রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মুক্ত জীবন। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

বাবলি কলকাতার মেয়ে নয় দিল্লির এক প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বাবলি আর তার মা থাকত। এটি বাবলির দাদুর বাড়ি। মোটর-দূর্ঘটনায় বাবলির বাবা যখন মারা যান তখন বাবলি স্কুলছাত্রী। একই গাড়ীতে পিছনের সিটে বসা বাবলি আর বাবলির মা থেকে গেল পৃথিবীতে। রোড ক্রসিঙে বাঁকের মুখে হাইওয়ে ট্রাকের আড়াআড়ি ধাক্কায় গাড়িটা দুমড়ে গিয়েছিল। বাবার শরীরটা চেনা যায়নি। বাবলি, দিল্লিতে জেএনইউ থেকে পড়েছে। নানা রকমের কালচারের একটিভিটি করতো ওদের বন্ধুরা। সেখানেই পড়ত অরুণাভ। অরুণাভ বসু। চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা। বাবলি দর্শণের ছাত্রী। অরুণাভ ইতিহাসের ছাত্র। ওদের আলাপ বন্ধুত্ব সবই নাটকের সূত্রে। ওদের একটা নাটকের গ্রুপ ছিল। প্রসেনিয়াম ফর্মে নয় ওপেনএয়ার থিয়েটার করত। প্রথম আলাপ ইউনিভার্সিটিতে থিয়েটার গ্রুপের রিহার্সালে। ওরা হিন্দি নাটক করত। বাদল সরকারের “সারারাত্তির” করেছিল হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’।
সুন্দর ঝকঝকে অনুবাদ করেছিলেন প্রকাশজি। রবীন্দ্রনাথের ভাব তার সংলাপের মজা হিন্দিভাষী দর্শকদের বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হতো না। ওরা নির্বাচিত অংশ থেকে চমকপ্রদ দৃশ্যাবলীর কোলাজে সম্পূর্ণ নাটকের একটা আকর্ষণীয় উপস্থাপনা করত। প্রকাশ উপাধ্যায় বলে একজন ছিলেন। খুব পড়াশোনা। খুব ভালো বাংলা জানতেন। বাংলা সাহিত্যের খুঁটিনাটিও খুব ভালো করে পড়া। ওদের থেকে বয়সে একটু বড়। প্রকাশজি হিন্দি অনুবাদ করতেন। একই ফরম্যাটে এক-দুটো বাঙলা নাটকও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন আর ঘরে-বাইরে। তবে দুর্গাপূজোর পরপর দুম করে বাবলির বিয়ে হয়ে গেল। ফাইনাল পরীক্ষাটা দিলেও রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি। বাবলি যেন জেএনউ থেকে হঠাৎ উবে গেল। কলকাতায় পয়সাওলা ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়ে গিয়েছে বন্ধুরা এটুকু জানত। আর যোগ না থাকলে যোগাযোগ টেঁকে না। তাই বাবলি বন্ধুবান্ধবের কাছে ক্রমশ একটা ক্লোজড চ্যাপ্টার।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৪: ভদ্রতা, মার্জিত ব্যবহার এ সবই জিনগত বৈশিষ্ট্য

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

সেই বাবলি এখন নাটক দেখে না। কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের কথা এতো শুনেছে। কিন্তু যায়নি। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিজের ভালোলাগার কথা কাউকে বলতে পারেনি বাবলি। স্বপ্নের মতো বিয়েটা হয়ে যাবার পর উপলব্ধি করল যে বসুন্ধরা ভিলার সবচেয়ে জটিল মানুষগুলোর সঙ্গে ঈশ্বর তাঁর জীবন জুড়ে দিয়েছেন। শ্বশুরমশাই অক্ষম। শারীরিক কারণে নির্ভরশীল। শাশুড়ি সুজাতা সৃষ্টিছাড়া মহিলা। স্বামী প্রণয়ের মধ্যে কোনও মনুষ্যত্ব নেই।

কখনও-সখনও টিভি দেখে বাবলি। আচমকা এক দুপুরে একটা চালু টিভি সিরিয়ালে এক নতুন অভিনেতাকে চোখে পড়ল। বাবলি সিরিয়াল দেখে না । কখনও সখনও পুরনো বাংলা ছবি দেখে। একা একা ভাল না লাগলে সেজো কাকিমার ঘরে চলে যায় দুজনে একসঙ্গে পুরনো ছবি দেখে। অভিনেতাকে দেখে এসে চমকে উঠল। এতো অরুণাভ!! অরুনাভ বসু!! ও কি কলকাতায়?

২০১৪ সালে প্রকাশিত “স্যাপিয়েনস – অ্যা ব্রীফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড” নামের লক্ষ কপি বিক্রিত বিশ্বের বেস্টসেলার বইটির রচয়িতা ইস্রায়েল-এর ইয়ুভ্যাল নোয়াহ হারারি। পেশায় ঐতিহাসিক এবং জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মাত্র ৪৭ বছরের হারারি অক্সফোর্ডের ডীলিট এবং সেখানেই পোস্ট ডক্টর‍্যাল পড়াশোনা সেরেছেন। হারারির এই গবেষণাধর্মী বইটিতে বলা আছে আনুমানিক ১৩৮০কোটি বছর আগে ম্যাটার আর এনার্জি পরিভাষায় বস্তু ও শক্তি সৃষ্টি হল। পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার আদি এই সময়েই।

এর অনেক পরে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। আরও অনেক পরে ৬০ লক্ষ বছর আগে জীববিদ্যার প্রারম্ভ। আদি মানবের সৃষ্টি আফ্রিকায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। এই অনন্য সাধারণ রচনায় মানবের বিবর্তনকে নানা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। সেই আদি থেকে আজ পর্যন্ত। প্রায় পাঁচশ পাতার এই বইটির পিছনের প্রচ্ছদে কয়েকটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা আছে। বাংলা তর্জমা করলে যেটা দাঁড়ায়… ‘আগুনের আবিষ্কার আমাদের শক্তি দিল। কৃষিকাজ আমাদের আরও বেশি পাওয়ার লোভ ক্ষুধার্ত করে তুলল। অর্থের আবিষ্কার আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য দিল। আর বিজ্ঞানের ক্ষমতা দিনে দিনে আমাদের ভয়ংকর করে তুলল।’
সেই আদি থেকে ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনে সময়ের সাথে সাথে মানবকূলের সক্ষমতা যত বেড়েছে বুদ্ধি বিচক্ষণতা অভিজ্ঞতা বেড়েছে সারল্য থেকে তত দূরে সরে গেছে তারা। মানসিক জটিলতা তত বেড়েছে। সহজভাবে ভাবতে ভুলে গেছে মানুষ। অবশ্য সামাজিক বিবর্তনে কিছু সকারত্মক দিকও আছে। পুরোনো দিনে বিশেষ সম্পর্ক ছাড়া নারী-পুরুষের নিছক স্বাভাবিক বন্ধুত্ব সামাজিক স্বীকৃতি পেত না। কো-এডুকেশন বা সহশিক্ষার শুরুর সময়েও সেই মানসিক বাধাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সমাজ। যদিও আজও আগের প্রজন্মের মানুষ হয়ত পুরোপুরি সংস্কারহীন হতে পারেনি – কিন্তু আজকের প্রজন্মের প্রকৃত মুক্তমনের ছেলেমেয়েরা এসব বাধা কাটিয়ে উঠেছে। কিছু ভেকধারী এই স্বাভাবিক মেলামেশাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে । তাদের প্রসঙ্গে এ আলোচনা নয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

বাবলির সঙ্গে অরুণাভের সম্পর্ক নিছক নির্ভেজাল বন্ধুত্বের। লিঙ্গভেদে বিপরীত বলে পরস্পর কেন কাছের বন্ধু হতে পারবে না? আসলে ভালোলাগার অনেক প্রকারভেদ আছে। একজন ছেলে বা মেয়ে পরস্পরের মধ্যে ভাবনার আদানপ্রদান চিন্তার মিল, বিশ্বাস নির্ভরশীলতা খুঁজে পেলে তাদের বন্ধুত্ব হবে। কিন্তু তারা শারীরবৃত্তিয় ভাবে নারী ও পুরুষ বলেই একে অপরকে বিয়ে করে ফেলতে হবে? এটা হতে পারে বন্ধুত্ব আর দাম্পত্যের দাবি বা শর্ত হয়ত আলাদা। বন্ধু হিসেবে গ্রহণযোগ্য কিন্তু হয়ত স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে নয়। কেন নয় তার উত্তর হল মানসিক গঠনের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন – চিন্তার জটিলতা। পরিবেশ পরিস্থিতি সামাজিক দায় হয়ত বন্ধু নির্বাচনে কোন বিড়ম্বনা নয়, দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়ত-বা তত অনুকূল নয়।
অরুণাভ বাবলির মধ্যে বিন্দাস তুই-তোকারি দোস্তি ছিল বন্ধুত্ব ছিল। প্রেম ছিল না। হঠাৎ টিভির পর্দায় এত এতদিন বাদে অরুণাভকে দেখে অবাক হয়ে গেল।

টিভিটা বন্ধ করে ভাবতে বসল বাবলি।

অরুণাভরা দিল্লীর চিত্তরঞ্জন পার্কের ই ব্লকে থাকত। বাবলিদের বাড়ি ছিল বি ব্লকে। হাঁটাপথে দেড় কিলোমিটার। অটোরিক্সায় হুশ পৌঁছে যাওয়া যেত। তবু একে অপরকে চিনত না। পুজোর সময় হয়তো দেখেছে। খেয়াল করেনি। প্রকাশজি রিহার্সালের প্রথম আলাপ করিয়ে দিল অরুণাভর সঙ্গে। বাবলি নন্দিনী। যক্ষপুরীর রাজার ভূমিকায় প্রকাশজি স্বয়ং অভিনয় করেছিলেন । অরুনাভ করেছিল বিশু পাগল। দারুন গানের গলা অরুণাভর। একটা অদ্ভুত ব্যাপার করেছিলেন প্রকাশজি। নন্দিনী তার সেই বিখ্যাত সংলাপ বলছে হিন্দিতে।
“পাগল ভাই এই বদ্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার আমার মাঝখানটাতেই একটা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর সব বোজা”…।
উত্তরে বিশু পাগল বলে—
সেই আকাশটা আছে বলেই তোমাকে গান শোনাতে পারি…।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!

সংলাপটা হিন্দিতে বলল। কিন্তু সেই বিখ্যাত গানটা পরিষ্কার বাংলায় গাইল।

তোমায় গান শোনাবো তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখো

ওগো ঘুম ভাঙানিয়া…

বিশু পাগল একটা করে স্তবক গান করে আর নন্দিনী নিজে উপলব্ধি করার মত করে কথাগুলোর হিন্দি তর্জমা করে নিজের মতো যেন বোঝার চেষ্টা করে। একেবারে লাইন শব্দ ধরে ধরে ট্রান্সলেশন নয়। ছোট করে একটা ধারণা। সেটার পরেই প্রতিবার বিশু পাগলকে কিউ দেয় নন্দিনী। হিন্দিতে। কখনও “আগে শুনাও” কখনও-বা “ফির”। এভাবে রবীন্দ্রসংগীতের নির্যাস বজায় রাখা হলো- একইসঙ্গে গানটা অবাঙ্গালী দর্শকদের কাছে কমিউনিকেট করা গেল। প্রথমে খুব ভয় ছিল। এভাবে খোদার ওপর খোদকারী লোকে মেনে নেবে কিনা? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ইউনিভার্সিটিতে তো বটেই এমনকি পরে দিল্লির নানান বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে এ নাটকের শো করেছে ওরা এবং বাঙালি অ-বাঙালি সকলে প্রচন্ড প্রশংসা করেছেন। বাবলির মনে হয় প্রবাস বলেই বোধহয় চশমাপরা ভুল খুঁজে ফেরা জ্ঞানী লোকের সংখ্যা কম ছিল সেখানে। —চলবে।

ভিন্নভাষায় গুরুদেবের রক্তকরবী। ছবি: সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content