এক কাপ চায়ে...
আছাবাম চা-বাগিচা, নাহারকাটিয়া
পাহাড়ের কোলে ছবির মতো বাংলো। বেশ বড়সড়। নিচে গেট থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে — ওপরে আবার একটা গেট টপকে — মস্ত একটা টানা-বারান্দা। পাশাপাশি চারটে বড় বড় ঘর। রেলিং ঘেরা ঢাকা বারান্দায় নানান কাঠের আসবাব। নাহারকাটিয়ায় সারা বছর বৃষ্টি। এপ্রিল থেকে অক্টোবর টানা বৃষ্টি হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি অল্পস্বল্প। আবার মার্চ মাসে শুরু হয় বর্ষার প্রস্তুতি। অদ্ভুত ব্যাপার মার্চ মাসে রাতের দিকে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে। প্রায় ৬/৭ ডিগ্রি। এখানে বাংলোগুলোর বারান্দায় ঢালু কাঠের ছাদ। অনবরত বৃষ্টির কারণেই বোধহয় বারান্দা শেষ হবার পরেও মাথার ঢালু ছাদ অনেকটা আগিয়ে থাকে। পাহাড়ি জায়গা জন্তু-জানোয়ারের ভয় তো থাকেই — তাই বাংলোগুলো — জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে। নিচে — বাংলোর কাজের লোকদের থাকার জায়গা। তবে তাঁদের নিরাপত্তার কারণেও বাংলোতে আসার ওই একটাই রাস্তা — কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দুটো গেট টপকে।
বসুন্ধরা কখনও এরকম বাংলো চোখে দেখেনি। ফরিদপুরের বাখুন্ডায় গুহবাবুদের — বেশ বড় দোতলা বাড়ি ছিল। বড় বড় খিলান দেওয়া দরজা-জানালা ছিল। ভিতর বাড়িতে বড় উঠোন ছিল। কোটালিপাড়ায় বসুন্ধরার বাবা মুকুল সেনগুপ্ত প্রথমে মাটির দোতলা বাড়িতে থাকতেন। তিনি শিক্ষকতা করতেন — কিন্তু ছেলেরা কেউ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়নি — তারা কেউ জেলার সরকারি দপ্তরে কাজ করতো — ক’জন ব্যবসা করত। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হতে — মুকুন্দ সেনগুপ্ত পাকা দোতলা বাড়ি করলেন — কলকাতার ফড়েপুকুরে, তেলিপাড়া লেনে কিংবা হাতিবাগানের গ্রে স্ট্রিটে — বসুন্ধরা বড়লোকেদের বড় বড় বাড়ি দেখেছে — কিন্তু পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে ঘন সবুজ — চা বাগানের বুকে — ধবধবে সাদা এমন সুন্দর বাংলোবাড়ি সে কখনও দেখেনি। আছাবাম চা বাগানের সেই প্রভাবেই আজকের বসুন্ধরা ভিলার — ঘন সবুজ লন গাছপালার মধ্যে অমন ঝকঝকে সাদা প্রাসাদরূপ।
বিছানাপত্র ঘরদোর পরিষ্কার — সারা বাড়িতে ছড়ানো নানান আসবাব মোছামুছি, বাজার আনা কুটনোকাটা রান্না করা খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে দেওয়া মুখ ফুটে বলা মাত্র চা-জল দেওয়া এমনকি খাবার পর হাত-মুখ ধুয়ে হাত মোছার তোয়ালেটি ধরে রাখার জন্যেও লোক আছে। আর সে চায়ের যে কি স্বাদ!
ফড়েপুকুরের গুহবাড়ি বা তেলিপাড়া লেন থেকে বিনয়কান্তি ধুতি-শার্ট আর চটিজুতো পরে অফিস যেত। গ্রে স্ট্রিট থেকেও একই ভাবে অফিস যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু আসাম পাঠানোর আগে ক’দিন বিনয় শার্ট-প্যান্ট বুট জুতো পরে অফিস যাওয়া শুরু করলো। আছাবাম চা- বাগানে যেদিন পৌঁছল — সেদিনই বসুন্ধরা প্রথম ছেলেকে কোটপ্যান্ট পরতে দেখলো। বসুন্ধরার মনে পড়ে গেল পুরনো অনেক কিছু। মনে পড়ে গেলো সেই ভবিষ্যৎবাণীর কথা। মনে পড়ে গেল ফড়েপুকুর গুহবাড়িতেই রাতের পর রাত ঘুমোতে না পারা ছটফট করতে থাকা বিনুর সেই কথাগুলো
“গুহবাড়ির পাটের জমাখরচের হিসেব লিখে আর কচিবাচ্চাদের এবিসিডি পড়িয়ে জীবনের ইতি টানতে আমি রাজি নই। আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছি মা। একটা। একটা পাকা চাকরির সুযোগ। যেখানে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারব। যেখানে নিজের উন্নতি করা যাবে। যেখানে পরিশ্রম করার উৎসাহ পাওয়া যাবে। আর তুমিই তো ছোটবেলায় শিখিয়েছ মা— পাঁচজনের ভিড়ে মিশে থাকা একজন নয়—আলাদা করে পঞ্চমজন হয়ে উঠতে হবে।”
মনে পড়ে গেল স্বর্ণময়ীর বাড়িতে সকলের সামনে নিজের বলা কথাগুলো—
“কিন্তু শুভ কাজের জন্যে আমাদের একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। …আর বিনুও নিজেকে গড়ে নেওয়ার জন্য একটা বছর হাতে পাবে।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে জগদীশ্বরকে প্রণাম জানায় বসুন্ধরা — বাবার হাতে জলে ডুবে যে ছেলের ছ’মাস বয়সেই ভবলীলা সাঙ্গ হবার কথা — বাবার অবর্তমানে স্কুলছুট হয়ে লেখাপড়া না শিখে অদৃষ্টের পায়ে মাথা খোঁড়ার কথা — গুহবাড়ির পাট ব্যবসায় মাইনে করা আশ্রিত কর্মচারী হিসেবে বিধবা মাকে নিয়ে জীবন কাটানোর কথা — সে তো খাদ থেকে প্রতিকূলতার পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গড়ে তুলছে — বসুন্ধরার জীবনের সব আশা-ভরসা বিনয়কান্তি।
বাংলোতে বসুন্ধরার কোনও কাজ নেই। শুয়ে-বসেও সারাটা দিন যেন কাটে না। রান্নাঘরে গেলেও কাজের লোকেরা কোন কিছু ছুঁতে দেয় না— “মা-জী আইয়ে – মা-জী বলিয়ে” করতে করতে তারা অস্থির। রান্না করে যে, সে নেপালি। নাম বাবুরাম। ওর বউ চারুমতী। সকলে ‘চারু- চারু’ বলে ডাকে — বাবুরাম আর চারু বাংলা বোঝে — ভাঙ্গা-ভাঙ্গা বাংলা বলতেও পারে। দু’জনেই ধবধবে ফর্সা, টান-টান চামড়া — ছোট-ছোট টানা চোখ চ্যাপ্টা নাক। আর সবসময় হাসছে। ওরা অনেকদিন কলকাতায় রান্নার কাজ করেছে। বাংলোর দারোয়ান বিহারি – হাট্টাকাট্টা জোয়ান — মোটা গোঁফ — মুঙ্গেরের লোক। সূরয সিং। এছাড়া যারা বাংলোয় এটা-ওটা অন্যান্য কাজকর্ম করে — চক্রধ্বজ বয়স্ক লোক — সে বাংলোর গাছপালার দেখাশোনা করে — চানের ঘর ধোয়ামোছা করে — বাংলোর ভারী আসবাব সরিয়ে তার ছোটছেলের বউ ‘থুয়া’-কে ঘরদোর পরিষ্কারে সাহায্য করে। স্থানীয় ভাষায় ‘থুয়া’ মানে পবিত্র। চক্রধরের ছোটছেলে মানে থুয়ার বর হল — পুহর। পুহর মানে বসুন্ধরা ভেবেছিল বুঝি প্রহর। ভুল ভেবেছিল। পুহর মানে আলো। বসুন্ধরাকে এসব খুঁটিনাটি শিখিয়েছে চারু। দুপুরে ঘুমোলে রাতে ঘুম আসে না।
প্রথমে দিনকতক তো ওই দুধসাদা মখমলের মতো নরম বালিশ বিছানায় শুয়ে সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারতো না। ছোট থেকে বিনু তার সঙ্গে এক বিছানায় শুত। অন্য ঘর অন্য বিছানা সে সব কল্পনাও করতে পারেনি। কোটালিপাড়ায় নিজের বাবার বাড়িতেও ভাই-ভাইবউদের আশ্রিত ছিল বসুন্ধরা। বাবা বেঁচে থাকতেই হাবে-ভাবে সেটা ঊপলব্ধি করত — তবে কখনও বাবাকে সে কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি। বসুন্ধরা জানত কোটালিপাড়ার বাড়িতে তারা আশ্রিত— অতিথি। সে সংসারে তার কোনও দাবি নেই। তাই বাবা মারা যাবার পর — শ্রাদ্ধশান্তি মিটতেই ছেলের হাত ধরে বাখুণ্ডায় ফিরে গিয়েছিল। বাখুণ্ডার গুহবাড়িতে কত্তাবাবু কত্তামা ছেলে-বউরা দোতলায় থাকত। বসুন্ধরা থাকত একতলায়। — কলকাতার ফড়েপুকুরের বাড়িতে অত ঘরদোর ছিল না — রান্নাঘরের পাশে — যে ঘরটায় বসুন্ধরা আর বিনয় থাকতো — সেই ঘরেই মাসকাবারি ভাঁড়ারও থাকতো। তেলিপাড়া লেনের ভাড়া বাড়িতে তো উঠোনে রান্না আর একটা ঘরেই মেঝেতে বাসন-কোসন খাওয়া-দাওয়া আর পায়ায় ইঁট দিয়ে উঁচু তক্তপোশে শোয়ার ব্যবস্থা। গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে এসে একটা বসার ঘর হল। শোবার একটা আলাদা ঘর।
তবে মানুষ তো অভ্যেসের দাস। দিন কয়েক পরেই — বাংলোর সেই বিছানাতেই ঘুম আসতো — কিন্তু গোটা দুপুর চারুর সঙ্গে বকবক করত বসুন্ধরা। অভ্যেসের কথা মনে পড়তে নিজের খুব হাসি পেল বসুন্ধরার। এত কাল বসুন্ধরা ঘরোয়া ভাবেই পিঠ ঢেকে সামনে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরত। ফরিদপুর থেকে কলকাতার ফড়েপুকুরে আসা বা ট্রেনে কাশীতে যাবার সময় সেভাবেই গিয়েছিল। এছাড়া তো বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ বা প্রয়োজন হয়নি। এমনকি যেদিন বিনয়ের সঙ্গে বরানগরে স্বর্ণময়ীদের বাড়িতে গিয়েছিল সেদিনও তার অন্যথা ঘটেনি। এবার বদল ঘটলো। সব মানা বারণ অগ্রাহ্য করে — সে বদল ঘটাল বসুন্ধরার ভাবি পুত্রবধূ স্বর্ণময়ী।
— বাড়িতে অতিথি এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই মিষ্টি আনতে যাবেন — আমি অবশ্য ছানার মিষ্টির খুব একটা ভক্ত নই — সেইরকম নারকেল নাড়ু থাকলে নিশ্চয়ই খাব। তবে আমার জন্য অবশ্যই আপনাদের পাড়ার সিঙাড়া নিয়ে আসবেন। মা-বাবার কাছে ওই সিঙাড়ার এত গল্প শুনেছি!
বিনু বেরিয়ে যাবার পর — সে মেয়ে ব্যাগ থেকে বসুন্ধরার জন্য আনা শাড়ি চারখানা বার করলো। বসুন্ধরা সেসব দেখে অবাক হয়ে স্বর্ণময়ীর মা বাবাকে বলল,
— এসব আপনারা কি করেছেন? বিনুকে তো চেনেন ? এসব নিয়ে সে না আবার,
স্বর্ণ-র মা কণিকা বলে উঠলেন—
— বিশ্বাস করুন দিদি — এসব আমাদের বুদ্ধি নয়। আমরা জানি বিনয়কান্তি এসব ব্যাপারে খুব খুঁতখুতে — এসব নিয়ে যদি আপনার কিছু বলার থাকে তাহলে ওই মেয়েকে বলুন! আগে থেকে আমাদের এসব কিছু বলেনি। আসার পথে হাতিবাগানে নেমে এসব কিনে নিয়ে এলো।
বসুন্ধরা স্বর্ণময়ীর কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলেন,
— এসব কেন করতে গেলি মা। সে ছেলে যখন এসব জানতে পারবে সে যে কি করবে —
স্বর্ণময়ী তার উজ্জ্বল চোখের ফাঁকে কৌতুক এনে বলল,
—সে আমি সামলে নেব। শাড়িগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা বল।
স্বর্ণময়ীর আত্মবিশ্বাস দেখে — বসুন্ধরা ভারি খুশি হলেন। ভাবি বউমা ছেলেকে সামলে নেবে বলছে শুনলে শতকরা ৯৭ ভাগ মেয়েরা খুশি হবেন না। কিন্তু — বসুন্ধরা ওই তিন শতাংশের মধ্যে পড়েন। তিনি জানেন — যোগ্য হয়ে উঠতে গেলে স্বামীকে বুঝতে জানতে চিনতে হয়। সংসার করার ভাগ্য তাঁর ছিল না — কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছেন তার বিনুর জন্যে তিনি যেন এমনই এক যোগ্য সহধর্মিনীর খোঁজ পান। —চলবে
বসুন্ধরা ভিলার বাগান
বিনয়কান্তি মনে-প্রাণে আজীবন বিশ্বাস করতেন — শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না — কঠিন অধ্যাবসায়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে গড়ে নিতেও জানতে হয়। ভাগ্য সুযোগ দেয় কিন্তু দেরি না-করে সঠিক সময়ে উপযুক্ত সু্যোগটা বেছে নিতে হয়।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।