শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ঠাকুরঘর। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য সত্রাগ্নি।

 

বিধি

সেদিন বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঘরের কেউ কথা বলবার আগে সানন্দা বলে উঠলো—

—এটাতো ডিজাস্টার ঘটে গেল। কিন্তু ঋতুর কথা ভেবে বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজনের এখনই ওর কাছে যাওয়া উচিত। ওকে এসব কিচ্ছু বলার দরকার নেই। এখন একটা বড় সাইকোলজিক্যাল সেটব্যাক হলে সেটা সামলানো যাবে না।

সবাই চুপ করেছিল। কারও কাছে কোন শব্দ নেই। ধীর গলায় বাবু বলে উঠলেন—

—একজন ডাক্তার হিসেবে তুমি যে মতামতটা দিচ্ছ সেটা তো মানতেই হবে। কিন্তু নন্দা-মা ঋতুকে তো খবরটা দিতে হবে। সেটা কবে দেবে? কিভাবে দেবে? কে দেবে সেই খবর?

এই তিনটে প্রশ্নের একটারও উত্তর কারও কাছে ছিল না। কিন্তু সকলকে অবাক করে স্বল্পভাষী মুমু মানে মৃন্ময়কান্তি বলে উঠল—

—তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি ঋতুকে বলবো । কখন জানানো উচিত হবে সে ব্যাপারে আমি নন্দার সঙ্গে কথা বলে নেব।

তারকবাবুর পরামর্শে ফুলকাকার সঙ্গে বাবা জার্মানিতে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। মৃতদের কারোরই দেহাবশেষ বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তবু পরিবারের তরফ থেকে কোন কিছু করণীয় থাকলে ফুলকাকাকেই সেসব করতে বলা হয়েছিল।

সমস্যা হল অন্যত্র। দুর্ঘটনায় মৃত্যু। শ্রাদ্ধাদি চতুর্থ দিনে সারতে হবে। কিন্তু সানন্দা, ঋতুর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে জানালো, বেবির অ্যাডভান্স ডেলিভারি হয়েছে। ওকে দিন চার-পাঁচ অবসার্ভ না করে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা যাবে না। তাহলে শ্রাদ্ধ কিভাবে হবে?

নাতির আচমকা মৃত্যু বড় জ্যাঠামনি-জেঠিমার মতই দাদু ঠাম্মিকেও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তারকবাবু এ বিষয়ে সব আলোচনা আমার মা আর বাবার সঙ্গে করতেন। তিনিই বললেন—

—জানেন অমলবাবু! আজ এরকম অবস্থায় মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। জানি তাঁর নাতির ছেলে।প্রপৌত্রের শোক ভয়ংকর। তবু মনে হয় এখন মায়ের সামনে গিয়েই বোধহয় জিজ্ঞেস করতে পারতুম— “এখন কি করব আপনি বলুন মা।”
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪২: বসুন্ধরা ভিলায় এত নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে যা বলে বোঝানো যাবে না

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

আমার দাদু বিনয়কান্তি ছাড়াও বসুন্ধরা দত্তকে আরও একজন মা বলে ডাকতেন। সন্তান না হয়েও সন্তানসম তারক নিয়োগীর সেই অধিকার ছিল। বড় ঠাম্মি বসুন্ধরা, তাঁর পুত্রবধূ স্বর্ণময়ীর পর বসুন্ধরা ভিলার পরবর্তী প্রজন্মের গৃহিনীদের মধ্যে যাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করতেন, তিনি ছিলেন আমার মা সুরঙ্গমা। বড় ঠাম্মি তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা দিয়ে বোধহয় অনুমান করতে পেরেছিলেন যে এ পরিবারের, বসুন্ধরা ভিলার, মর্যাদার ঐতিহ্যের পরম্পরার মূলসুরটা সুরঙ্গমা, প্রথম দিন থেকেই ধরতে পেরেছেন। তাই সেই পারিবারিক মর্যাদা ঐতিহ্য পরম্পরাকে মাথায় রেখে একদিন একমুহূর্তে চিত্রজগতের খ্যাতি-গরিমাকে দূরে ঠেলে দিতে এই পরিবারকে দুহাতে আপন করে নিতে পিছপা হননি সুরঙ্গমা। একজন সফল চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে অন্য অনেকের থেকেই মা সামাজিক পরিমণ্ডলটা খুব ভালোভাবে বুঝতেন। আবার বড় ঠাম্মি বা ঠাম্মিকে কাছ থেকে দেখে বসুন্ধরা ভিলার আভ্যন্তরীণ আব্রুটা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেতেন।
তাই মায়ের কাছে এই সমস্যার সহজ সমাধান ছিল। হয়তো বসুন্ধরা দত্ত সেদিন জীবদ্দশায় থাকলে এই একই সমাধান দিতেন।

—শ্রাদ্ধ মুমু করবে। ঋতু আজ হাসপাতালে না থাকলেও মুমুই কাজ করত। ঋতু হয়তো একটা ভুজ্জি দিত। আমি ঠাকুরমশায়ের সঙ্গে কথা বলব। অসুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোন উপায় আছে। ঋতু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে একটা পুজোর ব্যবস্থা করা যাবে। বড়ঠাম্মি কোনদিন গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। মা-ও দেন না।

ঠাম্মি নিঃশব্দে মাথা ঝোঁকালেন। বেলা বাড়লে বসুন্ধরা ভিলা থেকে মা মেজ-জেঠিমা সুপ্রিয়া বৌদি – সকলে গিয়ে বেবিকে দেখে এসেছিল। সকলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছিল। ঋতু এক দুবার জানতে চেয়েছিল তার স্বামী মানে তন্ময়কান্তিকে খবরটা দেওয়া হয়েছে কিনা। কারোও মুখে কোন জবাব নেই। এসব পরিস্থিতিতে যার ওপর আমরা সকলে নির্ভর করে সেই মায়ের মুখেও কোনও শব্দ উচ্চারণ হতে না দেখে সানন্দা সামাল দিয়েছিল—

—তোর বরকে জানিস তো সে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে গ্রিস ঘুরে আসতে গিয়েছে।
মেজজেঠিমা কান্না চাপতে না পেরে কেবিন থেকে করিডরে পালিয়ে বেঁচেছিল। আর মা ফেরার পথে গাড়িতে আর নিজেকে সামলাতে পারেননি।
নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস!
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মৃত্যুর একদিন বাদ থেকে চার দিনের দিন পড়ল ২৬ তারিখ। সেদিন চতুর্থীর কাজ। সেদিনই আবার তনুদাদার বিদেশ থেকে কলকাতা ফেরার কথা ছিল। বড়জ্যাঠামণি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বড় জেঠিমা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। ঠাকুর ঘরেই শ্রাদ্ধে বসেছে মুমু মানে মৃন্ময়কান্তি। ঠাকুরঘরের দেয়ালে পিঠ রেখে স্থানুর মতো বসে আছেন আমার ঠাম্মি। স্বর্ণময়ী। তাঁর দুগাল বেয়ে নেমে আসছে চোখের জল। সজলচোখেপুজোর জোগাড় করছেন আমার মা। ঠাকুরঘরের দরজার কাছটায় হুইলচেয়ার নিয়ে উদভ্রান্তের মতো বসে আছেন আমার ন’কাকা তরুণকান্তি দত্ত। তনুদাদার মৃত্যুর খবর শুনে ন’কাকা বলে উঠেছিল

—এ জন্যেই মাকে বলতুম এত পুজোপাঠকোরো না। ভালোলোকের কথা ঈশ্বর শোনেন না। না হলে তনুর কি এটা চলে যাবার সময়? আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোক পড়ে থাকতে – একটা শক্ত সামর্থ্য সুস্থ সবল ছেলে এ ভাবে… বড়বৌদি তো সারাক্ষণ পুজোপাট নিয়ে পড়ে থাকে। কি প্রতিদান দিল তোমাদের ঈশ্বর।

অথচ সেই ন’কাকাই ঠাকুরঘরের চৌকাঠের ওপার থেকে একদৃষ্টে ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। আস্তিক ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের অভিমান হয়। ঈশ্বরের প্রতি মনে মনে অক্ষম ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। তবুও ঈশ্বরই যে শেষ-আশ্রয়। তাঁকে অস্বীকার করার ক্ষমতা যে মানুষের নেই।
বাড়িতে অক্সিজেন ইসিজি মনিটর ওষুধপত্র নার্স নিয়ে নন্দা মোটামুটি একটা মেডিকেল ইউনিট তৈরি রেখেছে। চতুর্থীর কাজ নির্বিঘ্নে মিটল। ঠিক পরদিন হাসপাতালে পাঁচদিন কাটিয়ে ঋতু ছেলে নিয়ে বসুন্ধরা ভিলায় ফিরল। সে যেন এক দম-আটকানো পরিবেশ। বসুন্ধরা ভিলার উত্তরাধিকার বাড়ি আসবে অথচ দুঃখের জালে জড়িয়ে হাঁসফাঁস করছে সেই আনন্দানুভূতি। এবাড়ির সন্তানদের ঠাকুরঘরে বেদির সামনে শুইয়ে আশীর্বাদি ফুল ছুঁইয়ে তারপর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বসুন্ধরা ভিলার সন্তানদের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয় না।

দাদুর অন্নপ্রাশনের দিন বাড়িতে অঘটন ঘটেছিল। দাদুর কাকা কৃষ্ণসুন্দরের নৌকাডুবিতে আচমকা মৃত্যু। তাঁর চতুর্থীর কাজ মিটিয়ে সেই রাতেই বসুন্ধরার স্বামী দেশান্তরি হষেছিলেন। তাই বড়ঠাম্মির অন্নপ্রাশনে মানা ছিল। তবে সনাতনী পুজোপার্বণ এ বাড়িতে মানা হয়। শিশুজন্মের পর ছয়দিনের দিন সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরঘরে ষষ্ঠী পুজো হয়। একে নাকি সূতিকাষষ্ঠী বলা হয়। পুরনোকালে আঁতুড়ঘরের বিধি। আসলে সংক্রমণরোধক একটা ব্যবস্থা। এই সময়টাকে শুভ-অশৌচ বলে। পাঁচদিন বাদে তবে নখকাটা হয়। মানে নখকাটার আগে স্নান করানোর জন্য মা বাদ দিয়ে বাইরের লোকের বাচ্চাকে স্পর্শ করা মানা। স্থিতাবস্থা বা “স্ট্যাটাস ক্যো” বজায় রাখা। ওপারবাংলার কোথাও কোথাও একে ‘পাঁচ উঠানি’ বলা হতো।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

পুরনো সময়ে প্রতিষেধক ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। তাই এই আঁতুরঘরের ব্যাপারটা কোথাও কোথাও এক থেকে দুমাস রাখা হতো। সে সময় সংক্রমণের কারণে প্রচুর শিশুমৃত্যু ঘটতো।। পাঁচদিন বাদে আতুঁড় শুদ্ধি ছয় দিনে ষষ্ঠী পুজো আট দিনের দিন ‘আট কড়াই’। সে সময় গ্রামবাংলায়সন্তানজন্মের অষ্টম দিন সন্ধ্যাবেলায় কুলো বাজিয়ে তালে তালে ছড়া গেয়ে নবজাতক শিশুর মঙ্গল কামনা করা হয়। এ সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের আটকলাই বা আটকড়াই খাওয়ানো হয়। ছোলা, কলাই, মুগ, মটর, খেসারি ভাজা, এবং চিড়া মুড়ি খই এই আট রকম ভাজা দিয়ে আটকড়াই বা আটকলাই হয়। এছাড়াও এ দিন সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।বসুন্ধরা ভিলায় অবশ্য এই আটকড়াই-এর এর কোন রীতি ছিল না।

এ সব খুঁটিনাটি আমি মায়ের থেকে জেনেছি। খাস দেশপ্রিয়পার্কে বড় হয়ে ওঠা সুরঙ্গমা সেনগুপ্তের পক্ষে এ সব জানার সম্ভব ছিল না। তিনি কিছুটা জেনেছিলেন সিনেমা করার সুবাদে।আমার মায়ের অভিনীত ছবি শুভা’তে এসব রেফারেন্সেস ছিল। বাকিটা বড়ঠাম্মির কাছ থেকে।
আটদিনের দিন আমার মা সুরঙ্গমা আর নন্দার উপস্থিতিতে মুমু মানে মৃন্ময়কান্তি ঋতুকে সেই নিদারুণ সত্যিটা জানাবে ঠিক করেছিল। —চলবে
বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৪৪

ভদ্রতা মার্জিত ব্যবহার এগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক পরম্পরা বা সহবৎশিক্ষা সবসময় যে সকলকে লোভ ঔদ্ধত্য অহংকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে এমনটা নয়। একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বা সহোদর ভাই বা বোনেরাও ভিন্ন রুচির হতে পারে। ভিন্ন রুচির হয়। এমন প্রমাণ বসুন্ধরা ভিলাতেও আছে।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content