠা সুরঙ্গমার পক্ষে এ সব জানার সম্ভব ছিল না

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

চাকরিতে জয়েন করার আগে থেকেই আমি আপনার নাম শুনেছি। সেই আপনার পরিবারে আমার মেয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধ হল এটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। আপনার মতো মানুষ যদি আমাদের সামনে এভাবে হাতজোড় করে দাঁড়ান তাহলে আমার নিজের কুণ্ঠা বোধ হয়। দেখুন এভাবে তন্ময়কান্তির চলে যাওয়াটা আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। আমি বা আমার পরিবার জ্ঞানত কোনওদিন কারও ক্ষতি করিনি। তবু এত বড় একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল। ঋতুর দুর্ভাগ্য। তন্ময়ের মা বাবা আপনারা এই গোটা বসুন্ধরা ভিলার দুর্ভাগ্য। আর টেকনিক্যালি তন্ময় আমার জামাতা তার দুর্ঘটনার খবরটা হয়তো আমাদের কাছে আগেই আসতে পারতো। কিন্তু জেনে আমরা কী করতে পারতাম? জানেন আমি ঋতুকে বলেছিলাম যে প্রথম বাচ্চা হবার ব্যাপার তুই যদি চাস তাহলে আমাদের কাছে এসে থাকতে পারিস।
আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল বাবা তুমি এখানে একলা। তোমাকে স্টেটের এত বড় একটা রেসপন্সিবিলিটি সামলাতে হয়। সেখানে বসুন্ধরা ভিলায় এত লোকজন। সারা শহরে ওঁদের এত ইনফ্লুয়েন্স। বাড়িতেই নন্দার মতো একজন নামী গাইনি রয়েছে। তোমরা একদম চিন্তা করো না আমি বসুন্ধরা ভিলায় খুব ভালো থাকবো। বিশ্বাস করো আমার নিজের বাড়ির থেকেও ভালো থাকবো। এত সাংঘাতিক একটা ঘটনাকে আপনারা গোপন করেছেন সেটা তো আমার মেয়ের শরীরের কথা ভেবেই। দেখুন আমি ভীষণভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী। ঈশ্বর চাইলে আমরা আগেই জানতে পারতাম। তিনি চাননি। সন্তানকে নিয়ে পারিবারিক পুজোপার্বণ মিটে যাবার পর আপনারা ঠিক করেছিলেন আজকে ঋতুকে সব জানাবেন। ঈশ্বর সেটাও চাননি। তাই ঋতু আমাকে ম্যানচেস্টারে খোঁজ করতে বলেছিল। দূর্ঘটনার খবর শুনে আজ আমি ছুটে এসেছি। এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছে। যত দুঃখই হোক যত খারাপ লাগুক সত্যিটাকে মেনে নিতে হবে স্বীকার করতে হবে। আরও একটা কথা জানাই —আমি ঋতুকে বলেছিলাম যে আজ বাচ্চাকে নিয়েও আমাদের সঙ্গে আমার বাড়িতে চলুক। ঋতু বলল এখন ও বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু

এই পরিস্থিতিতে মেয়ের মুখে এই কথাটা শোনা একজন মা-বাবার কাছে এত বড় শোকের মধ্যেও একটা পরম শান্তি। তন্ময়কান্তির এই আচমকা দূর্ঘটনায় মৃত্যুর পরেও আমার মেয়ে ঋতু বসুন্ধরা ভিলায় নিজেকে অসহায় মনে করছে না।

এই ভয়ংকর দুঃসংবাদ ঋতুর শারীরিক ক্ষতি না করলেও তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। বসুন্ধরা ভিলাতে বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য আয়া থাকতো। ঋতুর বাচ্চার জন্য আয়া ছিল। কিন্তু ঋতুর বাচ্চার সব কাজ নিজে করত। সবসময় ভয় পেত কোনও একটা ভুলভ্রান্তি বা অসাবধানে হয়তো বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে যাবে। বসুন্ধরা ভিলায় অন্নপ্রাশন হয় না। তবে ছ-মাস কেটে যাবার পর শিশুর নামকরণ করা হয়। ঋতু মাকে বলেছিল তার ছেলের নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। আমার মা বাচ্ছার নাম রেখেছিলেন ঋতম। ঋতু তন্ময় মিশিয়ে। ঋতু ঘর থেকে বের হতো না। কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিত না। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে কথা বলতো। কখনও নন্দা এলে নন্দার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতো। মৃন্ময়কান্তি ঋতুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করত কিন্তু ঋতু নিজেকে বদলে ফেলেছিল।
ঠাম্মির শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। চোখের সামনে ঋতুর অবস্থা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল সুজাতার অকারণ সাংসারিক অশান্তি আর প্রণয়ের অসহনীয় ঔদ্ধত্য।

দাদু বা অন্যরা বলা সত্বেও স্বর্ণময়ী মনে করতেন এ সমস্ত ঘটনার জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী। দিল্লির প্রবাসী বাঙালি সুজাতা বসুরায় বসুন্ধরা ভিলার জন্যে একেবারেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। আর সুজাতার জন্যই এতটা দুর্বিনীত উদ্ধত অসভ্য তৈরি হয়েছে তার ছেলে প্রণয়কান্তি। যার সঙ্গে বসুন্ধরা ভিলার কোন ছেলে-মেয়ের মিল নেই।

তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ফলে শ্রীতমার মারফত এমন কিছু কথা জানতে পারতাম যা পারিবারিকভাবে হয়ত জানা যেত না। সেগুলো জানার পর প্রণয় সম্পর্কে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল। মানসিকভাবে প্রণয় খুব দূর্বল ছিল। অন্য সকলের সব কিছু ভালো হচ্ছে। কিন্তু তারবেলায় সেটা হচ্ছে না। চোখের সামনে গৌরবের ঝকঝকে সাফল্য তাকে আরও দূর্বল করে দিয়েছিল। ছোট থেকে আমার ন’কাকিমা সুজাতা গৌরবের সাফল্যকে উদাহরণ করে ছেলে প্রণয়কে আরও সচেতন হয়ে পরিশ্রম করার উৎসাহ দেননি। উলটে তাকে হিংসে করতে শিখিয়েছেন। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে একে ফোমো বলে- ফিয়ার অফ মিসিং আউট পেছিয়ে পড়া, বাদ পড়ে যাওয়া, না পাওয়ার ভয়। আর এই ভয় থেকে মুক্তি পেতেই তৈরি হয় তীব্র হিংসা। অপরের ভাল থাকার খুশি থাকার তোফা জীবন কাটানোর মনগড়া কল্পনা থেকেই আসে রাগে মেশানো হিংসার সবুজ হলাহল। বাংলায় যাকে মাৎসর্য্য বলে।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

পারিবারিক ব্যবসায় গৌরবের সমকক্ষ হতে না পারা, নিজের গুরুত্ব না পাওয়ার রাগ অকারণে গিয়ে পড়ত অন্যের ওপর। নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করার জন্যে কর্তৃত্ব জাহির করার জন্যে সে সকলের সঙ্গে দূর্ব্যবহার শুরু করল। এজেন্সির সার্ভিস স্টাফদের সঙ্গে।মেনগেট খোলার কয়েক মূহুর্ত দেরির জন্যে সিকিউরিটি স্টাফদের সঙ্গে। রাতে ঘরে মদ্যপান করে চিৎকার। শেষমেশ চিৎকার করতে মানা করায় বাবলিকে শারীরিকভাবে আঘাত করা। ঠাম্মি বা দাদু তখন ইতিহাস। হিসেব মতো বড়জেঠিমা আরতিই বয়োজ্যেষ্ঠা। তারপর মেজ্জেঠিমা ছন্দা। কিন্তু তাঁরা মায়ের ওপর সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই মায়ের অনুমতি নিয়ে বাড়ি ছাড়তে চাইল বাবলি। মা এবং জেঠীমারা বাবলিকে যেতে দিলেন না। ন’কাকা ছেলে প্রণয় এবং ন’কাকিমা সুজাতাকে বঞ্চিত করে ন’কাকার ব্যবসার মাসিক মাসোহারার শতকরা ৭৫ ভাগ বাবলির নামে করে দিলেন। কারণ বসুন্ধরা ভিলার সকল বাসিন্দার চিকিৎসার সমস্ত খরচাপাতি বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিস থেকে করা হয়। খাওয়া থাকার দৈনন্দিন খরচাপাতিও কোম্পানির।

এরপর থেকে বাবলির ওপর প্রণয় আর ন’কাকিমা সুজাতার রাগ আরও বাড়ল। ন’কাকিমা তো সরাসরি বলতেন বাবলি জাদুটোনা জানে। এঁর সঙ্গে যোগ হল বাবলির পরিচিত দিল্লির এক পারিবারিক বন্ধু – অরুণাভকে নিয়ে প্রণয়ের অযথা সন্দেহ। —চলবে।

সন্দেহ। ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৪৫

মোটর-দূর্ঘটনায় বাবলির বাবা যখন মারা যান তখন বাবলি স্কুলছাত্রী। একই গাড়িতে পিছনের সিটে বসা বাবলি আর বাবলির মা থেকে গেল পৃথিবীতে। হাইওয়ে ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িটা দুমড়ে গিয়েছিল। বাবার শরীরটা চেনা যায়নি।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content