![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/samayupdates_Novel-1.jpg)
আনন্দমোহনের বাড়ি।
।।ঘর সংসার।।
বসুন্ধরা স্বর্ণের মাথায় হাত রেখে বলেন,
− অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করে বিনুকে আগলে এতটা পৌঁছেছি। এবার যে তোকে সামলাতে হবে স্বর্ণ। মা-ছেলে অনেক অভাব-অপমান-অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়াই করে টিকে ছিলাম। এবার তোকে পরিবার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জানিস মা ঈশ্বর আমাকে সংসার করার সৌভাগ্য দেননি। মণিকর্ণিকা ঘাটে বিনুর বাবার জ্বলন্ত চিতার সামনে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি আমি বিনুর উপযুক্ত স্ত্রীকে খুঁজে পাই তাহলে তার হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে আমি দায়মুক্ত হব। এবার আমার মুক্তি হবে।
− ঠিক আছে মা তাই হবে। তোমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবে। আজ থেকে আমি সংসারের সব দায় সব ঝঞ্ঝাট মাথা পেতে নেব। কিন্তু তুমি থাকবে মাথার উপরে। আমাকে ছেড়ে তোমার কোথাও যাওয়া হবে না ।
− বেশ। আমি তোর সঙ্গে থাকব। কিন্তু তোর যে কঠিন দায়িত্ব স্বর্ণ, তোকে বিনয়কান্তি দত্তের স্ত্রী হয়ে উঠতে হবে। তুই আমার আটপৌরে চেহারা বদলে আমায় আছাবাম চা-বাগানে বিনয়কান্তি দত্তের মা বানিয়েছিলি মনে আছে?
− তুমি তার শোধ নিচ্ছ বুঝি?
− নারে পাগলি, তুই আমার বিনুর বউ, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দায়-দায়িত্ব যার হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি। ওহো ভালো কথা মনে পড়েছে। বিয়ের আগেই তোর একটা পাওনা হয়েছিল।
স্বর্ণ বেশ অবাক। বসুন্ধরা কাঠের আলমারি খুলে, আছাবাম চা বাগানের পুরকায়স্থবাবুদের উপহার দেওয়া মেখেলা-চাদরের সেট বের করে। স্বর্ণময়ীর জমকালো সেটের পাশাপাশি তার নিজের সোনালি সুতোর কাজ করা সেটটাও দেখায়। বিনয় কীভাবে বাগানের গরিব শ্রমিক কর্মচারীদের সাহায্য করেছিল, বসুন্ধরা স্বর্ণকে সেসব গল্প বলে, নিয়মিত চিঠি লিখেও যা যা বলা বাকি ছিল। চা-বাগানের গল্প, বাবুরাম-চারুমতী পুহর বা থুয়া’র গল্প। নাম্ফাকে বৌদ্ধ বিহার, বুড়ি-ডিহিং নদী।
− আর তোকে একটা কাজ করতে হবে।
− বল কী কাজ।
বসুন্ধরা চোখ টিপে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে নিজের লজ্জা লুকানোর চেষ্টা করে।
− কী হল বলো?
− বিনুকে বলবি না?
− তোমাকে কথা দিলে বলব না।
− আমাকে একটু কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখিয়ে দিবি স্বর্ণ।
স্বর্ণময়ীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না। সে ভাবতে পারছে না ফরিদপুরের গ্রামে বড় হয়ে ওঠা স্কুলে না যাওয়া বসুন্ধরা দত্ত এই বয়সে এসে নতুন করে ইংরেজি ভাষা শিখতে চাইছে।
− তুমি শিখবে মা? সত্যিই আমি ভাবতে পারছি না। শুধু একটা প্রশ্ন করব। এই বয়সে কেন তুমি ইংরেজি শিখতে চাইছ মা?
− বউভাতের দিন বিনুর পিটারসন সাহেব তোকে ইংরিজিতে কতকিছু বললে তুই কেমন সুন্দর উত্তর দিলি। কিন্তু আমাকে যখন কয়েকটা কথা বলল আমি তো বোবা কালার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বিনয় গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে এসে দুটো করে ইংরেজি খবরের কাগজ নিতো। বলেছিল আমার জন্য একটা বাংলা কাগজ নেবে আমি মানা করেছিলাম। ভেবেছিলাম বুঝি ইংরেজি খবরের কাগজে চোখ বোলালেই ইংরেজি শেখা যাবে।
মেখেলার চাদরটা গায়ে ফেলে স্বর্ণ একবার গিয়ে দাঁড়ালো সে ঘরের নতুন ড্রেসিং টেবিলের সামনে। তিন ভাঁজের হাফ-আয়না। কলকার কাজ করা চেস্টের উপরে লাগানো। সামনে বসার টুলটা চেস্টের তলায় ঢুকে যায়। বিনয়কান্তির অনেক বারণ সত্বেও আনন্দমোহনকে নতুন ফার্নিচার পাঠানোর থেকে বিরত করতে পারেনি। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল আলনা, ছোট টেবিল আর বসার একজোড়া চেয়ার সব একরকমের মানানসই ডিজাইন। বার্মা টিক। বিলেতের হ্যারিস লেবাস কোম্পানির ইউরোপিয়ান ডিজাইনে ক্যাটালগ দেখে বানানো। হ্যারিস লেবাস-এর ‘HL’ লেখা গোল পিতল-ছাপটাই শুধু দেওয়া নেই।
বিনয়কান্তির ঘরে রাখা পালবাবুর শ্বশুরমশাইয়ের কারখানায় বানানো খাট-বিছানা আলমারির এখন নিচের একটা ঘরে রাখা আছে। বিনয়কান্তির দায়িত্ব ও ব্যস্ততা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। এখন বিনয় সংসারের কোনও কিছু নিয়েই আর ভাবে না।
পিটারসন সাহেব তখন কয়েক মাসের ছুটিতে লন্ডনে আছেন, বিনয়কান্তি একাই তখন সমস্ত ব্যবসা দেখাশোনা করছে। সেই সময় ক্লাইভ রো অফিসে বিনয়কান্তির সঙ্গে দেখা করতে এলেন এক যুবক। বিনয়কান্তির সেদিন একেবারে সময় নেই। স্কটল্যান্ডে যাওয়া কাঁচা পাটের জাহাজ বোঝাই হচ্ছে। তার নানান নিয়মকানুন। কাগজপত্র সইসাবুদ আছে। বিদেশি লোকের কোম্পানি হলেও এই প্রথম তারা বিদেশে চা পাঠানোর একটা বরাত পেয়েছে। যুবকটি সকাল দশটার সময় এসে কাগজে নাম লিখে পাঠিয়েছিল। বেয়ারাকে বলে পাঠিয়েছিল– ‘ওনাকে বল আজ আমি ভীষণ ব্যস্ত আছি, হয়তো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।’
দুপুর বেলায় খেতে যাবার সময় হঠাৎ টেবিলের উপর কাগজটার দিকে নজর গেল। একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ ঘিরে ধরল বিনয়কান্তিকে, লাগোয়া খাবারঘরে না গিয়ে বিনয় নিজের ঘরের দরজা ঠেলে বাইরে এল। এখন পিটারসন সাহেবের পাশের ঘরটায় বিনয়কান্তি বসে। দরজার বাইরে পেতলের প্লেটে কালো মোটা মোটা অক্ষরে ঝকঝক করে তার নাম, বিনয় কান্তি দত্ত। যুবক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দু’পাশে সারসার আলমারি দাঁড় করানো। মাঝের রাস্তাটা প্রায় একই রকম আছে। সেদিন যেখান দিয়ে পিটারসন সাহেব এসেছিলেন আজ সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে বিনয়কান্তি। আর আলমারি গলির ওপারে ক্লাইভ রো-র তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সেদিনের সেই যুবক। ঠিক সেখানেই। যেখানে একদিন একরাশ আশঙ্কা বুকে নিয়ে বিনয়কান্তি নিজে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটির কাছে গিয়ে বিনয় বলল,
− আসুন! আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/06/Basundhara-Ebong_cover-pic-.jpg)
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৮: বসুন্ধরা এবং…
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/PS-1-3.jpg)
ফিল্ম রিভিউ: পিএস-১, মণি রত্নমই পারেন এমন গ্রাফিক্সবিহীন রূপকথার জন্ম দিতে
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/recipe.jpg)
খাই খাই: উৎসব দিনে চট জলদি বানিয়ে ফেলুন স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর চাইনিজ স্টাইলে গার্লিক চিকেন
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/English-Tinglish-Preposition.jpg)
ইংলিশ টিংলিশ: Preposition-এর মূল নিয়মগুলো জানো কি?
সুবর্ণকান্তি এই জায়গাটা লেখার পর একটু থমকে গেল। গবেষণার খাতায় পত্রিকার পাতায় ১৯৪৬-এর ১৬ অগস্টকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ধরা হয়। ‘The Great Calcutta Killing’ । মুসলিম লিগ ঘোষিত ‘Direct action Day’। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় মহাফেজখানা থেকে পাওয়া পুলিশ রিপোর্ট বা পলিটিকাল বিভাগের কাগজপত্র ঘাঁটলে এটা দেখা যায়, যে ১৯৩০ সালের পর থেকেই পূর্ববঙ্গে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। যার ফলে পাবনা চট্টগ্রাম-কিশোরগঞ্জ-ঢাকা এইসব জেলা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা আসাম এর দিকে চলে আসতে শুরু করেন। ১৯৪৬-এর অক্টোবর মাসের লক্ষ্মী পুজোর দিন নোয়াখালি কুমিল্লা চট্টগ্রাম পাবনা ময়মনসিংহ জেলায় সেই দাঙ্গাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তার মানে ১৯৩১ সালে এই যুবকের পাবনা থেকে চলে আসাটা যুক্তিযুক্ত।
− এখনও খাওয়া হয়নি তো?
বিনয়কান্তির প্রশ্নে যুবক ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিল, একবেলা খেয়ে থাকাটা তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তার কোনও অসুবিধে হয় না। বরং হঠাৎ করে দুপুরবেলা একদিন খেতে পেয়ে গেলে পরেরদিন অসুবিধে হয়ে যাবে। তখন রোজ দুবেলা খাবার না পেলে কষ্ট। দিনের পর দিন সে নানা কাজে বনগাঁর থেকে কলকাতায় আসা বা না খেয়ে থাকার অভ্যেসটা নষ্ট হয়ে যাবে।
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/Child-Care-1.jpg)
ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/05/Amazon.jpg)
দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-৯: আমাজন যেন স্বর্গের নন্দনকানন, একঝলক দেখে বোঝাই সম্ভব নয় এর ভয়াবহতা
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/04/Sudarshan-1-1.jpg)
যোগা-প্রাণায়াম: শরীর-মনকে সুস্থ রাখতে করুন সুদর্শন ক্রিয়া, বিশ্রাম নিন যোগনিদ্রায়
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/09/Roddur-O-Amalkanti_pic.jpg)
নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/২
যুবক চুপ করে খানিক ভাবল।
− আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথমে ছিল পাবনা ইনিস্টিটিউশন তারপর পাবনা কলেজ বলা হতো। কিন্তু দাঙ্গায় বাড়িঘর পুড়ে মা-বাবা, বিধবা ঠাকুমা, ছোট ভাই বোন সব একরাতে শেষ হয়ে গেল। বনগাঁ আসার পর থেকে কাজের চেষ্টা করে গিয়েছি। কলকাতা আসা-যাওয়ার পথে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এক এজেন্টের কাছে পাঠালেন। মানিকতলা বাজারের পেছনে ভদ্রলোকের বাড়ি। ওঁরা বংশপরম্পরায় ইনস্যুরেন্সের কাজ করতেন। ওঁর দাদু ছিলেন পুরনো ওরিয়েন্টাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট। তাঁর বাবাও এই কাজ করতেন। আমাকে এজেন্টের এজেন্ট হতে হয়েছিল। তিনি ব্যস্ত মানুষ, তাই তাঁকে নতুন খদ্দের ধরে দিতে হবে। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম খুব একটা সুবিধা কিছু হচ্ছে না। লোকের পেছনে ঘুরে ঘুরে চটি ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু খদ্দের জোটাতে পারছি না। কিন্তু খদ্দের না দিতে পারলে কমিশন নেই। যাতায়াতের গাড়ি ভাড়াও পাবো না। দাদুর কাছে ইংরেজিতে কথা বলতে শিখেছিলাম। একবার এক সাহেবের খোঁজ পেলাম। এই ক্লাইভ রো-তেই জারডিন হাউসে সাহেবের কাছে গেলাম। সাহেবকে খালি পাব ভেবে সকাল সকাল গিয়েছিলাম। সাহেব ব্যস্ত থাকার অজুহাতে দেখা করলেন না। কিন্তু মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারা মাসে একটা ক্লায়েন্ট যোগাড় করতে না পারলে আমার সারা মাসের খাটনি গাড়ি ভাড়া সব চলে যাবে। জেদ চেপে গেল। জলটুকু না খেয়ে সারাটা দিন গেটের কাছে বসে রইলাম। জল খেতে উঠে গেলে যদি সেই ফাঁকে সাহেব চলে যান। —চলবে
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/10/samayupdates_Novel-2.jpg)
জোড়বাংলা মন্দির, রাঘবপুর,পাবনা। (ছবি: সংগৃহীত)
পরের পর্ব আগামী রবিবার
শুধু বিনয়কান্তি নন, গোটা পরিবারের একজন শুভানুধ্যায়ী হয়ে উঠেছিলেন অকৃতদার তারক নিয়োগী। বিনয়কান্তি বা এই পরিবারের জীবনে সবটুকুই সাফল্য – সবটুকুই আলোর রোশনাই নয়। আঘাত বা ব্যর্থতার ঘন অন্ধকারও রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিনয়কান্তি দত্তের মতো আদ্যন্ত সফল একজন মানুষও সেই অন্ধকারে দিশাহারা হয়ে গিয়েছেন। ধীর-স্থিরভাবে বিনয়কান্তির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সাহায্য করেছেন সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন এই ছোটখাট চেহারার দৃঢ় মানসিকতার লোকটি। তাই বিনয়কান্তি তারক নিয়োগীকে বলতেন, অরিয়ন। কালপুরুষ। গোটা পরিবার বা বসুন্ধরা ভিলার নিঃশব্দ দিকনির্দেশক।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।