গাছের পাতায় চুঁইয়ে পড়ে রোদ-কণা
বসুদম্পতি
কণিকাদেবী আনন্দমোহনের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর একটু ইতস্তত করে জবাব দিলেন, ‘না মানে ওই আর কি, আসতে চাইল না।’
বসুন্ধরা আবার বলল, ‘এতসব শাড়ি ধুতি মিষ্টি কেন আনতে গেলেন।’
উত্তরে আনন্দমোহন বললেন, ‘বিনয়কান্তির বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেই তো আমরা দেখা করতে এলাম।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চায় বিনয়। ‘আপনাদের আসতে কোন অসুবিধে হয়নি?’
‘নানা এতো আমার হাইকোর্ট যাবার রাস্তা। আমাদের বরানগর চৈতন্য ঘাট থেকে সিধে কাশীপুর রোড হয়ে কাশীপুর উদ্যানবাটী দমদম চিড়িয়া মোড় বাগবাজার গালিব স্ট্রিট শ্যামবাজার হাতিবাগান টপকেই তোমাদের বাড়ি — আজ রোববার তাই আমিই চালিয়ে এলুম। কাজের দিনে রাস্তায় ভিড় থাকে আর মাথায় মামলার চাপও থাকে – আমার গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। ড্রাইভার চালায়। আজ তার ছুটি। আমাদের বাড়ি থেকে তো কুড়ি কিলোমিটারও নয়।’
মা এর ফাঁকে গিয়ে চা সিঙাড়া নিয়ে এসেছেন। বসু দম্পতি ‘না না’ বলে বাধা দিয়েছেন মা শোনেননি মিষ্টিও এনেছেন। মিষ্টি খাওয়ার শেষে স্বামী-স্ত্রী দুজনে, দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। স্বামীর সম্মতির ইশারা পেয়ে স্ত্রী কণিকা দেবী বললেন, ‘আজ আমরা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি দিদি।’
কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা, বসুন্ধরা আড়চোখে দেখল বিনয়কান্তি মাথা নিচু করে আছে।
‘কি প্রস্তাব?’
কণিকাদেবী আরও একবার স্বামী আনন্দমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বসুন্ধরাকে বললেন, ‘দিদি আমরা স্বর্ণময়ীর সঙ্গে বিনয়কান্তির বিবাহের প্রস্তাব দিতে এসেছি।’
বসুন্ধরা এটা আন্দাজ করেছিল। তাই সে খুব অবাক হয়নি। সে একবার রজনীগন্ধার ফুলে মোড়া তার স্বামী ছবির দিকে তাকালো। বিনয়কান্তিকে চুপ করে থাকতে দেখে — আনন্দমোহনবাবু বললেন, আপনার কোন আপত্তি নেই তো দিদি।
বসুন্ধরা বললেন, ‘দেখুন আপনাদের মেয়েকে আমি একবারই কাশীতে যাবার সময় রেলে দেখেছি — সে সময় আমাদের দুজনেরই মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না —খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম আমরা। তবে এক ঝলক দেখায় তাকে আমার ভালোই লেগেছে।’
আনন্দমোহন বলে ওঠেন, ‘বেশ তো সোনামাকে দেখতে আপনারা একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। বরানগর চৈতন্য ঘাট এখান থেকে খুব একটা দূর নয়। আর আপনার যাবার জন্য আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবো আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’
কণিকা যোগ করেন — ‘একটু আগে থেকে জানলে আমার বড় মেয়ে জামাইকে খবর দেব। জামশেদপুর তো বেশি দূর নয়। ওরা আসবে’খন। মেজো মেয়ে জামাই তো বোম্বাই থেকে হুট করে আসতে পারবে না।’
ছেলে বিনয়ের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই দেখে বসুন্ধরা বললে, ‘কিন্তু আমার ছেলে সবে সবে চাকরিতে ঢুকেছে। তাছাড়া ওর বাবা মারা গিয়েছেন। এখন এক বছর আমাদের কোন শুভ কাজ করতে নেই। তাই বলছিলাম’ —
আনন্দমোহন বলেন, ‘কোনও অসুবিধে নেই সে আমার নয় এক বছর অপেক্ষা করবো। পাকা কথাটা হয়ে থাকলে মেয়ের মা-বাবা হিসেবে আমরা একটু নিশ্চিন্ত হই। এই আর কি।’
বিনয়কে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে আনন্দমোহন সরাসরি তাকেই প্রশ্ন করেন, ‘বাবা তোমার কি কোন আপত্তি আছে?’
বিনয় তক্তপোশ ছেড়ে উঠে হাফপর্দা ঢাকা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জানলা দিয়ে সামনেই ফুটপাথের গাঁ-ঘেঁষে দাঁড় করানো কালো গাড়িটা দেখতে দেখতে বলে, ‘আপনারা আমাদের বাড়িতে এসেছেন আমাদের অতিথি। তাই বলছি কিছু মনে করবেন না। আমি একটু স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসি। আমার আপত্তি আছে।’
আনন্দমোহন এবং কণিকা মুষড়ে পড়েন। তাঁরা এই উত্তরটা আশা করেননি। সত্যি বলতে কি বসুন্ধরাও ভাবেনি বিনয়কান্তি এরকম একটা উত্তর দেবে। বিনয় জানলা থেকে তক্তপোশের দিকে ফিরতে ফিরতে বলে, ‘তবে আমি মাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে যাব। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আপনাদের মেয়ের সঙ্গে আমি সরাসরি কথা বলব। আমার আপত্তিটা ঠিক কি এবং কোথায়, সেটা আমি তাকেই বলব। এখনই আর কোন আত্মীয়স্বজনকে খবর দেবেন না আর আমার মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে না। আমি মাকে নিজেই নিয়ে যাব।’
আনন্দমোহনবাবুরা চলে যাবার পর বসুন্ধরা ছেলেকে বললেন, দেখ বিনু, স্পষ্ট কথা বলা ভালো। তবে কী বলছি আর কাদের বলছি সেটা খেয়াল রাখতেই হবে। তোমাকে যে বারবার বলেছি অজান্তে কারও মনে কষ্ট দিও না। মানুষের মনোকষ্টে ঈশ্বর বড় রুষ্ট হন বিনু।
বিনয় কথার কোন জবাব দিল না। তক্তপোশে পাতা ভালো চাদরখানা তুলে দিল। বেতের সিঙ্গল সোফা দুটো টেনে দু’ধারে করে দিল — এবার একটা সিঙ্গল সোফা ওঠাতে যেতে বসুন্ধরা বলে উঠল — ‘আজ এক্ষুনি সব দিয়ে আসতে হবে?’
‘রেখে দেবার মতো কোন কারণ দেখছি না মা। লোকের কাছে চেয়ে আনা জিনিস। কাজ মিটে গেলে ফেরত দিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।’
‘বিরক্তি এমনি আসে না মা। আমাদের এমন অবস্থা যে একজন ভদ্র মানুষকে আপ্যায়ন করার জন্যে প্রতিবেশীর কাছে হাত পাততে হয়। ভালো একটা বিছানার চাদর নেই। বসাবার আসবাব নেই। এমনকি চা মিষ্টি দেবার জন্য উপযুক্ত কাপ প্লেট নেই। এই অবস্থায় কি কোন মানুষ তার বিয়ের কথা ভাবতে পারে?’
পরের কথাগুলো বসুন্ধরা তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁর উপলব্ধি থেকেই বলে,
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালো বিনু — লক্ষ্যে পৌঁছনোর জেদ মানুষকে জিরোতে দেয় না। কিন্তু অর্জুনও এক দিনে পাখির চোখে তির মারতে পারেনি বাবা। তাঁকেও অভ্যেস করতে হয়েছে। ধৈর্য লেগেছে। অধ্যাবসায় লেগেছে। তুই যে এত কথামৃতের কথা বলিস — স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কত আকথা কুকথা অপমান কত সন্দেহ কত কত চক্রান্ত সহ্য করতে হয়েছে তা কি তুই জানিস? জীবনের লড়াইটা সব থেকে কঠিন। একদিনে সেটা জেতা যাবে না। এগোতে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেতে হবে — উদ্যম না হারিয়ে বারবার পিছন ফিরে দেখতে হবে। তুমি লড়াই করতে করতে কোথা থেকে আজ এখানে এসে পৌঁছেছো। তবে তো নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসবে। মনে হবে আমি যদি এতটা পৌঁছতে পারি তাহলে সামনের বাধা ভেঙে আরও দূরে যেতে পারবো না কেন?’
মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিনয় অবাক হয়ে বলে, ‘মা তুমি তো কখনও ইস্কুল পাঠশালায় পড়োনি, যা পড়াশোনা করেছো সব দাদুর কাছে— কিন্তু তুমি যখন কথা বল আমি অবাক হয়ে যাই মা। আচ্ছা আচ্ছা আইএ বিএ পাশ লোকেরা তোমার কাছে ফেল মেরে যাবে।’
বসুন্ধরা হাসতে হাসতে বলেন, ’আচ্ছা বেশ। মায়ের অনেক প্রশংসা হয়েছে। এবার এই রাশি মিষ্টির একটা গতি করতে হবে। যাই আগে পালগিন্নির কাছে খানিকটা মিষ্টি দিয়ে এই দামি কাঁচের বাসনগুলো ফেরত দিয়ে আসি। তারপর দেখি ওদের বাড়িতে যদি কাজের কোনও লোকজন থাকে তাদের দিয়ে এই বসার জায়গা চাদর সব পরে পাঠিয়ে দেবো। আচ্ছা বিনু, কাল যে ওদের পাখাতে কার্বন নাকি বলল —লাগাতে লোক এসেছিল। ওরকম কি আমাদের এই পাখাতেও লাগাতে হবে?
হ্যাঁ একই রকম পাখা যখন— তখন এতেও লাগবে। আমি ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাছে জেনে নেব’খন।
অ্যাকাউন্টসের কাজ শিখতে বিনয়কান্তির বেশি সময় লাগল না— কিন্তু তাকে পিটারসন সাহেবের সঙ্গে প্রতিদিন অফিসে শেষে এক ঘণ্টা বসতে হতো — চায়ের বিষয়ে জানতে। বিনয় একটা মোটা খাতায় গুছিয়ে সব লিখে নিতো। ‘চা’ ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু তার মধ্যে যে এত কিছু জানবার আছে সেটা বিনয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। আমাদের সবার মতোই তার ধারণা ছিল পাহাড়ি ঢালে চা গাছ হয়। চা-বাগানের শ্রমিকরা- চা-গাছের দুটি পাতা একটি কুঁড়ি একসঙ্গে তুলে মাথার স্ট্র্যাপ লাগানো ব্যাগে ভর্তি করে। সেই লম্বা চা পাতা ছোট করে কেটে টুকরো করে রোদে মেশিনের গরমে শুকিয়ে প্যাকেট করে বাজারে বিক্রি হয়। সেই চা পাতা গরম জলে ফুটিয়ে দুধ চিনি গুলে চা তৈরি। সাহেবি কায়দায় ‘It’s as simple as making tea’ বললেও গোটা ব্যাপারটা ওরকম জলবৎ তরলং নয়।
চা গাছ হল, ‘ক্যামেলিয়া সাইনেসিস’। চিন দেশ থেকে ইংরেজরা চা গাছের চারা বীজ আনিয়ে ভারতে চায়ের চাষ শুরু করে। এর নানান জাত আছে। স্প্রিং সামার মনসুন আর অটাম ফ্লাশ আছে। গোটা শীতকাল চা গাছ বেড়ে উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ফলনে যে পাতা আসে সেটা হল ফার্স্ট ফ্লাশ — একেবারে তাজা কচি চা পাতার স্বাদ। ঝাঁজ কম। তার সুবাসে অদ্ভুত মাদকতা। আবার মে থেকে জুন-জুলাইয়ে যে দ্বিতীয় ফলন তা থেকে চা হবে কড়া ঝাঁঝালো গন্ধের। এটা হল সেকেন্ড ফ্লাশ। বর্ষায় রোদ-বৃষ্টিতে চায়ের পাতা-কুঁড়ি আরও ঘন- আরও তেজ। তবে সুবাসে কমতি। শরতের চায়ে তেজ গন্ধ দুটোই কম। এর সঙ্গে সঙ্গে শিখতে হচ্ছে চায়ের অকশন কেমন করে হয়? ‘চেস্ট’ কি? ‘লট’ কি? ‘রিজার্ভ প্রাইস’ কাকে বলে? যত শিখছে তত গভীরে চলে যাচ্ছে বিনয় কান্তি। বিনয়ের উৎসাহ দেখে পিটারসন সাহেবও খুব খুশি। দেখতে দেখতে মাসখানেক কেটে গেল। অফিস থেকে ফিরে একদিন মায়ের কাছে বিনয় শুনল — সকালে হাইকোর্ট যাবার পথে আনন্দমোহনবাবু এসেছিলেন। খোঁজ নিচ্ছিলেন তারা কবে যাবেন তাদের বরানগরের বাড়িতে। এই হাতিবাগানে তার এক মক্কেল থাকেন। তার ঠিকানা দিয়ে গিয়েছেন। দিন ঠিক করে তার হাতে একটা চিঠি লিখে দিতে বলেছেন। বিনয় ভেবে দেখল এরপর না যাওয়াটা নেহাত অভদ্রতা। সামনের রবিবার বিকেলে বরানগর যাবার স্থির করল। — চলবে
মনের বন্ধ দরজার আড়ালে
একটু ভাবার চেষ্টা করছিলাম আমার চেনাশোনার মধ্যে আমার দুই জামাইবাবুর মতোই যোগ্য বা তারও চেয়ে যোগ্য পাত্রকে বা ক’জন আছেন?’
পেলেন।’ ‘না। পিসি বড়ুয়া ছাড়া কাউকে তো পেলাম না কিন্তু তাঁর তো স্যার বীরেনের মেয়ে মাধুরীলতা সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে’, স্বর্ণময়ী নিজের রসিকতায় নিজেই খিলখিল করে হেসে ওঠে।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।