গগন ও বিকাশকান্তির হুডখোলা উইলিস জিপ। (ছবি: সংগৃহীত)
।।গ্রে স্ট্রিট থেকে বালিগঞ্জ প্লেস।।
বিনয়কান্তি আর স্বর্ণময়ী ছাড়াও আরও একজনের বসুন্ধরাকে মা বলার অধিকার ছিল। তিনি তারক নিয়োগী। পূর্ববঙ্গ থেকে দাঙ্গায় বাবা-মা পরিবার-পরিজনকে হারিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা এই যুবককে ছেলের মতো ভালবাসতেন বসুন্ধরা। গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। পরে বসুন্ধরা ভিলাতেও সেই যাতায়াত এতটুকু কমেনি। প্রতিবার পুজোয় পঞ্চমীর দিন বসুন্ধরা আর স্বর্ণময়ীর কাছে শাড়ি আর মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে আসত তারক নিয়োগী। প্রত্যেক বছর ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় স্বর্ণময়ী তারক নিয়োগীকে ফোঁটা দিতেন। অনেক পরে একবার অমলকান্তি ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন— “বাবু! আপনি মা আর ঠাকুমাকে নিয়ম করে পুজোর সময় শাড়ি দিতেন অথচ বাবাকে কিছু দিতেন না কেন?” তারকবাবু হাসতে হাসতে বলেছিলেন—“মা-বোনের সঙ্গে অফিসিয়াল ডেকোরাম ছিল না-কিন্তু বিকেডি সঙ্গে ছিল।”
সুবর্ণকান্তির খেয়াল হল— এই লেখার গোড়ার দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। অফিসে বিনয়কান্তি ‘স্যার’ সম্বোধন পছন্দ করতেন না। উইলিয়াম পিটারসন তাকে নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ‘বিকেডি’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই রীতি মেনে তিনি অফিসে নামের আদ্যক্ষর দিয়ে সম্বোধনের নিয়ম চালু করেন।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথায় অল্প চুল আদ্যান্ত বাঙালি চেহারার তারক নিয়োগী সাহেবসুবোদের সঙ্গে অক্লেশে ইংরেজিতে আলাপচারিতা করতেন। উচ্চতা কম হলেও ব্যক্তিত্ব আভিজাত্যের অভাব ছিল না।
গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি তখন জমজমাট। নিজের বাড়ির মেরামতি বা ঘর বানাতে তখন কোনও অনুমতি লাগত না। গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে রান্নাঘরের অংশে পিলার দিয়ে আরও একটা তলায় খান তিনেক ঘর করা হয়েছিল। নিচের ঘরগুলোতে তখন ঠাকুর-চাকর কাজের লোকেরা থাকত। বাড়ির পাশের কতগুলো দোকান ঘর কিনে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে সার দিয়ে তিনটে গ্যারেজ তৈরি হল। একটায় থাকত বাদামি স্টুডিবেকার। পাশেরটায় কালো রঙের ভারিক্কি চেহারার ডজ কিংসওয়ে। তৃতীয় গ্যারেজে খালি থাকত। আত্মীয়-স্বজন গাড়ি নিয়ে এলে তারা ওই খালি গ্যারেজে গাড়ি রাখতেন।
গগন এবং বিকাশ দু’জনেই শ্যামপুকুর স্ট্রিটের সরস্বতী ইন্সটিটিউশনে পড়ত। ছেলেরা হেঁটে স্কুলে যেত। হাতিবাগানের মুখ থেকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে একটু এগিয়ে বাঁহাতি গলি দিয়ে এঁকে বেঁকে গেলে কিছুটা দূরেই শ্যামপুকুর স্ট্রিট। তারপর গঙ্গামুখো সোজা হেঁটে গেলেই ডানহাতে সরস্বতী ইনস্টিটিউশন। হুটোপাটি করে গেলে মিনিট ছয়। ধীরে সুস্থে গেলে দশ মিনিট। মেয়ে শান্তিলতা বাড়ির ফিটন চেপে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে যেত।
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪৩: বসুন্ধরা এবং…
গল্প: পরশ
ম্যাট্রিক পাশ করার পর গগনকান্তি স্কটিশ চার্চ কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হল। মেজ ভাই বিকাশকান্তি অংকে ছিল কাঁচা। স্কটিশ চার্চ কলেজে কমার্স নিয়ে পড়া শুরু করল। বিএসসি পাশ করার পর বিনয়কান্তি গগনকে ভর্তি করে দিলেন সেই সময়ের সবে গড়ে ওঠা ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজিতে। আড়াই বছরে জুট টেকনোলজির ডিপ্লোমা পাশ করা যেত। ডিপ্লোমার পর আরও এক বছর পড়লে বি-টেক ডিগ্রি। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে এবং ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন-এর অর্থানুকুল্যে শুরু হয়েছিল ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজি।
বিকাশকান্তি বিকম পাস করার পর তাকে কস্ট-অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ানো হল। গগনের পড়ার সূত্রে বিনয়কান্তির এই দক্ষিণ কলকাতায় যাওয়া আসার পথে তাকে বালিগঞ্জ প্লেসের জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন তারকবাবু। তখন ও-দিকটা ফাঁকা ফাঁকা বেশ জঙ্গল। উত্তর কলকাতার কাছে দক্ষিণ তখন নেহাতই পাড়া গাঁ। বিনয়কান্তি খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না, কিন্তু একটা বড়সড় জমি তাঁকে কিনতেই হত মা বসুন্ধরার কথা ভেবে। বসুন্ধরা প্রায়ই বলতেন— তার ছয় নাতি। এক নাতনির বিয়ে হবে। নাতবৌ নাতজামাইরা আসবে, তাদের ছেলেপুলে হলে এই গ্রে স্ট্রিটের এতটুকু বাড়িতে তারা থাকবে কোথায়? তাঁর বড় সখ সকলে মিলে থাকার জন্য একটা প্রাসাদপম বাড়ি।
ছেলেপিলেরা হুটোপাটি করতে পারে এমন খোলা জায়গা থাকতে হবে। লম্বা টানা ছাদ থাকবে, যাতে বাড়ির বাইরে গিয়ে খোলা আকাশ দেখতে না হয়। সবুজ বাগানের মধ্যে সাদা ধবধবে বাড়ি। ঠিক যেমন অনেক বছর আগে আছাবাম চা-বাগানে দেখেছিলেন। বসুন্ধরাকে খুশি করতে গেলে ফাঁকা জায়গায় জমি না কিনে উপায় নেই। তারকবাবু সাহস যোগালেন, এসব জায়গায় এমন থাকবে না আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। তারকবাবুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে, বালিগঞ্জ প্লেসের এক চিলতে জমির দাম আজ আকাশ ছোঁয়া।
মেন উইল বি মেন…
মাথায় খুব খুশকি? চুলও বেশ পড়ছে? চুলের স্বাস্থ্যে জাদুর মতো কাজ করে কারি পাতা
বিনয়কান্তি আর বসুন্ধরার কথা লিখতে গিয়ে বারবার সুবর্ণ আবিষ্কার করেছে নানান নতুন তথ্য — যেমন এই ‘উইলিস’ নিয়ে বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখল ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইলিস জিপ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রশক্তির সৈন্যবাহিনীতে ব্যবহার হতো। ১৯৪৮-র পর বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে ভারতে উইলিস জিপ তৈরি করত মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা। ১৯৪৫ সালে কোম্পানির পুরনো নাম ছিল মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মুহাম্মদ স্টিল কম্পানি। স্টিল ব্যবসায়ী দুই ভাই কৈলাশ ও জগদীশ মাহিন্দ্রা এবং লাহোরে জন্ম নেওয়া একাউন্টেন্ট গোলাম মুহাম্মদ মিলে প্রাথমিক ভাবে কোম্পানি গড়েছিল। সাতচল্লিশে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর গোলাম মুহাম্মদ পাকিস্তানে চলে গেলেন। আলিগড় ইউনিভার্সিটির একাউন্টান্সির স্নাতক রেলওয়ে এবং পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টর গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ। ১৯৪৬-এ তিনি অর্থমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খানের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন। দেশভাগের পর জিন্নাহ হলেন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল। লিয়াকৎ আলি খান হলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর তিনি তাঁর পূর্বপরিচিত গোলাম মুহাম্মদকে করলেন পাকিস্তানের প্রথম অর্থমন্ত্রী। মাহিন্দ্রা গ্রুপের এখনকার চেয়ারম্যান আনন্দ মাহিন্দ্রা হলেন প্রতিষ্ঠাতা জগদীশ মাহিন্দ্রার নাতি।
বিকাশকান্তি ছোট থেকেই শান্ত স্বভাবের তাই জিপগাড়ির দখল তার দাদা গগনকান্তির কাছেই ছিল। গ্রেস স্ট্রিটের বাড়ির তৃতীয় গ্যারেজে জায়গা হল সেই উইলিস জিপের। বসুন্ধরা টি ট্রেডার্স কম্পানি তখন বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কম্পানিজ। টি ডিভিশনের মালিকানায় তখন তিনটে চা বাগান। জুট ডিভিশন কাঁচা পাটের রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে হুগলি এবং হাওড়ায় জুটমিল খুলেছে। দুরন্ত গতিতে এগোচ্ছে বিনয়কান্তি দত্ত আর তার ছায়াসঙ্গী তারক নিয়োগী।
খাই খাই: রোজ রোজ এক রকম খাবারে অরুচি? খুদের জন্য রইল ভিন্ন স্বাদের এই রেসিপি
দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
অক্ষয়তৃতীয়া নানা কারণে বিশেষ শুভদিন। কথিত আছে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম এই শুভদিনে জন্ম নিয়েছিলেন। প্রচলিত যে এই দিনে মহাভারত রচনা আরম্ভ করেন বেদব্যাস যা লেখনীবদ্ধ করেছিলেন জ্ঞান ও বুদ্ধির দেবতা বিঘ্ননাশক গণপতি। এই দিনেই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। তাই বলা হয় অক্ষয়তৃতীয়াতেই কুবেরের বৈভব-লক্ষ্মীলাভ হয়েছিল। এইদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথ নির্মাণ শুরু হয়। বৈদিক ও হিন্দু মতের বিশ্বাস এই পবিত্র তিথিতে কোনও শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। এমন কি কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর যে মন্দির ছ’মাস বন্ধ থাকে এই দিনেই তার দ্বার-উদ্ঘাটন করা হয়।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: পেটের ব্যথাকে একেবারেই অবহেলা করবেন না / পর্ব- ১
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর
—আচ্ছা মা এই পেল্লায় বাড়িটা তো করালে, কিন্তু নেক্সট জেনারেশনের সকলে এই বাড়িতে থাকবে তো?
বসুন্ধরা সঙ্গে সঙ্গে জানালেন তাঁর অভিমত—
ভবিষ্যতে যে বাড়ি ছেড়ে যাবে বাড়িও তাকে ছেড়ে দেবে। যে কারণে তোকে দিয়ে এতো বড় বাড়ি বানিয়েছি, সেটা মেনে চলতে হবে। কোনওদিন বাড়ির কোনও ভাগ হবে না। যে ভাগ চাইবে তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আজকের তারিখ দিয়ে আমার কথাটা লিখে রাখ বিনু। বয়স হচ্ছে, কখন থাকি না থাকি, কিন্তু আমার কথাটার মর্যাদা যেন বংশধরেরা রাখে।
বিনয়কান্তি মর্যাদা রেখেছিলেন। দোসরা মে ১৯৫৭-র তারিখ দিয়ে সলিসিটর ডেকে এক বিশেষ ধরনের দলিল বানিয়েছিলেন, যে দলিলের মর্যাদা দিতে বসুন্ধরা ভিলার পরবর্তী বাসিন্দারা বাধ্য হয়েছে। বসুন্ধরা ভিলাকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই অক্ষত রাখার উপায় বাৎলে ছিলেন স্বয়ং বসুন্ধরা।
সেদিন রাতে বসুন্ধরা এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন লালপাড় শাড়ি পরা একজন বউ হাতে ডাব-বসানো মঙ্গলঘট নিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভিতর-বাড়িতে এলেন। কিন্তু তিনি কোথায় গেলেন বসুন্ধরা অনেক খুঁজেও তার কোনও হদিস করতে পারলেন না । বহু খোঁজাখুঁজির পর ভিতর বাড়িতে যে লম্বা উঠোন ছিল তার শেষ মাথায় গিয়ে দেখলেন ডাব শুদ্ধু সেই মঙ্গলঘট সেখানে বসানো আর তার চারপাশে গোল করে আলপনা দেওয়া।
পরদিন ভোরবেলা বিনয়কে ডেকে তুলে বসুন্ধরা বললেন তাঁর স্বপ্নের কথা। বললেন এ বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করবেন।—চলবে
বসুন্ধরা ভিলার রকমারি ফুলের বাগান।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
আজকের বসুন্ধরা ভিলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার অধিকার সাধারণের নেই। সাধারণ দর্শক তখন জায়েন্ট স্ক্রিনে দেবী মূর্তি দর্শন করতে পারবেন গেটের বাইরে থেকে। এখন শুধু শহরের নয় দেশের নামে শিল্পীরা আসেন অনুষ্ঠান করতে। সে অনুষ্ঠান দেখতে আসেন শহরের নামী দামী লোক। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায় বালিগঞ্জ প্লেস। পুজোর চার দিন নিউজ চ্যানেলের গাড়ি ঘিরে রাখে বসুন্ধরা ভিলা। আজকের প্রজন্ম টিভি বাইট দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভোগ প্রসাদ এর ক্ষেত্রেও ভিআইপি আর আমজনতার মন্ডপে ঢোকার রাস্তা আলাদা।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।