স্বপ্নের রং নীল?
স্বীকারোক্তি
মাকে নিয়ে বিনয়কে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে দেখে আনন্দমোহন বেশ অবাক হয়েছিলেন।
‘তোমরা এদিক থেকে আসছ?’
‘আজ্ঞে আমরা পদ্মাপারের মানুষ তো তাই মা-বেটা নৌকো চেপে চলে এলাম। আমার মা আবার হাতে টানা রিকশায় চড়বে না। পড়ে যাবার ভয়। তবে গ্রামের মানুষ তো জল-ডাঙ্গা দুটোতেই স্বচ্ছন্দ। গ্রে স্ট্রিট থেকে শোভাবাজার ঘাট পর্যন্ত হেঁটে চলে এলাম। তারপর গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে আপনাদের এই চৈতন্য ঘাটে এসে নামলাম। ঘাটে নৌকো বাঁধা আছে তাতে চেপেই ফিরে যাব।’
উত্তর শুনে যে এডভোকেট আনন্দমোহন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন সেটা বোঝা গেল।
বিনয় স্বর্ণময়ীর সঙ্গেই সরাসরি কথা বলতে চায় সেটা বুঝেই সামান্য কথাবার্তার পর নিজের স্ত্রীকে দিয়ে বিনয়কে দোতলার বিরাট ছাদে পাঠিয়ে দিলেন আনন্দমোহন। বসুন্ধরা খুব খোলা মনের মানুষ — আনন্দমোহনবাবুরা-ও সেরকম। না হলে সামাজিকভাবে বিবাহযোগ্যা ছেলেমেয়েরা একলা কথাবলার জন্যে সেই সময়ের অভিভাবকদের অনুমতি কিছুতেই পেত না। খোলা ছাদে হলেও না।
‘সোনামা, বিনয়কান্তি তার মাকে নিয়ে এসেছে। বিনয় তোর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চায়। কথা হলে তোরা নিচে আয়। দিদি একা আছেন আমি নীচে গেলুম।
ছাদটা পেল্লায়। গঙ্গার দিক থেকে হু হু করে হাওয়া আসছে। স্বর্ণময়ী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বিনয় একটা ব্যাপার খেয়াল করে খুশি হল। সচরাচর দেখতে এলে মেয়েদের গয়না গাটি ভালো শাড়ি দিয়ে সাজানো হয়। স্বর্ণময়ী কিন্তু সেই অর্থে সাজেনি। একটা হালকা কমলা রঙের বোধহয় রেশমের শাড়ি পরেছে। বেণী করা চুল। গলায় সরু একটা সোনার হার। কানে ছোট্ট সোনার দুল। হাতে চুড়ি-টুড়ির বালাই নেই। ও প্রান্ত থেকে কোনও কথা না শুনে বিনয় বাক্যলাপ শুরু করার চেষ্টা করে।
‘আপনাদের ছাদটা সত্যি খুব সুন্দর।’
‘এটা তো সব্বাই বলে। আপনার মুখে মানাচ্ছে না।’
‘হঠাৎ এই কথা কেন বলছেন? আমি কি সবার থেকে আলাদা নাকি?’
‘নিশ্চয়ই আলাদা। আলাদা না হলে বাড়িতে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা মা-বাবাকে কেউ মুখের উপর না বলে দেয়?
‘আমি তো না বলিনি। আমার আপত্তি আছে এটা বলেছিলাম।’
‘আপত্তি আর না বলার মধ্যে তফাৎটুকু হয়তো আপনি জানেন কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। ও হ্যাঁ আপনি বাড়িতে এসে মেয়ের মুখের ওপর না বলতে চেয়েছিলেন।’
‘আপনি ভুল বুঝছেন স্বর্ণময়ী দেবী।’
‘দেখুন বিনয়বাবু, মা-বাবা বা আমি যতটুকু বুঝেছি —আপনি বিয়েটা করতে চান না। তবে বিয়ে আপনার সঙ্গে না হলেও আপনি আমায় স্বচ্ছন্দে স্বর্ণ বলে ডাকতে পারেন। সে অধিকার আমি দিলাম। এসব দেবী টেবী আমার পোষায় না।’
এযাবৎ বিনয় মহিলা বলতে বাখুণ্ডার গ্রামের মেয়ে বউ দেখেছে। দেখেছে গুহ বাড়ির বৌ-মেয়েদের। কিন্তু তাঁরা কেউই স্বর্ণের মতো এভাবে এই ছন্দে কথা বলে না।
‘কি ভাবছেন? — বলুন বলুন। আমার দিদি জামাইবাবুরা আমার সম্বন্ধে যে কথা বলে সেটা আপনিই বা বলবেন না কেন? ওরা বলে বেশি বেশি গল্প উপন্যাস পড়ে আমি একটি বাচাল তৈরি হয়েছি। সমাজের কোনও বিবাহযোগ্যা মেয়ের যেরকম নম্র-ভদ্র সুশীলা হওয়া উচিত আমি তেমন নই। আমি বেশি কথা বলি — জ্ঞানের কথা বলি। তাই আমায় কেউ বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবে না।’
বিনয় এতক্ষণ এক ভাবে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনল — তারপর দূরগঙ্গায় একটা পালতোলা নৌকার দিকে তাকিয়ে খানিকটা আত্মগত ভাবে বলে গেল—
‘আপনার দিদি জামাইবাবুরা হয় ভুল বলেন নচেৎ তাঁরা মশকরা করেন। আপনি লেখাপড়া জানেন। আপনাকে দেখতে ভালো। স্বচ্ছন্দে আপনার বিয়ে আপনার দুই জামাইবাবুর মতোই যোগ্য বা তারও চেয়ে যোগ্য পাত্রের সঙ্গে হতেই পারে। আপনাদের পরিবার এবং আপনি যথেষ্ট খোলামনের মানুষ। না হলে আজকের দিনে আমাদের কেউ এ ভাবে একা একা কথা বলার সুযোগ করে দিতেন না। কিন্তু এই সুযোগটা না পেলেও যে নয়। আমার অনেক কথা বলার আছে যেগুলো সেদিন হাওড়া থেকে মধুপুর রেলযাত্রার মধ্যে বলা হয়নি —তাই আপনারও জানা হয়নি।’
স্বর্ণময়ীর ইচ্ছে থাকলেও সে বলতে পারছে না — সেদিন ওই ঘণ্টা সাতেকের রেল যাত্রায় দেখা দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী যুবককে সে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। স্বর্ণময়ী জানে — এই মুহূর্তে বিনয়কান্তির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস বিনয় নিজের চেষ্টায় ঠিক তার নিশ্চিন্ত ভবিষ্যত গড়ে নিতে পারবে। মধুপুর থেকে ফেরার পরে বড়দিদি-বড়জামাইবাবুর সঙ্গে বিনয়কে নিয়ে মা-বাবার বিস্তারিত কথা হয়েছে। আর যেহেতু তাঁদের বাড়িতে খোলামেলা পরিবেশ তাই স্বর্ণময়ী সেই সব আলোচনায় ছিল। স্বাধীন ভাবে সে তার মতামতও জানিয়েছে। সে বলেছে তার দেখে মনে হয়েছে ছেলেটি ভালো এবং সম্ভ্রান্ত। আনন্দমোহন বসু পেশায় অ্যাডভোকেট — তিনি তারাপদবাবুর কাছ থেকে ছেলেটি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়েছেন। তারপরই তাঁরা বিনয়কান্তির মায়ের কাছে যাবার কথা ভাবেন। কিন্তু এখন বিনয়কে বলতে দিতে হবে। ওর মনে যে দোটানা আছে সেটা শুনতে হবে।
‘না না — ছি ছি দয়া করে কিছু মনে করবেন না। আপনি বলুন’
‘যাকে শোনাব বলে এসেছি তিনি যদি অন্যমনস্ক থাকেন তাহলে বলবো কাকে? কী এত ভাবছিলেন?’
‘উত্তরটা একটু বেহায়ার মতো শোনাবে — তবু সত্যি কথাটাই বলি — একটু ভাবার চেষ্টা করছিলাম আমার চেনাশোনার মধ্যে আমার দুই জামাইবাবুর মতোই যোগ্য বা তারও চেয়ে যোগ্যপাত্র কে বা ক’জন আছেন?’
‘পেলেন?’
‘না। পিসি বড়ুয়া ছাড়া কাউকে তো পেলাম না কিন্তু তাঁর তো স্যার বীরেনের মেয়ে মাধুরীলতা সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে’—স্বর্ণময়ী নিজের রসিকতায় নিজেই খিলখিল করে হেসে ওঠে।
এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করে বাবাকে বলেন পুত্রসন্তান হলে তাঁর একমাত্র ভাই মানে আমার কাকার মৃত্যু ঘটবে। ছ’মাসে আমার অন্নপ্রাশনের দিন আমার কাকা মারা যান। চতুর্থীর কাজ সেরে বাবা আত্মগ্লানি নিয়ে দেশান্তরে যান। দীর্ঘ উনিশ বছর তাঁর কোন খোঁজ ছিল না। আমাকে নিয়ে আমার মা বাখুণ্ডা ছেড়ে আমার দাদামশাইয়ের বাড়িতে কোটালিপাড়ায় থাকতেন — দাদামশাই মারা যাবার পর বাখুণ্ডায় ফিরে এলেন। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়ের দরকার ছিল। গ্রামের এক সজ্জন ব্যবসায়ীর বাড়িতে আমার মা রান্নার কাজ করার জন্য বহাল হলেন। ওই গুহবাবুদের আশ্রিত হিসেবে আমি মায়ের সঙ্গে কলকাতায় গুহবাবুদের ফড়েপুকুরের বাড়িতে এলাম।
কত্তাবাবুর কল্যাণে আমি ম্যাট্রিক পাস করি। কিন্তু অর্থাভাবে কলেজে পড়া হয়নি। গুহ বাবুদের পাটের ব্যবসা। সেই কাজে আমাকে জাহাজঘাটায় যেতে হতো। সেখানে পিটারসন সাহেবের সঙ্গে আলাপ। তিনি আমার সব কথা শুনে আমাকে তার চা কোম্পানিতে বহাল করেন। মাসখানেক কাজ করার পরেই কাশীর থেকে আমার হারিয়ে যাওয়া বাবার খোঁজ নিয়ে চিঠি এল। কাশীর রামকৃষ্ণ মঠের হাসপাতালে তিনি গুরুতর অসুস্থ। মাকে নিয়ে কাশী যাত্রাপথেই আপনাদের সঙ্গে দেখা।’
বিনয়কান্তি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। স্বর্ণময়ী বলে
‘এ পর্যন্ত আপনি যা যা বললেন — তার সবটাই ঘটে গিয়েছে — সেই ঘটনাকে বদলাবার কোনও ক্ষমতা অন্তত আপনার ছিল না — সুতরাং এই দুর্ভাগ্য এই যন্ত্রণা আপনার ভবিতব্য ছিল। এগুলো কোনওভাবেই আপনার অক্ষমতা নয়।’
‘আমার আরও কিছু বলবার আছে।’
‘বলুন আমি শুনছি।’
‘নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি একটা চাকরি পাই তাহলে মাকে আর রাঁধুনির কাজ আমি করতে দেব না। সেই জেদেই প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে আমি মাকে গুহবাবুদের ফড়েপুকুরের বাড়ি থেকে নিয়ে তেলিপাড়া লেনের এক কামরার এক এজমালি উঠোনের ভাড়াবাড়িতে তুললাম। সেই মুহূর্তে আমার পক্ষে এর চেয়ে ভালো বাড়ি ভাড়া করার ক্ষমতা ছিল না। যেহেতু আমরা আশ্রিত তাই মা সঙ্গত কারণেই পরণের কাপড়জামা ছাড়া ব্যবহারের কোনও বাসন-কোসন নিয়ে আসেননি। ফড়েপুকুরের বাড়ি থেকে ভাড়া বাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় গুহ বাড়ির কর্তামা জোর করে কিছু পিতল কাঁসার বাসন কোসন আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন সেগুলোই আমাদের সম্বল। গোডাউন ক্লার্ক ছিলাম।
কাশী থেকে ফিরে বরাতজোরে আমার কাজের জায়গা আমাদের ক্লাইভ রো-র অফিসে অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টে হল। আর মাস মাইনে বেশ কিছুটা বেড়ে গেল। আমি তেলিপাড়া লেনের বাড়িটা ছাড়তে চেষ্টা করছিলাম। সেই সময় আপনার বাবা অফিসে এসে জানালেন যে তাঁরা আমাদের বাড়িতে আসবেন। তেলিপাড়া লেনের বাড়িতে সত্যি কাউকে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই বেশি ভাড়া দিয়ে আমরা গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে উঠে এলাম। ওখানে বসার ঘরে একটা টেবিল চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। শোবার ঘরে বাড়িওলার দেওয়া দুটো তক্তপোষ আছে। আপনার মা-বাবা যে বেতের সোফায় গিয়ে বসে ছিলেন সেটা আমাদের বাড়িওয়ালার কল্যাণে তার আগেরদিন ওপর থেকে নিচে নামানো হয়েছিল। বিছানার চাদরটুকুও তাদেরই দেওয়া। তাই আমি সেদিন আপনার সঙ্গে বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমাদের আর্থিক বা পারিবারিক অবস্থা কোনটাই আপনার মতো কাউকে ও-বাড়িতে গ্রহণের উপযুক্ত নয়।—চলবে
সত্যি সর্বদা সূর্যের মতই দ্যুতিময়।
সবটা শোনার পর আমার মনে হয়েছে যে এখনই নেমে এসে আপনার দু’ পায়ে আমার দু-হাত ছুঁইয়ে একটা প্রণাম করা উচিত। কারও ছেলে বা মেয়ের প্রশংসা শুনলে বুড়িমা মানে আমার ঠাকুমা বলতেন — ফল ভালো দেখলেই হবে না গাছটাকে গিয়ে চিনে আসতে হবে। তাই ওঁর কথা শোনার পর জানার পর আমি আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।