শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী।

।।সুজাতা ও তরুণকান্তি।।

আড়ি পেতে এসব কথা শোনবার নয়। কিন্তু ন’কাকার মতো একজন নির্বিরোধী ভালো মানুষের যন্ত্রণাটা কোথায় সেটা জানার কৌতূহল দমন করতে পারেনি সুবর্ণ।

‘বসুন্ধরা ভিলার বিলেত-প্রবাসী ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে সম্বন্ধের সম্ভাবনা জন্মাতেই তাদের মুহূর্তের মধ্যে নাকচ করে দেয় সুজাতা। বসুন্ধরা ভিলায় ভয়ংকর বিষপান করে আমি নীলকন্ঠ হলাম। তুমি তো জান আমি সিনসিয়ারলি চেষ্টা করেছিলাম।’

সেদিনের শোনা কথাগুলো আজ ভাবতে বসে সুবর্ণ’র মনে হতে থাকে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে মানুষ আরও একজনের সাহায্য কেন চায়? নিজের কাছেই কি নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে চায়? নাকি নিজের ভেতরের সন্দেহকে একা একা লড়াই করতে ভয় পায়?

সেদিনের যুবক সুবর্ণকান্তির কানে এসেছিল আরও অনেক কথা। তরুণকান্তি’র সেজবৌদি সুবর্ণকান্তির মা সুরঙ্গমা ওপরের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে একতলার নরম সবুজ ঘাসের উপর চোখ রেখে শুনছিলেন। হুইল চেয়ারে বসে খাটে হাত রেখে কথা বলছিলেন ন’কাকা। বাবা-মার ঘরে ওই খাটটা নাকি গ্রে স্ট্রিটের কেদার পালের খাট। তাঁর শ্বশুরমশাই কালিকৃষ্ণ পালের তত্ত্বাবধানে মাহিয়ারির কে কে ফার্নিচারসের কারখানায় বানানো। সেগুন কাঠের গোলাপ-কলস খাট। মানে হেডবোর্ড আর পায়ের দিকে কলস এর উপর গোলাপ বসানো থাকলে যে রকম দেখতে হয় কাঠে কলকা করে সেরকম করে বানানো। গ্রে স্ট্রিটের বাড়ির একতলায় বাবা ন’কাকা ছোটবেলায় এই খাটটাই নাকি ব্যবহার করত।

মা’র কাছে শুনেছি আমার বাবা কথা প্রসঙ্গে আমার দাদামশাই অধ্যাপক রণেন সেনগুপ্তকে নাকি বলেছিলেন—

‘দেখুন আপনি আমার আগে আমার বাবাকে চেনেন। কিন্তু আমাকে কোনওভাবেই তাঁর কর্মক্ষমতা বা কৃতিত্বের উত্তরাধিকারী ভাববেন না। বসুন্ধরা ভিলায় থাকি বটে কিন্তু সেই পরিবারের ঐতিহ্য বা পরম্পরা কোনওটাই আমার নেই। তেমন কিছুই করি না। সামান্য একটু লেখালেখি করি। এটা জেনেও আপনি যে আমার সঙ্গে আপনার রূপে ও গুণে বিখ্যাত কন্যাটির বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি আপনার এই ভরসা ও বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করব। তবে যেহেতু সুপাত্র হিসেবে আমার খুব একটা জোরালো সার্টিফিকেট নেই। তাই আমাকে কোনও যৌতুক দেবেন না। আমাদের গ্রে স্ট্রিটের পুরোনো বাড়িতে বাড়িওয়ালার শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া যত্ন করে বানানো খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল সব আমি ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করেছি। এখনও বসুন্ধরা ভিলায় আমাকে যে ঘরটিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে তাতে সেইসব আসবাবই আছে। সুতরাং নতুন করে আর কিছু লাগবেনা।’

সুবর্ণ আবার ফিরে যায় তার যুবক বয়সে শোনা সেদিনের সে আলোচনায়।

‘দেখো বৌদি বিয়ের আগে কমবয়সে ছেলে বা মেয়ে অনেকেই ভুল করে ফেলে। পরে বিবাহিত জীবনের সূত্রে আবার স্বাভাবিক দাম্পত্যে ফিরে আসে। ধীরে ধীরে নিজের ভুল থেকে নিজেকে বদলে নিতে শেখে। আমিও ভেবেছিলাম সুজাতা হয়তো প্রণয় জন্মানোর পর বদলে যাবে। কিন্তু আমার ভুল হয়েছিল।’
আরও পড়ুন:

পর্ব-৩, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: লিখতে বসে সুবর্ণর মনে হয়েছে ‘বসুন্ধরা এবং…’ তার কনফেশন বক্স …

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১: একটি ক্লান্তিকর বাসযাত্রা এবং…

‘দেখ ন’ঠাকুরপো— হাতের পাঁচটা আঙুল এর মত সব মানুষও যেমন সমান নয়। তেমনি সব মানুষের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাও সমান নয়। ফুলঠাকুরপোর সঙ্গে বিয়েটা ঠিক হবার পর সুজাতা বা তার বাড়ির লোকজনের হয়তো আকাঙ্ক্ষা ছিল সে লন্ডনে গিয়ে থাকবে। সেটা হয়নি। আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছে। সেই জন্য ওর মনের মধ্যে একটা ভুল ধারনা তৈরি হয়েছে। সেটা বদল করার চেষ্টা তোমায় করতে হবে। দেখো আমি দু-তিনখানা ছবিতে কাজ করেছি। লোকের কাছে পরিচিতি পেয়েছি কিন্তু সত্যি সত্যিই আমি গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে চলে যেতে চাইনি। আমি সংসার করতে চেয়েছিলাম। তাই ছবির জগৎ ছেড়ে দিয়েছি। ঠাম্মি বলেছিল, বাবার সম্মান এসব আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমিও তো চাইনি। তোমার সেজদা লেখালেখির জগতে অনিশ্চিয়তায় ভরা জেনেও অধ্যাপনার চাকরিটাও নেয়নি। বসুন্ধরা গ্রুপে জয়েন করার কথা তো ছেড়েই দাও।’

‘সেজদা পেরেছে। ওর ভীষণ মনের জোর। ছবি এঁকে বেঁচে থাকতে পারব আমার অত আত্মবিশ্বাস ছিল না। তাই মাঝামাঝিই থেকে গেলাম। ছবিটাও মন দিয়ে আঁকতে পারলাম না আবার ব্যবসার কাজেও …
বড়ঠাম্মির মতো দূর্ভাগ্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা, দাদুর মতো জেদ নিজের ভাগ্যকে গড়ে নেবার দূর্দম সাহস বা আমার ঠাম্মির মতো সরাসরি কথা বলার ক্ষমতা ন’কাকা তরুণকান্তির ছিল না। আমরা সবাই ভালো রেজাল্ট করেছি পড়াশোনা করেছি। আমার ছোটবোন খুব ভালো ডাক্তার হয়েছে। আমার বড়জ্যাঠামনি গগনকান্তি বা মেজ্জ্যাঠামণি বিকাশকান্তি কৃতী পুরুষ। ফুলকাকা বিখ্যাত ডাক্তার, বাবা জনপ্রিয় সাহিত্যিক কিন্তু দাদুর মতো অবাক করে দেওয়া উদ্যোগী উদ্যমী পুরুষ আর কেউ হতে পারেনি। আমার পিসতুতো ভাই হলেও আমার পিসিমণির ছোটছেলে গৌরবের মধ্যে কিছুটা হলেও দাদুর ধারালো ব্যক্তিত্বের প্রকাশ রয়েছে। পিসিমণি চিরকাল চুপচাপ মেনে নেওয়া প্রকৃতির মহিলা। আমার বড় ঠাম্মির মা কণিকা নাকি এরকম ছিলেন। ঠাম্মির অসম্ভব সাহিত্য প্রীতি বাবার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। আর আমার বোন সানন্দার মধ্যে আমার বড় ঠাম্মির চারিত্রিক দৃঢ়তা আমার ঠাম্মির সহজাত প্রতিভা আর মায়ের মনোরম ব্যক্তিত্ব মিশে ছিল। তার জীবনটা সহজ হয়ে ওঠেনি। আমরা সে প্রসঙ্গে ক্রমশ জানব। কিন্তু সুবর্ণ বসুন্ধরা ভিলার বংশপরম্পরায় মেন্ডেল সাহেবের প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের প্রমাণ ও প্রভাব খুঁজে পায়। সেই ১৮৮৬ সালের গ্রেগর যোহান মেন্ডেল। অস্ট্রিয়ার ধর্মযাজক জীববিজ্ঞানী গণিতজ্ঞ। সেই মটরশুঁটির বিখ্যাত পরীক্ষা, যা আসলে মডার্ন জেনেটিক্সের শুরু। সেই রিসেসিভ আর ডমিন্যান্ট ফ্যাক্টর। ল অফ সেগ্রিগেশন বা ল অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাসর্টমেন্ট।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কোন ১০টি ফল খাবেন?

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

বৈজ্ঞানিক সূত্রের তত্ত্ব আলোচনায়— সাধারণত সূত্রের ব্যতিক্রম নিয়েও বিশদে বলা হয়ে থাকে। কোথায় কখন এ নিয়ম খাটবে না। এ ভাবেই প্রথম সূত্রের ব্যতিক্রমে একটা লিথাল জিন বা মারণ জিনের কথা বলা হয়েছে। যার প্রভাবে প্রজাতির অঙ্গহানি বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বসুন্ধরা ভিলার বংশানুক্রমে কোথাও যেন সেই অজানা মারণ বৈশিষ্ট্যের প্রচ্ছন্ন অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছে। যাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু অস্তিত্ব স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বসুন্ধরা ভিলায় এমন কয়েকটা আচমকা অঘটন ঘটে গেল যা আগে থেকে ভাবাও যায়নি বা যা নিয়ে আলোচনা অনভিপ্রেত এবং অস্বস্তিকর। কিন্তু পাঠকের কাছে আলো-অন্ধকার সবটুকু নিয়েই জীবন। প্রথম অধ্যায়ে ছিল উত্তরণের কথা। তাই সে আখ্যান ছিল সাফল্যের আলোয় সততার উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত।

সেই প্রথম দিন থেকেই আমার ন’কাকিমা সুজাতার মনে গোটা বসুন্ধরা ভিলা বা এই পরিবারের প্রায় প্রত্যেকের উপরেই একটা রাগ কাজ করে। যেন জমিয়ে রাখা একটা তীব্র প্রতিহিংসা। অথচ ফুল কাকার সঙ্গে তার বিয়ে না হওয়াটা কেউ ইচ্ছে করে চায়নি এমনটা নয়। ঘটনাটা ঘটে গিয়েছে। ফুলকাকা এফআরসিএস করার জন্যে তখন বিয়ে করতে চায়নি। ঠাম্মি বসুন্ধরা ভিলার সম্মান বাঁচাতে তড়িঘড়ি ন’কাকাকে রাজি করিয়েছে। মায়ের মুখ চেয়ে ন’কাকা আপত্তি করেনি। এতগুলো পার্মুটেশন কম্বিনেশন এর মধ্যে যেকোনও একটা অন্যরকম সিদ্ধান্ত হলেই আজকের সমস্যাটা হোত না। যদি ফুলকাকা এফআরসিএস করতে লন্ডন না যেত। তাহলে হয়তো বিয়েটা হতে পারত। কারণ কীরা কাকিমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় প্রেম বা বিয়ে অনেক পরে। একাত্তর সালে। বড় ঠাম্মি বিয়ের মতো বিষয়ে কথা দেওয়ার আগে ফুলকাকার সঙ্গে একবারটি কথা বলে নিতে পারতো। বসু রায় পরিবার তল্পিতল্পা নিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা আসার আগেই সেটা হতে পারত। হ্যাঁ হয়তো ঠাম্মির মেজদিদি জামাইবাবু একটু মনঃক্ষুণ্ণ হতেন। কিন্তু এইটুকুতেই সমস্যাটা আর এগোতো না। ন’কাকা বলতেই পারতো, ‘মাফ করো মা। যার সঙ্গে আমার ছোট ভাইয়ের সম্বন্ধ হয়েছে, তাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।’
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: এই বইমেলা জানে আমার প্রথম অনেক কিছু…

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৪: শুধু কি পিতৃবিয়োগব্যথা লাভ ভরতের, না কি আরও দুঃখ অপেক্ষমাণ…

‘নো মেকআপ লুক’ চাই? তাহলে ৫টি লিপস্টিক নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন

আসলে শ্রদ্ধেয় কারো মুখের উপর ‘না’ বলতে গেলে একটা জোর লাগে। অন্তঃকরণের জোর। ন’কাকার মত নরম মানুষের সেই ‘না’ বলার জোরটা ছিল না। থাকলে তাঁর জীবনের আজ এই পরিণতি হতো না।

৭১ সালে ফুলকাকা যখন কীরা কাকিমাকে বিয়ে করার কথা বাড়িতে জানাল প্রথমে আমার ঠাম্মি একেবারেই রাজি হয়নি। দাদুরও খুব একটা মত ছিল না। ফুলকাকা তখন আমার মা সুরঙ্গমাকে নিখরচায় অ্যাডভোকেট রেখেছিল। সেই অ্যাডভোকেট বুদ্ধি করে উচ্চ আদালত মানে আমার বড়ঠাম্মির কাছ থেকে অর্ডার পাস করিয়ে ফুলকাকা কীরা কাকিমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল। আমার মা-বাবা বিলেতে সেই বিয়েতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ।

৬৭তে ন’কাকার বিয়ের পর ৬৮-র মাঝামাঝি প্রণয়ের জন্মে সুজাতা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। তিন বছরের মাথায় ফুলকাকার মেম বিয়ের পর থেকেই ন’কাকিমার মধ্যে রাগ প্রতিহিংসা বাড়তে থাকে। কিন্তু কীরাকাকিমাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার কোনো কারণই ছিল না সুজাতার।—চলবে
ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৫

“এই যে যন্ত্র দেখছিস, এটা সেগুন কাঠের। এই যে মুগুরের মতো অংশটা, এটা ফাঁপা। এখান থেকে আওয়াজ আসে। এটাকে সাউণ্ড বোর্ড বলে, এটা টান করে পাতলা ছাগলের চামড়া দিয়ে ছাওয়া। মনে থাকবে, আর ভুল হবে না?’ বুঝতে পারছি চিনুদাদা গুরু দেবপ্রসাদ বসু বা তার কোন সিনিয়র ছাত্রের ক্লাস নেওয়ার ধরনকে কপি করছে।”

 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content