।।শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।।
দিনরাত যত ব্যাচ বসেছে তাঁদের সামনে করজোড়ে আহারগ্রহণের মিনতি জানাতে উপস্থিত থেকেছে বিনয়কান্তি স্বর্ণময়ী। আর তাঁদের বিশ্রামের সময়ে অমলকান্তি ও সুরঙ্গমা। বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বা শহরের বিশিষ্ট মানুষদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থেকেছে গগনকান্তি-আরতি বা বিকাশকান্তি-ছন্দা আর বসুন্ধরার ছোট নাতি “কেকে’ বা কমলকান্তি। তরুণকান্তিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাড়ির লিফটে কয়েকবার নামিয়ে এনেছে আমার বোন সানন্দা। বাবা আমাকে সু আর বোনকে সা বলে ডাকতেন। সানন্দার ডাকনাম “নন্দা”। সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে থাকে। বড় বড় চোখ। চোখে আরও বড় গোল কাচের চশমা। ছোটবেলা থেকেই চোখে পাওয়ার। মা বলেছিল বাড়ির সকলে বলেছিল। কত সুন্দর সুন্দর মানানসই ফ্রেমের চশমা পাওয়া যায়। কিন্তু না নন্দা বড়ঠাম্মি বসুন্ধরার মতোই গোল কাচের চশমা পরবে। এমনিতেই গম্ভীর তারপর ওই চশমা পরে যখন চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাত কথা বলতে বেশ ভয় ভয় করত। ঠিক যেন ছোটখাট চেহারার কড়াধাতের হেডমিস্ট্রেস।
বড় ঠাম্মির ঘর তাঁর ছবি ফুলমালা সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে শান্তিলতা। তার আরও দায়িত্ব ছিল। বাড়ির গেস্ট রুমে থাকা দূরের আত্মীয়স্বজনদের খেয়াল রাখা দেখাশোনা করা। সঙ্গে ছিল ভাইপো-ভাইজিদের একটা ছোট্টদল। সেই তিনদিন আমিও ছিলাম সে দলে। একদিন শুধু কলেজ যেতে হয়েছিল জরুরি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস-এর জন্যে। ফুলকাকা বিমলকান্তির ফ্রান্সে কি একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ছিল। কিন্তু ফুলকাকা সব ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে বড় ঠাম্মি বসুন্ধরার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কলকাতায় চলে আসতে চেয়েছিল। আমার দাদু বিনয়কান্তি রাজি হলেও ঠাম্মি স্বর্ণময়ী বারণ করেছিলেন। নিজে মুখে না বলে আমার মা সুরঙ্গমাকে ফুলকাকার সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন
‘সেজোবউমা তুমি বিমলকে বুঝিয়ে বল— আমাদের সমাজ এখনও অতটা সাহেব হয়ে উঠতে পারেনি। আমিও পারিনি। বিয়ে বলতে আমরা আজীবনের সম্পর্কই বুঝি। তোমার ফুলদাদার সঙ্গে তার মেমসাহেব বউয়ের যোগাযোগ আছে অথচ কোনও সম্পর্ক নেই। এটা আত্মীয়-স্বজনরা কেউ মেনে নিতে পারবে না। আর মায়ের চলে যাবার পর আমার মন মেজাজ শরীর কিছুই ভালো নেই। আমি এখন এসব নিয়ে কথাবার্তা কিছু চাই না। ফুলদাদার কথা উঠলে বলে দিও কোথায় কি একটা জরুরি মিটিং আছে। আসতে পারেনি।’
‘এসব ছাড় না স্বর্ণ। ওদের জীবন। ওদের সিদ্ধান্ত। তুই তার মধ্যে মাথা দিচ্ছিস কেন?’
কীরা কাকিমার মধ্যে বিদেশিনী হিসেবে সেই ধরনের উদ্ধত্য না থাকলেও স্বর্ণময়ী তাকে কোনওদিনই আপন করে নিতে পারেননি। বোধহয় প্রাক স্বাধীনতাযুগের সচেতন মহিলা ছিলেন বলেই তাঁর মধ্যে এই দূরত্বটা থেকে গিয়েছিল। তাই ঠাম্মির কাছে উইলিয়াম পিটারসন একজন ভদ্র সভ্য বিদেশী মানুষ পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী। অথচ তারক নিয়োগী এই পরিবারের অত্যন্ত নিকটাত্মীয়ের মতো। এই যে একটা অদৃশ্য গণ্ডি – সেটা বোধহয় কীরাকাকিমা কোনও দিনই টপকাতে পারেননি ।
অথচ ঠাম্মির ঘরে একটা টেবল ক্লকে ইউকের টাইম সেট করা। সে ঘড়ি দেখে দেখেই ঠাম্মি খেয়াল করে তার ছেলে মেমসাহেব বৌমা বা নাতনিরা এখন কী করছে? কিন্তু পারিবারিক শৃঙ্খলার ব্যাপারে স্বর্ণময়ী খুব কড়া। ফুলকাকাই ঘড়িটা ঠাম্মিকে ওখান থেকে এনে দিয়েছিল সে ঘড়ির মাথায় দুদিকে দুটো ঝুঁটির মতো অ্যালার্ম বেল লাগানো। সে ঘড়িতে দম দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আর ইউকেতে পড়াশোনা করতে হবে বলেই বোধহয় বছর দশেক বয়েস থেকেই আমার আরও একটা গুরুদায়িত্ব হল। গ্রিনিচ মিন টাইম অনুযায়ী সে ঘড়ি মেলানো বা ফুলকাকার কাছে শুনে ১৯৭২-এর পরে দিনের আলো বাঁচানোর জন্য সাহেবদের নিয়ম মেনে সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও আমারই ছিল। প্রতিবছর মার্চের দ্বিতীয় শনিবার থেকে অক্টোবর মাসের চতুর্থ শনিবারের মধ্যে গ্রিনিচ মিন টাইম থেকে ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়।
পর্ব-১, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: ফুলে ফুলে ঢাকা শববাহী গাড়ি, পুলিশি ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৪: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য/২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’
যাইহোক শ্রাদ্ধে ফুলকাকা আসেনি। আর বাড়ির এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিবারের আরও দু’ জন অনুপস্থিত ছিল। আবার ন’কাকিমা মানে তরুণকান্তির স্ত্রী সুজাতা দত্ত আর তাঁর ছেলে প্রণয়কান্তি। সে আমার খুড়তুতো ভাই। আমার চেয়ে বছর ছ’য়েকের ছোট। তখন সে কলকাতার এক আইসিএসসি স্কুলে পড়ত। ক্লাস এইটে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভাঙার জন্যে কালিম্পঙের সেন্ট অগাস্টিন থেকে বহিষ্কৃত হল। ছোট থেকেই ভয়ংকর একরোখা প্রণয়, আর ন’কাকীমা সুজাতার প্রশ্রয়ে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তবে ওই অবস্থায় তাকে কলকাতার স্কুল-অ্যাডমিশনের জন্যে বাবাকে রাজি করানোর সব কৃতিত্ব মায়ের। মা’র জোরাজুরিতেই কলকাতায় ক্লাস এইটে ভর্তি করালেন আমার বাবা। তাঁর জানাশোনা অনেক। এই প্রথম একরোখা ন’কাকিমা দমে গিয়ে আমার মা’র সাহায্য নিতে না করেননি।
যাইহোক শ্রাদ্ধে ফুলকাকা আসেনি। আর বাড়ির এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিবারের আরও দু’ জন অনুপস্থিত ছিল। আবার ন’কাকিমা মানে তরুণকান্তির স্ত্রী সুজাতা দত্ত আর তাঁর ছেলে প্রণয়কান্তি। সে আমার খুড়তুতো ভাই। আমার চেয়ে বছর ছ’য়েকের ছোট। তখন সে কলকাতার এক আইসিএসসি স্কুলে পড়ত। ক্লাস এইটে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভাঙার জন্যে কালিম্পঙের সেন্ট অগাস্টিন থেকে বহিষ্কৃত হল। ছোট থেকেই ভয়ংকর একরোখা প্রণয়, আর ন’কাকীমা সুজাতার প্রশ্রয়ে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তবে ওই অবস্থায় তাকে কলকাতার স্কুল-অ্যাডমিশনের জন্যে বাবাকে রাজি করানোর সব কৃতিত্ব মায়ের। মা’র জোরাজুরিতেই কলকাতায় ক্লাস এইটে ভর্তি করালেন আমার বাবা। তাঁর জানাশোনা অনেক। এই প্রথম একরোখা ন’কাকিমা দমে গিয়ে আমার মা’র সাহায্য নিতে না করেননি।
ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে
‘মেজদিদিকে বলেছিলাম এবাড়ির পুত্রবধূ হবার মতো একটা ভালো মেয়ের খোঁজ দিস। আমারই দোষ। বিমল বিয়েতে রাজি না হওয়ার পর বিয়েটা ভেঙে দিলে ভালো হতো। জোর করে ন’ খোকাকে বিয়ে করতে বললুম। সেও আমার মান রাখতে সব মেনে নিল। ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলুম গোটা পরিবারের সুখের মধ্যে অসুখের বিষ ছড়িয়ে দিলুম।’
বড় ঠাম্মি বসুন্ধরা বাধা দিতেন।
‘ভবিতব্য। যা ছিল তা হয়েছে। এখন আক্ষেপ করে কোন লাভ হবে না। সুজাতাকে তার মত চলতে দাও। তোমরা তোমাদের মতো চল। তাতেই শান্তি বজায় থাকবে।’
অশান্তি হোত না। মানে কথাই তো হতো না কারও সঙ্গে। আর তার ফলে দিনে দিনে আমার ন’কাকিমা সুজাতার স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ছিল। ন’কাকা তরুণকান্তি রঙ-তুলি-ক্যানভাসের মধ্যে তাঁর হারিয়ে ফেলা পারিবারিক শান্তি খুঁজে নেবার চেষ্টা করতেন। আর বোধহয় তরুণকান্তির মর্যাদাকে আঘাত করতেই তাঁর স্ত্রী সুজাতা হঠাৎ করে Art collector হয়ে উঠলেন। পোশাকি ইংরিজিতে Art enthusiast. ফরাসি ভাষায় যাকে কনেস্যুয় বলে। বলার সময় Connoisseur -এর শেষঅক্ষর ফরাসিতে গায়েব। যাঁদের কাজ শিল্পকর্ম সংগ্রহ। ফাইন আর্টসের বাঙলা হল ললিতকলা বা চারুকলা। ভালোলাগা থেকেই শিল্পসংগ্রাহকেরা চিত্রকলা বা ভাস্কর্য খুঁজে বেড়ান। শিল্পীর মৌলিক সৃষ্টির দখল নেবার লড়াই আদি অনন্তকাল থেকে।
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪০: শুধু খাল-বিল ঝিল নয়নজুলিতে মৌরালা মাছ করে প্রায় ২০ লক্ষ শিশুর অনুপুষ্টির ঘাটতি মেটানো সম্ভব
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪: যেখানে অর্জিত ভক্তি ও বিশ্বাস আছে, সেখানেই ভগবান আছেন
‘জানিস সুবি! দেখার চোখ না থাকলে সবটাই মেকি। এটা একটা প্যাশন। কোনও একটা ছবি তোকে টানছে। বারবার ঘুরেফিরে তোকে সেই ছবিটার সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করাচ্ছে। ছবির মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা তোর মনকে তোর হৃদয়কে স্পর্শ করছে। সেটা কোন রঙ বা কোনও অবয়ব হতে পারে। অস্পষ্ট কোনও কিছুর স্পষ্ট ইঙ্গিত হতে পারে। একটা রং-তুলিতে আঁকা ছবি জীবন্ত এক্সপ্রেশন। ক্যানভাসের থেকে যেন বাইরে বেরিয়ে আসে। বইয়ের পাতায় ছাপা ঝকঝকে ছবির মতো নিষ্প্রাণ নয়। একজন সত্যিকারের শিল্পপ্রেমী যখন কোনও শিল্পকর্মকে নিজের ড্রয়িংরুমে সযত্নে সাজিয়ে রাখেন তখন সেটা শুধু একটা ছবি নয়। একজন চিত্রশিল্পীর মনের ভাবনা চিন্তা অভিজ্ঞতা একটা সাদা ক্যানভাস এর উপরে অজস্র অসংখ্য আঁচড়ে রঙের বৈচিত্র্য একটু একটু করে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টি। সারাদিনের আলোর তারতম্যে সে ছবি একেক সময় একেকরকম ভাবে বদলে যায়। কখনও সে ছবি সকালের উজ্জ্বল আলোয় উষ্ণ। কখনও বা বিকেলের ম্লান আলোয় শীতল। কিন্তু আজকাল সব শিল্পেই যেমন কালোয়ারদের ভিড়, যোগ্যতা বিচারের সংকট পেন্টিঙের ক্ষেত্রেও তেমন। উটকো লোকেরা ছড়ি ঘোরাচ্ছে। ফলে সত্যিকারের ট্যালেণ্টের কোন মূল্য নেই। প্রচারের চড়া আলোয় মিথ্যে প্রশংসার ঢক্কানিনাদে দঙ্গলবাজিতে আসল প্রতিভাদের আভাটুকুও আজ আর নজরে আসে না।’ —চলবে
বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com