বারাণসীর লাক্সা রোডের অদ্বৈত আশ্রমের হাসপাতালে সারারাত টানাপোড়েনের পর ভোরবেলা বাবা চলে গিয়েছিলেন। আচমকা সেই মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মিশনের ডাক্তারদের তৎপরতায় খানিকবাদে সুস্থ হয়ে মা বলেছিল—
‘ভয় পেয়েছিলি—ভাবলি মা-বাবা একসঙ্গে বুঝি তোকে ছেড়ে গেল। ভাবিসনি …আমি তোর পাশে আছি বিনু। তোকে যে অনেক কঠিন পথ পার হতে হবে।’
সেটা ১৯৩০, বিনয় তখন ২৬ বছরের যুবক। আজ সে ৭৭ বছরের প্রৌঢ়। মা কথা রেখেছে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আগলে রেখেছিল বিনয়কে। আগলে রেখেছিলেন বসুন্ধরা ভিলা। এতদিন বিনয় বা স্বর্ণ কেউই সংসারের কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়নি। সবকিছু বসুন্ধরার উপর ছেড়ে দিত। সত্যি সত্যি মা তাদের অনেকটা কঠিন পথ পার করিয়ে দিল। কিন্তু এরপর কী হবে? মধ্যের এতগুলো বছরে সংসারে যে ছোটখাট চিড় বা ফাটল ধরেছিল সেগুলোর দায়দায়িত্ব এবার কে নেবে? বিনয় তো ব্যবসা সামলেছে, সংসারের কোনও কিছুতে মাথা দেয়নি। দিতে হয়নি। স্বর্ণ এবার সব একা সামলাতে পারবে তো?
স্বর্ণ ছিল বসুন্ধরার একমাত্র পুত্রবধূ। সুতরাং সে ছাড়া তো আর কেউ ছিল না যাকে মা ভরসা করবে। তাই বসুন্ধরা স্বর্ণকে মনের মতো করে নিজের হাতে গড়ে গিয়েছেন। তাই স্বর্ণ নিশ্চয়ই পারবে মায়ের মতোই এই বসুন্ধরা ভিলাকে আগলে রাখতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসারের ডায়নামিকস বদলেছে। বদলে গিয়েছে সম্পর্কের জটিলতা। একসময় অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তারপর ব্যবসা ক্রমশ বাড়তে থাকায় কাজের চাপের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এখন সবকিছু পাওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই বোধহয় লড়াইটা আগের মতো আর সরাসরি হবে না। লড়াইটা হবে জীবনের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার মনোবৃত্তির সঙ্গে, লোভের সঙ্গে স্বার্থের সঙ্গে হিংসা বা প্রতারণার সঙ্গে। এখন বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু সে লড়াইয়ে কি স্বর্ণ একা পড়ে যাবে? না! বিনয়ের তা মনে হয় না। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের আশেপাশে যেমন স্বর্ণ সর্বক্ষণ থাকত। অমুর বউ সুরঙ্গমা ঠিক সেভাবেই স্বর্ণ’র সঙ্গে থাকবে। বিনয় কিছুদিন ধরেই সেই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছিল। অথচ সিনেমায় অভিনয় করতো বলে একসময় বিনয়কান্তি সুরঙ্গমাকে বসুন্ধরা ভিলার পুত্রবধূ করার ব্যাপারে সংশয়ে পড়ে গিয়েছিল। বসুন্ধরার কথাতেই সুরঙ্গমা চিরদিনের মতো সিনেমার সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করে।
‘বাবা আপনি পোশাকটা বদলে নিন— এবার ঠাম্মি রওনা দেবেন।’
সুরঙ্গমার কথা ভাবতে ভাবতে তার গলাতেই চমক ভাঙলো বিনয়কান্তির। একহাতে ট্যাবলেট, অন্য হাতে কাচের গ্লাসে জল। সামনে দাঁড়িয়ে সে।
‘আপনার স্যুগারের ওষুধ। এটা খেয়ে আধঘণ্টা বাদে একটু দুধসাবু খেতে হবে। খালি পেটে থাকা যাবে না।’
‘না মানে এখন তো মায়ের।’
‘আপনার শরীর খারাপ হলে কি ঠাম্মি খুশি হবেন বাবা।’
‘আচ্ছা আমরা তো হেঁটেই মাকে নিই…’
‘বসুন্ধরা ভিলার রাজরাজেশ্বরীকে ওভাবে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবেনা বাবা। ঠাম্মির গাড়ি সাজানো হয়েছে। সকলে ঠাম্মির পিছনে পিছনে গাড়িতেই যাবে। আপনার সঙ্গে আমি যাব।’
ফুলে ফুলে ঢাকা এয়ার-কণ্ডিশনড শববাহী গাড়ি। আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজনের ছোট-বড়-মাঝারি নানান মাপের গাড়ি। সার দিয়ে চলেছে। সামনে রয়েছেন পুলিশের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। এখনকার পুলিশকমিশনার বিনয়কান্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাভাবিকভাবে পুলিশি ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো। আজ বিনয়কান্তিকে কিছুই ভাবতে হয়নি। কিছু দেখতে হয়নি। সব ব্যবস্থা হয়েছিল। সুরঙ্গমার কথামতো ওষুধ খেয়ে পোশাক পাল্টে সে এসে গাড়িতে বসেছে। কত কত লোক যে এসেছে নামী বিশিষ্ট চেনামানুষজন। অনামী অচেনা জনতা। অনেক শিল্পপতি রাজনৈতিক নেতা বিশিষ্ট সরকারি আমলা। তারা এসে মালা দিয়েছে। বিনয়কান্তিকে সমবেদনা জানিয়েছে। বিনয়কান্তি যন্ত্রের মতো সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সকলের মুখের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু কারা এসেছিলেন কিছুই তার মনে নেই। চিফ মিনিস্টার অফিস থেকে একজন পুষ্পস্তবক আর শোকবার্তা নিয়ে এসেছিল সেটা মনে আছে। এতসব ব্যবস্থাপনা নিশ্চয়ই বাবু করেছে। মাঝরাতে খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছিলেন তারক নিয়োগী। গাড়ি পাঠাতে মানা করে ট্যাক্সি করে এসেছিলেন ক্রীক রো থেকে। কাছেই এনআরএস হাসপাতাল। মাঝরাতে ট্যাক্সি পাওয়া যায়। খাটে শোয়ানো মায়ের পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে অনেকটা সময় হাঁটুমুড়ে বসেছিল তারক নিয়োগী। ভোরবেলায় একবার বিনয়কান্তির সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ব্যাস তারপর থেকে আর তাকে দেখেনি বিনয়।
রাস্তার দুধারে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে বসুন্ধরার শেষযাত্রা। বসুন্ধরা তো কোন রাজনৈতিক নেত্রী নয়। লেখিকা নয় অভিনেত্রী নয়। এত মানুষ তো বসুন্ধরাকে কখনও চোখে দেখেই নি। তাহলে তারা কেন এসে দাঁড়িয়েছে? বিনয়কান্তির জন্যে? নাকি বসুন্ধরা ভিলার জন্যেই এঁরা বসুন্ধরার নাম জানে। লাক্সা রোডের অদ্বৈত আশ্রমের হাসপাতাল থেকে বাবাকে মণিকর্ণিকা ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল কল্পেশজির লোকজন। বেনারসের কাউকেই চিনত না বিনয়কান্তি। বিনয়ের অজান্তেই নিখুঁতভাবে তার বাবা শ্যামসুন্দরের শেষকৃত্যের সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন কল্পেশজি। আজও ঠিক তেমনি সবকিছু হয়ে যাচ্ছে আপনাআপনি। বিনয়কে কিছুই করতে হচ্ছে না। বিনয়ের শরীরটা এলিয়ে যাচ্ছে ঘুম আসছে চিরকালের জন্য যার মা তাকে ছেড়ে চলে গেল তার কি এখন ঘুম আসা সাজে?
‘বাবা আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?’
বিনয় তাকায়। হাত নাড়িয়ে সুরঙ্গমার উৎকণ্ঠা কমাবার চেষ্টা করে।
‘না না একটু টায়ার্ড লাগছে! তুমি টেনশন কোরো না।’
সুবর্ণ তখন যাদবপুরে মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ার। বড় ঠাম্মির শেষ যাত্রায় অত মানুষ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল কুড়ি বছরের ছেলে। দু’বছর আগে ৮০ সালের ২৪শে জুলাই উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পর সে একটা সাংঘাতিক ভিড় হয়েছিল রাস্তায়। ভোরবেলা বিনয়কান্তি আর স্বর্ণময়ী গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে গিয়ে মালা দিয়ে শেষশ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছিলেন মহানায়ককে। সুবর্ণ’র মা সুরঙ্গমাকে নিয়ে বাবা সাহিত্যিক অমলকান্তি গিয়েছিলেন মাঝরাতে। অমলকান্তি’র সঙ্গে সুমধুর সম্পর্ক ছিল মহানায়কের। টালিগঞ্জের ছবির জগতে যোগাযোগের সূত্রে সে-সময় অনেক সাংবাদিক ফোন করে মায়ের কাছে মহানায়ক সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল। সুরঙ্গমা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তাঁর সঙ্গে কাজ করার কোন সৌভাগ্য হয়নি। আমার স্বামীর সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। সকলের মতো আমিও তাঁর এক গুণগ্রাহী ভক্ত।’ অবশ্য বাবাকে অনেকগুলো লেখা লিখতে হয়েছিল। উত্তমকুমারকে চন্দনকাঠে দাহ করা হয়েছিল। বড় ঠাম্মি বসুন্ধরাকেও কি…। না! কেওড়াতলার ইলেকট্রিক চুল্লিতেই দাহ করা হল বসুন্ধরাকে। তারকবাবু একবার বলেছিলেন। ব্যবস্থাও করা ছিল। দাদু বলেছিলেন, ‘দরকার নেই।’ তবে ঠাম্মি স্বর্ণময়ীর গুরুদেবের কথা মেনে বড়ঠম্মি বসুন্ধরার ”বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ” করা হয়েছিল। ঠাম্মির দেহভস্ম সাগরে, কাশীতে এবং পুষ্করে বিসর্জন করা হয়েছিল। আর একটা জিনিস হয়েছিল। শ্রাদ্ধের পরের একটা দিন বাদ রেখে তারপর দিন ”নিয়ম ভঙ্গ”-এর অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আর এই তিনদিন দিনরাত বসুন্ধরা ভিলাতে মানুষ অতিথি সেবা পেয়েছে। একমূহুর্তের জন্যে রান্নার বিশাল গ্যাসস্টোভ নেভেনি।—চলবে
চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি
বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড/ পর্ব-২
“বিলেতে প্রতিবছর মার্চের দ্বিতীয় শনিবার থেকে অক্টোবর মাসের চতুর্থ শনিবারের মধ্যে গ্রিনিচ মিন টাইম থেকে ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়ে দিতে হয়। সাউথ-ইস্ট লন্ডনের এই জায়গার নাম ইংরিজিতে লেখার সময় Greenwitch লিখলেও মুখে বলার সময় চিবিয়ে সাহেবরা সেটা “গ্রিনিচ” করে নিয়েছে।”
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com