সততা বা নিষ্ঠা এক নির্ভীক নির্মল আনন্দ দেয়।
।। গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি (ক্রমশ)।।
বিনয় বলে,
− দেখুন কেদারবাবু আপনার অসুবিধের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে এখনই বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি ছিলাম না তাই আমাদের একটু সময় দিতে হবে। আসলে এখন অফিসে আমার কাজের চাপটাও খুব বেড়ে গিয়েছে। আগের মতো নিয়ম করে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসতে পারি না। সব শনিবার ছুটিও পাই না। কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি খুঁজে আমরা উঠে যাব।
− উঠে যাব মানে? আমরা কি একবারও তোমাদের উঠে যেতে বলেছি?
বিনয় জানায়,
− সেটাই তো আপনাদের সমস্যার সমাধান হবে। ভাড়াটে-সমেত বাড়ি বিক্রি করতে সত্যিই অনেক অসুবিধা। বাড়ির নতুন মালিকের পুরনো ভাড়াটে বা পুরনো ভাড়া দুটোই অপছন্দ হতে পারে।
পালবাবু পালগিন্নির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন,
− আমার শ্বশুর মশায়ের নিজের পছন্দ করা সম্পত্তি। যাকে তাকে দুম করে বাড়ি তো আমরা বেচবো না বিনয়কান্তি।
হতবাক বিনয় বলে ওঠে,
− তার মানে!!
মানেটা কেদারবাবু বুঝিয়ে দিলেন। বিনয়কান্তির বয়স অল্প। এখনও বিয়ে-থা হয়নি। সুতরাং ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করার মর্ম সে এখনও বোঝেনি। বাবা মা হওয়ার দায় এবং দায়িত্ব দুটোই কঠিন। কখন সন্তানকে আগলে রাখতে হবে আর কখনই-বা সে আগল খুলে দিতে হবে সেটা বাবামা-ই সবচেয়ে ভালো বোঝেন। কেদারবাবুর শ্বশুরমশাই কালীকৃষ্ণ দে ফার্নিচারের ব্যবসা ছেলেদের হাতে ছাড়েননি। সে ব্যবসার মুনাফার টাকা ছেলেদের হাতে দিয়ে বলেছিলেন তার পুরনো নার্সারি ব্যবসাটা আবার শুরু করতে। দুই ছেলে একসঙ্গে মিলে বড় করে নার্সারি ব্যবসা শুরু করল। প্রথম চোটেই লোকসানে দমে গেল দু-ভাই। বাবা সাহস দিলেন, ব্যবসা জমানোর কোনও সহজ ফর্মুলা নেই। এক-এক ব্যবসা এক একজন এক এক রকম ভাবে দাঁড় করাতে পারে। ধাক্কা না খেলে জীবনে শেখা যায় না। ব্যবসা হল ধাক্কা খেয়ে শেখার, মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর শিক্ষা। তিনি এক রকম ভাবে ঠেকতে ঠেকতে শিখেছেন তার ছেলেরা অন্যরকমভাবে শিখবে। ছেলেরা শিখল এবং ঘুরে দাঁড়ালো।
বিনয় উপলব্ধি করলো কথাগুলো সত্যি। কর্তাবাবু গিরিজাশঙ্কর গুহ যে দক্ষতায় তার পাটের ব্যবসা সামলাতেন, তার ছেলেরা সেভাবে ব্যবসা সামলাতে পারত না।
কেদারবাবু বলেন,
− শ্বশুরমশাই বলতেন, বাপের ব্যবসায় ছেলেরা হয় ঝুঁকি নিতে ভয় পাবে, না-হয় চিন্তাভাবনা না করেই সিদ্ধান্ত নিতে থাকবে। আজ নার্সারির ব্যবসা এত বড় হয়ে গিয়েছে যে তারা সেখান থেকে ফার্নিচারের ব্যবসার জন্যে সময় বার করতে পারছে না। তাদেরও অনুরোধ আমি ফার্নিচারের ব্যবসায় তার বাবাকে সাহায্য করি। যে কারণে আমি আর না করতে পারছি না। আর বাকি রইলো আমার মেয়ে- জামাইরা। ঠাকুরের আশীর্বাদে তারা তিনজনেই প্রতিষ্ঠিত। তবে আমার একটি মেয়ে থাকলে হয়তো আমি তাকে এ বাড়ি লিখে দিতাম। কিন্তু তিন মেয়ের মধ্যে আমি কম-বেশি করতে চাই না।
এতক্ষণ কথা বলার পর কেদারবাবু চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বিনয় পাশ থেকে মহিলার মুখ দেখতে না পেলেও এটা স্পষ্ট অনুভব করল যে তিনি স্বামীকে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। চায়ের কাপ রেখে বাড়িওয়ালা কেদার পাল বললেন,
− আমি চাই। মানে আমরা দুজনেই চাই আমরা চলে যাবার পর তোমরাই ওপরতলাটায় এসে হাত পা ছড়িয়ে থাকো।
বিনয় চমকে উঠে বলল,
− আমরা? আমি আর মা, মাত্র দু’জন লোক আমাদের এত জায়গা কী হবে?
− আরে বাবা আজ দুজন আছে বলে তো চিরকালই দুজন থাকবে না। মাসিমা আমায় বলেছেন আজ বাদে কাল তোমার বিয়ে হবে। বিয়ের পর আত্মীয়-স্বজনের যাওয়া-আসা থাকবে। ছেলেপুলে হবে, তখন তো জায়গা লাগবে।
− না মানে সেসব তো অনেক দূরের কথা। আর ভাড়ার ব্যাপারটাও তো ভাবতে হবে।
কেদার পাল অভয় দেন,
− ভাড়ার ব্যাপারে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। ভাড়া এক পয়সাও বাড়বে না সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
বিনয় মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙলেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। কেদারবাবু বিনয়ের চমক ভাঙিয়ে বলেন,
− ভাবছো তো কেদারবাবুর হল কী? শোন বিনয়। আমার স্বার্থ হল একজন ভদ্র সৎ মানুষের হাতেই বাড়িটা ছেড়ে যাওয়া। টাকা দিয়ে ভরসা কেনা যায় না। বাজারে অনেক কালোয়ার ওত পেতে বসে আছে, তাদের হাতে আমি বাড়িটা দেব না। যতদিন না আমি কোনও ভদ্র পরিবার পাচ্ছি নিচের ঘর দুটো বন্ধ থাকবে। সে ভাড়াটের দায়-দায়িত্ব তোমায় কিছু নিতে হবে না। সেসব ব্যবস্থা আমি করব। তুমি শুধু মাসিমার সঙ্গে কথা বলে আমায় জানাও আমরা একটু নিশ্চিন্ত হই। ও হ্যাঁ তোমাকে জানানোর জন্য বলি, এই বিষয়ে আমি আমার স্ত্রী আমাদের তিন মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। তাদের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি, তাই তোমরা কেমন মানুষ সেটা আমাদের কাছে শুনেছে। কিন্তু তাদের মা-বাবার ওপর ভরসা আছে। তাদের কারও এতে কোনো আপত্তি নেই।
শেষপাতে মিষ্টির মতো পালগিন্নি জুড়ে দিলেন,
− আমি জানি মাসিমা রাজি হবেন শুধু তুমি আপত্তি করো না বিনয়।
বসুন্ধরা ঠাকুরঘরে পুজো করছিলেন, সেখানে বসেই বিনয়ের কাছে সব শুনে আরাধ্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন।
কেদারবাবু জানালেন দুটো শোবার ঘরে সেগুনকাঠের পালঙ্ক বড় আলমারি রাখা আছে। সেগুলো সব খালি করে নিজেদের মিস্ত্রী দিয়ে একপ্রস্থ পালিশের ব্যবস্থা করা হবে। বসার ঘরে বড় সোফাসেট সেন্টার টেবিল, রান্নাঘরের বড় মিটসেফ, ঘেরা বারান্দায় বড় খাবার টেবিল ছজনের বসার চেয়ার রয়েছে। সেগুলোও ঝেড়ে মুছে সাফ করে দেওয়া হবে। এসব তাঁর শ্বশুরমশাই নিজে ডিজাইন করে বানিয়ে দিয়েছেন। বিনয়ের আপত্তি না থাকলে এগুলো তাঁরা রেখে যেতে চান। এসব মাহিয়ারির বাড়িতে ফেরত পাঠালে শ্বশুরমশায় হয়ত মনে মনে কষ্ট পাবেন। তবে পুরোনো বিছানাপত্র সব সরিয়ে নেওয়া হবে। পালগিন্নি কেদারবাবুর যথার্থ সহধর্মিনী। কেদার পালের কথায় কোনও ফাঁক থেকে গেলে, পালগিন্নি সঙ্গে সঙ্গে সেটি পূরণ করে দেন। তিনি যোগ করলেন, বিনয়ের বিয়ে-থা হলে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে খাট বিছানা আলমারি তো নিশ্চয়ই দেবে। তখন নয় একটা ঘরের আসবাবপত্রের একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৫: বসুন্ধরা এবং…
বাতের ব্যথায় কাবু? এই পানীয়তে রয়েছে জাদু
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল
পর্ব-১১: প্রবীণদের টিকা—আপনি নিয়েছেন তো? প্রথম পর্ব
− আপনাদের সব প্রস্তাব আমি মেনে নেব। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আপনাদের রাখতে হবে। সেটাতে না বললে শুনবো না।
কেদার পাল নিশ্চিন্তভাবে বললেন,
− আচ্ছা বল তোমার কী অনুরোধ?
− ভাড়াটা কিন্তু আমি আমার সাধ্যমত বাড়িয়ে দেব। কতটা কী দিতে পারব জানি না, তবে সামান্য হলেও বেশি ভাড়া দেবো। সেটাতে কোন আপত্তি শুনবো না।
অবাক কেদার পাল বিনয়ের দুটো হাত ধরে বলেছিল,
− বয়স অনেক হল। তিন মেয়েকে মানুষ করেছি, তাদের বিয়ে দিয়েছি। এতদিন সাহেবি কোম্পানিতে কাজ করছি। মানুষ আমি অনেক দেখেছি বিনয়কান্তি। কিন্তু তোমার মতো সৎ মানুষ আমি কখনও দেখিনি। মনে হয় এ জীবনে আর দুটি দেখতেও পাবো না ! তুমি অনেক বড় হও বাবা! ঈশ্বর তোমায় দুহাত ভরে আশীর্বাদ করুন।
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]
যোগা-প্রাণায়াম: গ্যাস-অ্যাসিডিটির সমস্যায় জেরবার? যোগাসনে মিলবে মুক্তি
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার
ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন
− শোনো দাদুভাই! জীবনের সৎভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে তোমায় অবিরত লড়াই করতে হবে। সৎ অসৎ-এর লড়াই, ভালো-মন্দের লড়াই, সুসময় – দুঃসময়ের লড়াইতে তোমায় জিততে হবে। তাই তোমার শরীর আর মনটাকে কঠিন করে গড়তে হবে। যাতে হতাশা অবসাদ দুঃখ যন্ত্রণা কিছুতেই কখনও তোমায় ভাঙতে না পারে।
বাবা জানতেন জন্ম থেকে নিজের বাবাকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা বিনয়ের শিশুমনে কতটা গভীরভাবে দাগ কেটে গিয়েছে। তাই বিনয় তিনি দু’হাতে আগলে রেখে মানুষ করেছিলেন।
যোগব্যায়াম সেরে ভেজানো ছোলা কয়েক কুচি আদা সামান্য ভেলিগুড় সহযোগে দুটি ইংরেজি কাগজ ওল্টানো। একটির নাম ‘দ্য স্টেটসম্যান’ অন্যটি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। বিনয়ের খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার সময় রাতে খাবার পর। শোবার আগে। চা বাগান সামলালেও বিনয়ের চা খাবার নেশা খুব একটা নেই। সে আয়েস করে চা খায় রোববার। সকালে আবার বিকেলে। বা কোনওদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে। কখনও-সখনও ইচ্ছে হলে। কাগজ রেখে বাজার আর মাছের থলে হাতে বিনয় ছোটে হাতিবাগান বাজারে। এই গ্রে স্ট্রিট ধরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটটা টপকে গিয়েই বাঁদিকে। বিনয়কে আবার কাজের তাগিদে কখন কোথায় যেতে হবে, বাজার না হলে তো মায়ের খাওয়া হবে না। তাই সে মাকে মুদিখানার দোকান ওষুধের দোকান বাজার সঙ্গে নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে এসেছে।
বিনয়ের জানার ইচ্ছে শেষ নেই। যেকোনও বিষয় সে খুঁটিয়ে জানবার চেষ্টা করে। তার মধ্যে কিছু কিছু সে বসুন্ধরাকে গল্পের ছলে বলে। রাতে খাবার সময়টা হল এই সব গল্পের সময়। তেলিপাড়ার লেনের বাড়িতে অফিসের গল্প করতো বটে, এখন আর অফিসের কথা বেশি বলে না।
দুপুর বেলাটা ঠাকুরঘরেরই কাটে বসুন্ধরার। সকালে বাজার থেকে আনা ফুল দিয়ে মালা গাঁথে। ঠাকুরের আসন পরিষ্কার করে। ধুপধুনো জ্বালিয়ে ঈশ্বরকে বলে,
− হে ঈশ্বর!! বিনয়ের পরিশ্রম, তার সততার মূল্য যেন সে পায়। আর পাঁচটা ছেলের মতো সহজ জীবন সে পায়নি। অনেক লড়াই অনেক সংগ্রামের পর সে এখানে পৌঁছতে পেরেছে। তুমি তাকে এগিয়ে দিও! সব কাজে তার সহায় হও! তাকে সুস্থ রেখো! — চলবে
মানুষ কেবল চেষ্টা করতে পারে – সফল হওয়া ঈশ্বরের করুণা।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
অমৃতবাজার ইংরেজি পত্রিকা হলেও খাঁটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। যশোরের মাগুরাতে থাকতেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হরিনারায়ন ঘোষ। তাঁর স্ত্রীর নাম অমৃতময়ী। এই পরিবার এই মাগুরায় একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন অমৃতময়ীর নামে। যার নাম ছিল ‘অমৃতবাজার’।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।