প্রাতরাশ।
।।১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮।।
ক্লাবের মুখচেনা এক ধনী সদস্য বিনয়কে দেখে মাপা হাসি হাসল, প্রত্যুত্তরে মুখে হাসি এনে বিনয় মাথাটা অল্প ঝোঁকাল। বিনয়ের মাঝেমধ্যে নিজেরই অবাক লাগে এতসব সে রপ্ত করল কী করে? পরিবেশ, পরিস্থিতিই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক! যাক গে।
এবার ‘হোল’ প্রতি নির্ধারিত বরাদ্দের থেকে ১টি কম স্ট্রোকে বল গর্তে পৌঁছে দেওয়াকে ‘বার্ডি’ বলে। ২টি কম হলে ঈগল — ৩ হলে আলব্যাট্রস। ৪-এ ডাবল ঈগল — ৫টা স্ট্রাইক কম করাকে কন্ডোর বলে। এই বার্ডি ঈগলের সংখ্যাধিক্যই স্কোর বাড়ায় সাফল্য দেয়। অপরদিকে নির্ধারিত স্ট্রোক বা পারের বেশিবার স্টাইক করে বল গর্তে পাঠালে স্কোর কমবে। এক বাড়লে তার নাম বগি, দুই বাড়লে ডাবল বগি, তারপর ট্রিপল বগি… এই ভাবে।
বিনয় ভাবছিল স্বর্ণময়ীকে এই জায়গাগুলো দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে আজকের পর সেখান থেকে বিনয় সামনে এগোবে? নাকি থমকে গিয়ে আশেপাশে ঘুরে, বাঁক নিয়ে, আবার একবার নতুন রাস্তা খুঁজতে হবে তাকে।
মনে মনে কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে সে অনেকটা এগিয়ে ছিল…গলফের ক্ষেত্রেও যেখান থেকে টি-তে বসিয়ে বল মারা হচ্ছে, সেখান থেকে অনেক গর্ত সরাসরি দেখা যায়, আন্দাজ করা যায়। আবার কোনও কোনও ‘হোল’ সেখান থেকে কিছুটা ডানদিকে বা বাঁদিকে বেঁকে আছে, তাকে ‘ডগলেগ’ বলে। জীবনের পথের আঁকে-বাঁকে লুকিয়ে থাকা চ্যালেঞ্জের মতো। আবার গলফের সঠিক ড্রাইভ নেওয়ার জন্যে মেরুদন্ডের পেশিকেও নাকি খুব সক্ষম হতে হয়। তাই এটা বলা হয় মেরুদন্ড শক্ত না হলে গলফ খেলা যায় না।
প্রথমেই লম্বা স্টিক বা ক্লাব দিয়ে, কাঠের কাপের মতো টি-তে বল বসিয়ে ঠাঁই করে সজোরে মেরে অনেকটা দুরে সবুজ ঘাসে ঘেরা নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠাতে হয়। তারপর নানান মাপের ১৪ ধরনের ক্লাব বা স্টিক দিয়ে গলফ খেলতে হবে। তাদের মাপ অনুযায়ী নাম। উডস আয়রন বা পাটার। গলফের টোল খাওয়া বলকে চাঁটি দিয়ে হাল্কা ঠুকে দিয়ে বা আলতো টোকায় হিসেব কষে কষে দূরে বা কাছের গর্তে পাঠাতে হবে। হাওয়ায় ভেসে দূরে উড়তে পারার জন্যেই গলফের বলে নাকি অমন নিটোল টোল।
বিনয় লক্ষ্য করছিল বারান্দায় বসে থাকা সুসজ্জিতা দেশীয় মহিলারা শ্বেতাঙ্গিনীদের থেকেও বেশি মেমসাহেব। পুরুষের থেকে মহিলারাই সংখ্যায় বেশি। অথচ গলফ নিয়ে একটি চালু মিথ হল ‘Gentlemen Only Ladies Forbidden’! এই কথাগুলোর আদ্যক্ষর নিয়েই নাকি GOLF.
পিটারসন ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরল। বিনয়কে দেখে বলল, ‘তুমি আমাকে ডাকোনি কেন’। বিনয় জানাল, সে পিটারসন সাহেবের সপ্তাহে একটা দিন সকালের গলফ খেলাটা নষ্ট করতে চায়নি। এক কোণে নিরিবিলিতে বিনয়কে নিয়েই ব্রেকফাস্টে বসল পিটারসন। খানিকটা সময় নৈঃশব্দ্যের পর পিটারসন ইশারায় বিনয়কে শুরু করতে বলল। বিনয় যেভাবে ঠিক করে এসেছিল ঠিক সেভাবেই পিটারসনকে সমস্ত কথা বলল। কথাগুলো শোনার পর পিটারসন চুপ করে গেল। কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে কয়েক মুহুর্ত বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দূরের গলফ কোর্সের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল—
‘BKD you are exceptional!’
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪২: বসুন্ধরা এবং…
ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৬: গাড়ির সান রুফ খুলে চালিয়ে দিলাম ‘সুহানা সফর হ্যায় ইয়ে মৌসম হাসি, হামে ডর হ্যায় কে…’
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৩: ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা…’
বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-১১: পরজন্মে যেন বাঙালি হয়েই জন্মগ্রহণ করি: অশোককুমার
তোমার জায়গায় যে কোন ধুরন্ধর লোক হলে ব্যবসাবাবদ টাকাটা কম করানোর জন্য আমার সঙ্গে দরাদরি করত। বেশিরভাগ মানুষ এই ভাবেই লাভ-ক্ষতির হিসেব করে। তোমার মত খুব কম সংখ্যক মানুষ স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটে। অন্যদের মতো তুমিও খুব ভালো করে জানো যে রাজনৈতিক অবস্থার জন্যেই আমি এই ব্যবসাটা বিক্রি করে লন্ডন ফিরে যেতে চাইছি। সুতরাং এই ব্যবসা বিক্রি করাটা আমার কাছে একটা বাধ্যবাধকতা। একটা কম্পালশন। ডিস্ট্রেস সেল!! তুমি জানো আমি কত পরিশ্রম করে এই ব্যবসাটা তৈরি করেছি। এই ব্যবসাকে আমি যেকোনও লোকের হাতে ছেড়ে যেতে পারব না। আমি জানি তুমি এই ব্যবসাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করবে। কারণ, তুমি আমার যোগ্যতম উত্তরসূরী। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। খালি একটা কথা আমায় বল— এই প্রস্তাব তোমার মাথায় এসেছিল নাকি তোমার মা এটা তোমায় বলেছেন।
বিনয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল —
‘এটা যে আমার মা বলেছে সেটা আপনি আন্দাজ করলেন কি করে?’
পিটারসন স্মিত হেসে বললেন—
‘Because you’re an exceptional son of an awesome mother!!’
বিনয় নিজেও জানত যে বিনয়ের মতো ছেলে হয়তো অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক খুঁজেও বসুন্ধরার মতো মা পাওয়া যাবে না।
১৯৪৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ছিল রবিবার। সরস্বতী পুজো। সেইদিন বিদ্যার দেবীর কাছে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে পরদিন সোমবার থেকে বাণিজ্যলক্ষীকে ঘরে আনলো বিনয়কান্তি দত্ত।
প্রথম দিন বিনয়কান্তি সমস্ত কর্মচারীদের নিয়ে একটা মিটিং করেছিল। তাতে বিনয় বলেছিল একটা কঠিন পরিস্থিতিতে কোম্পানির দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছে। কোম্পানির যে নায্য দাম হওয়া উচিত সেই টাকা বিনয়কান্তির কাছে ছিল না। অতি অল্প টাকায় পিটারসন সাহেব এই কোম্পানি তার হাতে তুলে দিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে এই কম্পানির লাভ থেকেই পিটারসন সাহেবের ধার মেটাতে হবে। তাই প্রত্যেককে তাঁদের ক্ষমতার তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হবে। যাতে প্রত্যেক বছর সৎভাবে ব্যবসা করে কোম্পানির লভ্যাংশ বাড়ানো সম্ভব হয় । যার থেকে পিটারসন সাহেবের ধার শোধ এবং কোম্পানির উন্নতিতে লভ্যাংশ যোগ হবে। বিনয় কান্তি আরও বললেন—
ইংলিশ টিংলিশ: দেখছি, লিখছি কিন্তু বলছি না! / ২
মাছের ডিম খেতে ভালোবাসেন? তাহলে ঝটপট তৈরি করে ফেলুন মাছের ডিমের ঝুড়ো
দশভুজা: আমার উড়ান— স্বাতী মোহন: এক এবং অন্যতমার আখ্যান…
চুলে পাক ধরছে? খুশকিহীন ঝলঝলে চুল চাই? তাহলে ঘি-তে রয়েছে ম্যাজিক
সুবর্ণ আবার সেদিন খালি পায়ে বসুন্ধরা ভিলার নরম সবুজ ঘাসের উপর হাঁটছিল। ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন প্রকৃতির মন্দির-চত্বরে পৌঁছতে জুতো খুলে খালি পায়ে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল ১৯৪৭ সালে দাদু বিনয়কান্তি দত্ত তাঁর সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে যে কথাগুলো বলেছিলেন যেভাবে বলেছিলেন সে তো আজকের ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে পড়ানো হয়। ট্রান্সপারেন্সি এনকারেজমেন্ট মোটিভেশন এসব তো ম্যানেজমেন্টের চেনা বুলি, যাকে পোশাকি ইংরেজিতে জার্গন বলে। খাতা-কলমে পিটার ড্রুকারকে, ফাদার অব ম্যানেজমেন্ট বলা হয়। ভিয়েনায় এক ইহুদি পরিবার ১৯০৯ সালে জন্ম নিয়েছিলেন ড্রুকার সাহেব। মানে দাদুর থেকে চার বছরের ছোট। সাতচল্লিশে দাদু যখন তাঁর সহকর্মীদের এসব ম্যানেজমেন্ট তত্ত্বকথা স্বাভাবিক ভাবে বলছেন – তখনও পিটার ড্রুকার এসব ভেবে ওঠেননি তিনি তখন আমেরিকার বেনিংটন কলেজে দর্শন পড়ান। তবে সুবর্ণ-র হিসেবে ভারতবর্ষের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ম্যানেজমেন্ট গুরু হলেন রুস্তমজী হরমুসজি মোদি, যাকে সকলে রুসি মোদি নামে চেনে। যিনি কাজ করতে করতে কাজ শিখেছেন। কারণ স্টিল প্লান্টে জয়েন করার আগে রুসি ছিলেন অক্সফোর্ডের ক্রাইস্টচার্চ কলেজের ইতিহাসের স্নাতক। সাতচল্লিশে তো তিনি টাটা স্টিলের অ্যাডিশনাল লেবার অফিসার। রুশি মোদির মতই বিনয়কান্তিও মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতেন। কখনও কাউকে বুঝিয়ে দিতেন না যে তিনি তাদের চেয়ে অনেক বড়মাপের কর্তাব্যক্তি। রুসি মোদির ৫০ বছর কর্মজীবনের পূর্তিতে টাটা স্টিল থেকে প্রকাশ করা ‘গ্লিম্পসেস অফ লিজেন্ড’ — বইটা লাইব্রেরি ঘরে আছে। সুবর্ণ বারকয়েক পড়েছে। সেখানে জেআরডি টাটা-র একটা কথা রয়েছে।
Russi and I have grown together in the company, Russi more usefully, than I and therefore, there was no question in my mind that Russi Modi was the best man to carry the torch better than I would be able to do in future…
সুখের কথা বিনয়কান্তি বা রুশি মোদিকে সুবর্ণকান্তির মত কখনও কোনও ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পড়ে ভাগ্যিস ডিগ্রি নিতে হয়নি। তাই বোধ হয় তাদের সিদ্ধান্তগুলো মানবিক, অতিমানবিক নয়। —চলবে
পরের পর্ব আগামী রবিবার
সেদিন রাতে বসুন্ধরা এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন— লাল পাড় শাড়ি পরা একজন বউ হাতে ডাব বসানো মঙ্গলঘট নিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভিতর-বাড়িতে এলেন। কিন্তু তিনি কোথায় গেলেন বসুন্ধরা অনেক খুঁজেও তার কোন হদিস করতে পারলেন না। ভেতর বাড়িতে যে লম্বা উঠোন ছিল তার শেষ মাথায় গিয়ে দেখলেন ডাবশুদ্ধু এই মঙ্গলঘট সেখানে বসানো আর তার চারপাশে গোল করে আলপনা দেওয়া।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।