নিরীহ পরিশ্রমী মানুষের জন্যে কিছু করতে পারাটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ (ছবি সংগৃহীত)।
।। গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি।।
কলকাতায় ফেরার পর বিনয়কান্তির ভূয়সী প্রশংসা করে পিটারসন জানালেন — তিনি নিজেও আছাবাম চা বাগানের অংশীদারী মালিকানা ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, তা নিয়ে মনের মধ্যে যথেষ্ঠ দোটানা ছিল। কিন্তু বিনয়কান্তি পুরো বিষয়টা যেভাবে যুক্তি দিয়ে ভেবেছে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যার গভীরে গিয়ে যেভাবে এই রিপোর্ট বানিয়েছে, তার কোনও তুলনাই হয় না। বিনয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পিটারসন ঠিক করলেন, বাগানের মালিকানা বিক্রি করে তিনি যে টাকা পাবেন, তার থেকে তাঁর লগ্নীর টাকাটুকুই তিনি নেবেন বাকি প্রায় কুড়ি শতাংশ টাকায় আছাবাম চাবাগানের শ্রমিক-কর্মচারীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবেন।
বিয়ের পর বিনয়কান্তি স্বর্ণময়ীকে নিয়ে আছাবাম চা বাগান ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছিল। শ্রমিক-কর্মচারীর চিকিৎসাখাতে টাকার খরচপত্র রাখত একটা ছোটখাট সমিতি। তাতে ছিল স্থানীয় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিনিধি বাগান কর্তৃপক্ষের এক দু’জন। তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। বাগানের পুরোনো লোকজনের সঙ্গে দেখা করে ফিরে গিয়েছে। বাংলোতে থাকেনি। তবে বাগানের সকলের একদিনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
বিয়ের আগে পর পর দুটো আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। অসম থেকে ফেরার পর পরই এক রোববার বাড়িওয়ালা কেদারবাবু ওপরের ঘরে ডাকলেন। বিনয় ভেবেছিল ওরা মাসখানেক বাড়িতে ছিল না, ভাড়া বাকি পড়েছে সেই বিষয়ে কথা বলতে বাড়িওলা ডেকেছেন। বিনয় বাড়িভাড়ার টাকা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। তাই চেয়ারে বসার আগেই বুকপকেটে হাত দিয়ে টাকাটা বার করে টেবিলে রাখল। কেদার পাল হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
আরে এ কী কাণ্ড! টাকা-পয়সা বের করছ কেন?
আঁজ্ঞে আমরা গেল মাসের আগের মাসে, মাস শেষ হবার আগেই রওনা দিয়েছিলাম। আর ফিরলাম এক মাস কাটিয়ে।দু’দিন অফিসে খুব চাপ ছিল। আসতে পারিনি। আমাদের দু’ মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে গিয়েছে।
আমি কি তোমার কাছে বাড়িভাড়া চেয়েছি বিনয়?
কেদার পাল টাকাটা হাতে নিয়ে টেবিলের পেতলের ফুলদানিতে চাপা দিয়ে রাখলেন। বোঝা গেল ভাড়ার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কেদারবাবু কথা বলবেন। পাল বউদি চা-বিস্কুট নিয়ে এলেন। এরপর কেদারবাবু যা বললেন সেটা বিনয় আশা করেননি।
গ্রে স্ট্রিটের মতো জায়গায় বাড়ি হলেও কেদার পাল আদপে কৃষ্ণনগরের ছেলে। দর্জিপাড়ার রথতলার মোড়ের কাছে বাড়ি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। দাদু মূর্তি গড়তেন। বাবাও মূর্তি গড়ার পেশাই বেছে নিয়েছিলেন। বড় দু’ভাই পৈতৃক পেশাই বেছে নিল। পরের জন সেজছেলে কেশব লেখাপড়া শিখে স্কুল মাস্টার হলেন সেই সেজদাই কেদারের আদর্শ। কেদারের স্বপ্ন সে বড় হয়ে কলকাতায় সাহেবি কোম্পানিতে কাজ করবে। কলকাতা শহরে থাকবে। সাহেবি কোম্পানিতে কাজ পাবার একটা সহজ রাস্তা হল ভালো করে স্টেনোগ্রাফি শেখা। স্বপ্ন সফল হল। কাজ পেল নামকরা ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা ম্যাকমিলান কোম্পানিতে। কৃষ্ণনগর থেকে যাওয়া-আসার খুব অসুবিধে তাই কেদার কলকাতায় থাকতো শিয়ালদার কাছে একটা মেসে।
হাওড়ার মাহিয়ারি থেকে ব্যবসার কাজে প্রতি শনিবার বৌবাজারে আসতেন কালীকৃষ্ণ দে। মাহিয়ারিতে তাঁর কাঠের ফার্নিচারের বড় ব্যবসা। দু’ছেলে দুই মেয়ে। বউবাজারের অনেক নামী ফার্নিচারের দোকানের আসবাব মাহিয়ারির খটির বাজারে দে-বাবুর কাঠগুদামে তৈরি হতো।
ষাট পেরিয়ে, পর্ব-৮: বয়সকালে ওষুধ তো খাচ্ছেন, কিন্তু নিয়ম মেনে খাচ্ছেন তো?—প্রথম ভাগ
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে
ছোটদের যত্নে: সন্তান জ্বরে ভুগছে? কী ভাবে সামলাবেন? রইল ঘরোয়া চিকিৎসার খুঁটিনাটি
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৪: অবশেষে দময়ন্তী ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে…
ত্বকের পরিচর্যায়: টানটান ত্বক চাই? বয়স ধরে রাখতে মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি
ভদ্রলোক জানালেন, রোদের তেজে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো হাত পা ভাঙেনি। ডান হাতের কব্জি আর কনুইয়ের কাছে একটু ছড়ে মতো গিয়েছে। কেদার বলল সামনেই তার মেসবাড়ি। নিজেদের মেসবাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালো। ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো ভালো করে জলে ধুয়ে মেসের অফিসঘরে রাখা টিনচার আয়োডিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তখন কেটেকুটে গেলে ইনফেকশন আটকাতে এই অল্পমাত্রায় আয়োডিন মেশানো অ্যালকোহল সল্যুশন লাগানোর খুবই চল ছিল।
মেসের ঠাকুরকে ডেকে এককাপ আদা দেওয়া গরম চা খাওয়াতে ভদ্রলোক বড় সুস্থবোধ করলেন। তবু কেদার তাঁকে একা না ছেড়ে ফিটনে চাপিয়ে হাওড়া স্টেশন পাঠাল। এভাবেই কালীকৃষ্ণ দে’র সঙ্গে জগদীশ্বর, কেদার পালের পরিচয় ঘটালেন। কালীকৃষ্ণের দুটি ছেলের পর দুটি মেয়ে।
বড় মেয়ে বিভারাণী কালাজ্বরে মাত্র বারো বছর বয়েসে পৃথিবী ছেড়ে যায়। তাই কালীকৃষ্ণের সবকিছু জুড়ে তার ছোটমেয়ে বীণাপাণি। তাকে তিনি সুপাত্রস্থ করতে চান। কেদারকে তার খুব পছন্দ হল। তিনি চাইলেন জামাই মাহিয়ারি থেকে কলকাতায় আপিস যাতায়াত করুক।
কেদার সবিনয়ে জানিয়েছিল মাহিয়ারিতে থাকার অসুবিধা আছে। এখন মেসে থাকে পরে সে একটা বাড়ি ভাড়া করে নেবে। কালীকৃষ্ণ বুদ্ধিমান। কেদারকে জোরাজুরি করেননি। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কালীকৃষ্ণ সস্ত্রীক গেলেন কৃষ্ণনগরের দর্জি পাড়ায়।
বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-১২: সত্যজিৎ রায়ের শ্যুটিং দেখার সেই স্বপ্নপূরণের ঘটনা আজও ভুলতে পারিনি
হোমিওপ্যাথি: টনসিলের ব্যথায় নাজেহাল? এই সব উপায়ে মিলবে আরাম
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক
ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াতেও ফুলতে পারে পা, জেনে নিন কী করণীয়
ধুলো-পা করতে আসা মেয়ে-জামাইকে নিয়ে মোটর ভাড়া করে কালীকৃষ্ণ পৌঁছলেন গ্রে-স্ট্রিটের এই বাড়িতে। বিয়ের সময় পাঁচজনের সামনে বাড়ি যৌতুক দেওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হলে, বলা যায় না জামাইয়ের হয়তো মানে লাগত। তাই কালীকৃষ্ণ মুখে কুলুপ এঁটেছিল। আগে থেকে বাড়ির দানপত্র তৈরি ছিল। উকিল ডেকে সইসাবুদ সেরে ফেলল। সাক্ষী তার ছেলেরা বীণার দুই বড় দাদা। কালীকৃষ্ণ যুবক বয়সে নার্সারির ব্যবসা দিয়ে শুরু করেছিলেন।পরে ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন। ফার্নিচারের ব্যবসা বেড়ে উঠল। নার্সারির ব্যবসায় অত সময় দিতে পারতেন না কালীকৃষ্ণ। ছেলেরা বড় হতে তারা খেটেখুটে নার্সারির ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে ফেলল। দুই ছেলের নামে নার্সারির ব্যবসা লিখে দিলেন। মাহিয়ারির দূর্গামাতা নার্সারির নাম ছড়িয়ে পড়ল নানাদিকে। এদিকে কে কে ফার্নিচারসও রমরম করে চলছে। এক এক করে কেদার-বীণাপাণির তিন মেয়ে হল তারা বড় হল। যথাসময়ে তাদের বিয়ে-থা হল।
কেদারের চুলে পাক ধরল। কৃষ্ণনগরের বাড়ি বা সামান্য জমির ভাগ নেয়নি কেদার । তার সেজদা কেশবের দুই ছেলেকে লিখে দিয়েছে। ভালো ভাড়াটে না পেলে বিনয়রা নেবার আগেও নিচতলা খালি রেখেছে কিন্তু ভাড়া দেয়নি। স্বামী-স্ত্রী আদ্যামা’র ভক্ত। মায়ের কৃপায় সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা পারিবারিক সমস্যার সূচনা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছেন যে একমাত্র বিনয়কান্তি সাহায্য করতে পারে।
রোববারের সকাল। চা খেতে খেতে কেদারবাবু স্মৃতিচারণা শুনতে খারাপ লাগছিল না বিনয়কান্তির। কিন্তু কালীকৃষ্ণ উপাখ্যানে হঠাৎ করেই বিনয়ের প্রবেশে সে হতভম্ব হয়ে গেল।
আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছিনা কেদারবাবু আমি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
পালদম্পতি একবার পরস্পরের দিকে তাকান। তারপর কেদারবাবু বলেন
দেখুন আমার শ্বশুর মশাই হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার বিয়ের সময় তিনি চেয়েছিলেন আমি মাহিয়ারি বাড়ি থেকেই কলকাতায় অফিস যাতায়াত করি। কিন্তু আমি তা চাই নি বলে তিনি কোনও জোর করেননি। আবার যাতে আমার কোন অসুবিধে না হয় তাই গ্রে স্ট্রিটের এই বাড়ি আমাদের দুজনকে যৌতুক দিয়েছেন। এতদিন এই বাড়িতেই আমি থেকেছি এখান থেকেই আমার তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে ।এখন আমার শ্বশুর মশাই চান তাঁর এই বিপদের সময়ে ব্যবসার কাজে আমি তাকে সাহায্য করি। আমার চাকরি আর বছরখানেক। গ্রে স্ট্রিট-এ থেকে মাহিয়ারিতে ব্যবসা চালানো সম্ভব হবে না। শ্বশুরমশাইয়ের পক্ষে এখনই কাঠগোলায় গিয়ে বসা সম্ভব নয়। তার দুই ছেলের নার্সারির ব্যবসা এত বেড়ে গিয়েছে তাদের পক্ষেও নিজেদের সে ব্যবসা ছেড়ে বাবার ব্যবসায় সময় দেওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। আর আমার শ্বশুরমশাই আর দুই শালা ব্যবসায় থাকার কারণেই এটা বুঝতে পেরেছি ব্যবসার কাজটা আপিসের চাকরি নয়। ২৪ ঘণ্টা মনপ্রাণ না দিতে পারলে তার উন্নতিও হয় না বা ব্যবসার উন্নতি ধরে রাখাও যায় না। তাই আমাদের গ্রে স্ট্রিট-এর বাড়ি ছেড়ে মাহিয়ারীতে গিয়ে থাকতে হবে। আমার চাকরি যে কদিন রয়েছে সে কদিন তো আপিস করতেই হবে সোম থেকে শুক্র সকালটা কাঠগোলায় আমার স্ত্রী বসবেন। সন্ধ্যেবেলাটায় আমি থাকব। এছাড়া শনি-রবি ছুটির দিনটাও কাজে লাগাতে পারব।
বিনয়ের কাছে এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। কেদারবাবুরা মাহিয়ারিতে চলে যাবেন মানে গ্রে স্ট্রিট-এর এবাড়ি তাঁরা বিক্রি করে দেবেন। এখন বিক্রি করলে কে কিনবে? তারা বিনয়দের ভাড়াটে হিসেবে রাখতে রাজি হবে কিনা? স্বাভাবিকভাবেই এ সব নানা প্রশ্ন উঠবে। আর অনেক ক্রেতাই ভাড়াটে সমেত বাড়ি কিনতে রাজি হবে না।
তাই কেদারবাবু সকালবেলা আপ্যায়ন করে ডেকে পাঠিয়েছেন। সময় থাকতে থাকতে তাতে তারা অন্য ভাড়াবাড়ি খুঁজে নিতে পারে। ভাড়াবাড়ি খুঁজলে নিশ্চয়ই পাবে। আর এখন বিনয়ের সামর্থ্য অনেক বেড়েছে। কিন্তু অর্থের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দায়িত্ব এতটাই বেড়েছে যে বাড়ি-খোঁজা বা বাড়ি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় তার এখন নেই। কিন্তু এই নতুন অবস্থার জন্যে তো সে তৈরি ছিল না। একটা আচমকা বিপদই বলা যায়। ঠিক আছে। সমস্যা যখন তার সমাধানও আছে। নৌকো যেমন একই চরে বাঁধা থাকেনা- বিনয়কান্তির জীবনও তেমন ঠেকতে ঠেকতে ভাসতে ভাসতে চলেছে। ঠিকানা ঈশ্বর খুঁজে রেখেছেন। — চলবে
নৌকো একই চরে থেমে থাকে না।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
শোনো দাদুভাই ! জীবনের সৎভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে তোমায় অবিরত লড়াই করতে হবে। সৎ অসৎ-এর লড়াই, ভালো-মন্দের লড়াই, সুসময় দুঃসময়ের লড়াইতে তোমায় জিততে হবে। তাই তোমার শরীর আর মনটাকে কঠিন করে গড়তে হবে। যাতে হতাশা অবসাদ দুঃখ যন্ত্রণা কিছুতেই কখনো তোমায় ভাঙতে না পারে।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।