রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

আজ মহাষ্টমী

মহাষ্টমীর সকালে শিবানী এল বসুন্ধরা ভিলায়। মা শুভ্রা মেয়ে ঈশানীকে সঙ্গে নিয়ে। সুরঙ্গমার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেনি শিবানী। বসুন্ধরা ভিলা থেকে গাড়ি গিয়েছিল ওদের আনতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিন ছোটকা ধারেকাছে ছিল না। শিবানী সেন গুণী শিল্পী। একজন সফল মঞ্চ-অভিনেত্রী। সুরঙ্গমা ওর নাটক দেখে মুগ্ধ। বসুন্ধরা ভিলার পুজোতে একদিন আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিল। বাড়ির লোকজন এটাই জানল। শুধু অমলকান্তি জানতেন সবটা। এখানে পুজোতে এত সিকিউরিটির কড়াকড়ি, তাই বাড়ির স্পেশ্যাল স্টিকার লাগানো গাড়ি দিয়েই ওদের আনা হয়েছে।

বসুন্ধরা ভিলায় পুজোয় আমন্ত্রিত অতিথিদের একটা উপহারের ট্রে দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তাতে শাড়ি থাকে মিষ্টি থাকে। ফল থাকে। শিবানী, শিবানীর মা শুভ্রা আর শিবানীর মেয়ে ঈশানীর জন্য আলাদা আলাদা উপহার। শিবানীর মেয়ের ট্রেতে পোশাক বানানোর সুন্দর কাপড়ের সঙ্গে একটা সুন্দর পুতুলও ছিল। তিনজনের জন্য তিনটি আলাদা ট্রে। শিবানী খুবই কুন্ঠিত বোধ করছিল।

—মানছি আপনাদের বনেদি রীতি। কিন্তু শুধু মার জন্য দিলেই তো হতো।

—আমরা যে এটা প্রত্যেক অতিথিকেই দি ভাই! আলাদা করে তো কিছু করিনি।

সকালে অঞ্জলি দেওয়ার পর অল্প ফল মিষ্টি খাইয়ে বসুন্ধরা ভিলার গাড়ি শিবানীদের বাবুবাগানের বাড়িতে ছেড়ে এলো। ঠাকুরের ভোগ দেবার পর অতিথিদের ভোগ পরিবেশন হবে। শিবানী দুপুরের শো আছে। তাকে আটকে রাখা যাবে না।

গাড়িতে ওঠার সময় শিবানী, সুরঙ্গমার দুটো হাত ধরে বলেছিল।

—আপনার মতো মানুষকে বাড়িতে ডাকার স্পর্ধা আমাদের নেই। আমার ছোটবেলায় সিনেমা হলে গিয়ে বাবা-মা’র সঙ্গে আপনার মাল্যদান সিনেমাটা আমি প্রথম দেখেছিলাম। মা এখানে আপনাকে দেখার পর আমায় আস্তে আস্তে সেই কথাটাই বলছিল। মা আরও বলছিল, এরমধ্যে কবে যেন একটা রবিবার টিভিতে আপনার প্রথম ছবি রবীন্দ্রনাথের শুভাও দেখিয়েছে। আমি দেখতে পারিনি। শো ছিল। আমাদের পরিবারে সবার কাছে আপনি এখনও সেলিব্রিটি।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৯: আধুনিক সধবারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে তত পটু নয়

শারদীয়ার গল্প-১: পুরুষোত্তম/৪

মা শুনে হেসেছিলেন। পুজো লক্ষ্মীপুজো মিটতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে শিবানী সেনের বাবুবাগানের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে বিজয়া সেরে এসেছিলেন মা। এমন একটা দিনে যেদিন শিবানীর শো ছিল না।

এতটা লেখার পর সুবর্ণ থমকে গেল। আগে একটানা বেশিক্ষণ লিখতে পারতো না। লিখতে লিখতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। অনেকটা লেখার পর মন চাইলে থামে। না হলে গড়গড়িয়ে লেখার টানে বয়ে যেতে থাকে। ল্যাপটপের মনিটর স্ক্রিনটা হাতের টানে কিবোর্ডের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। আবার খুললে যেখানে বন্ধ করেছিল সেখান থেকে চালু। মানুষের মন কিন্তু এমন নয়। যন্ত্রের মতো এত সহজে অন অফ হতে পারে না। সময় লাগে। সুবর্ণ লেখার মাঝে মাঝে একটা দুটো লাইন নিয়ে ভাবতে থাকে। সেটা থেকে যে পরবর্তী অংশটা তৈরি হবে সেরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। লেখার মধ্যে থেকেই একটা ভাবনা তাকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে এই ভাবনাটা সে ব্যবহার করবে আবার না করতেও পারে।
শ্রীতমা এখন ফ্লাস্কে গরম কফি পাঠিয়ে দেয়। লাঞ্চের পর এই সময়টা মাঝেমধ্যে কফিতে চুমুক দিলে বেশ ভালো লাগে। মনটা ফুরফুরে লাগে।
মাকে সুবর্ণ একবার জিজ্ঞেস করেছিল।

—আচ্ছা মা তুমি তো একটা সময় সেলিব্রেটি ছিলে। তখন রাস্তায় ঘাটে মলে পাড়ায় পাড়ায় এখনকার তোমাদের দেখা যেত না তাই আকর্ষণটা অনেক বেশি ছিল। অনেক বেশি মানুষ তোমাদের দেখতে ছুটতো। কেমন লাগতো তোমার? এনজয় করতে? নাকি বিরক্ত লাগতো।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

সুরঙ্গমা হাসেন। রিমলেস চশমাটা চোখ থেকে খুলে বালিশের পাশে রাখেন। খালি চোখে ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইউরোপের আকাশ অসম্ভব ঘন নীল। দুর্গাপুজো বা কনকনে ঠান্ডা পড়লে কখনও-সখনও এক-দুবার অমন ঝকঝকে আকাশ এখানে দেখা যায়।

—তোমার মা অত বড় সেলিব্রিটি ছিল না সু। মাত্র কয়েকখানা ছবি করেছি। লোকে প্রশংসা করেছে। কাগজে পত্রে লেখালেখি করেছে। কিন্তু যাকে বলে মারকাটারি হিট ছবি – তেমন তো কিছু নয়। আর এখনকার মতো তখন প্রমোশন লঞ্চিং সাকসেস পার্টি এসব ছিল না। আর ছবি করলেও আমাদের বাড়ি অনেকটা সনাতনপন্থী ছিল। আমার মামার বাড়ির দাদু মানে দাদামশাই অল্প কিছুদিনের জন্য চিফ জাস্টিস ছিলেন। বাবাপড়াশোনার জগতের মানুষ। আমার ছবিতে অভিনয় করাটা মোটামুটি একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলতে পারো।

—কিন্তু তবু তো লোকে তোমায় চিনতে পারতো সিনেমার পত্র-পত্রিকায় তোমার ছবি বের হতো। কেমন লাগতো তখন।

—খারাপ তো নিশ্চয়ই লাগত না। প্রশংসা কার না ভালো লাগে? তবেআমি কখনো ওপেন ফাংশন টাংশনে যাইনি তো। তাই ফ্যান ফলোইং ব্যাপারটা ঠিকঠাক জানিনা।
এই যে নিজের কাজকে খুব একটা সিরিয়াসলি না দেখা। নিজেকে সযত্নে কেউকেটার জায়গা থেকে সরিয়ে সাধারণ করে রাখা। এটা যে শুধু মায়ের মধ্যে ছিল তা নয় আমার বাবা সাহিত্যিক অমলকান্তির মধ্যেও সাংঘাতিকভাবে ছিল। উনি সরাসরি বলতেন—

—লেখালেখি করি গল্প উপন্যাস ছাপা হয় অল্পস্বল্প বিক্রি হয়। কিন্তু সাহিত্যিক শব্দবন্ধটা বোধহয় এখনও কাঁধে তোলার মতো কলমের জোর বাড়েনি। আসলে শরৎচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্র এঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন, তাদের জন্য কথাসাহিত্যিক সাহিত্যসম্রাট শব্দবন্ধগুলো মানানসই। কয়েক লক্ষ মাইল দূরে হলেও একই রাস্তায় হাঁটছি বলে আমার ক্ষেত্রেও সেই সাহিত্যিক শব্দবন্ধটা তাই ঠিক মানায় না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

শারদীয়ার গল্প-৩: আঁশ/২

সুবর্ণকান্তি আজ নিজের অজান্তেই লাইব্রেরী ঘর ছেড়ে বসুন্ধরা বিরাট গেট টপকে রাস্তায় চলে এসেছে। এই মুহূর্তে রাস্তাটা জনমানবহীন। শুনশান। সুবর্ণ ভাবছিল এই যে তথাকথিত চিত্রজগতের জনপ্রিয় মানুষজন ফ্যানেদের ভিড় এড়াতে আজকাল সিকিউরিটি মোটাসোটা বাউন্সার নিয়ে ঘোরাফেরা করে পুলিশ প্রোটেকশনের কথা বলে। সত্যি সত্যি যদি এই শুনশান রাস্তাটার মতো একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো হঠাৎ একজন সেলিব্রিটির ফ্যানেরা যদি উবে যায়।

যদি এমন ঘটে। রাস্তায় ঘাটে শুটিং স্পটে তাকে কেউ ফিরে দেখছে না। জোর করে বাজারে দোকানে রাস্তার ফুটপাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দিকে চোখ তুলে দেখার কারও সময় নেই। কী হবে সেই মানুষটার মানসিক অবস্থা। এতদিন যার চারদিকে হাজার হাজার উৎসুক মানুষের ভিড় যাকে বিদ্ধ করেছে সে জনতার মধ্যে একজোড়া চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যে বা যারা তাকে হয়ত লক্ষ্য করছে কিন্তু তেমন একজনকেও পাচ্ছে না। মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সুবর্ণকান্তি বলে, ভালো ছবির সাবজেক্ট হতে পারে। বসুন্ধরা ভিলার অনেক ঘটনাই ভীষণ সিনেমাটিক। অবিশ্বাস্য রকমের নাটকীয়।
চিনু দাদার পরের ভাই তনু। তন্ময়কান্তি দত্ত। পড়াশোনায় ভাল- সুদর্শন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের কনস্ট্রাকশনের দায়িত্ব সামলাত। বড় ঠাম্মি বসুন্ধরা মারা যাবার ঠিক তিন বছরের মধ্যে তনু দাদার বিয়ে ঠিক হল। পাত্র আমার মেজ জেঠিমা ছন্দার ঘনিষ্ঠ এক পরিবারের। তাঁরাও সরকারি আমলা। সুবীর গুহ মজুমদার ট্রান্সপোর্ট সেক্রেটারি। তাঁর একমাত্র মেয়ে যাদবপুর ইয়ুনিভার্সিটির কম্পারেটিভ লিটারেচারের ছাত্রী। খুব সুন্দরী। ঠাম্মি মা সকলের খুব পছন্দ। দুমদাম করে মাত্র পনেরদিনে বিয়ে হয়ে গেল। দুটো কারণে এত হুড়োহুড়ি। এক নম্বর তারপর পরপর মাস চার-পাঁচ বিয়ের তারিখ নেই। মলমাস না কী একটা ব্যাপার যখন বিয়ে হয় না আর তারপর তনুদা বা ঋতুর জন্মমাস বা মা-বাবা বিয়ের মাস। তখন নাকি বিয়ে হতে নেই। অতএব শুভস্য শীঘ্রম। দু-নম্বর তন্ময়কান্তির ম্যাঞ্চেস্টারে কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেণ্টের একটা ছ’ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করতে যাবার কথা দিন কুড়ি বাদে। সুতরাং বাড়ির সকলের ইচ্ছে তনু বিয়ে করে একেবারে নতুন বউকে নিয়ে যাক। কলেজে পড়াও হবে – বিয়ের পরের বেড়ানোও হবে। বসুন্ধরা ভিলার গুরুজনেরা অকারণ গার্জেনি ফলান না। বরং বেশ অনেকটাই লিবার্যা ল।

“ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ ঋতুর বিয়েটা এ ভাবেই হল। ঋতু আর আমি সমবয়সী। জন্মমাস ধরে হিসাব করলে বরং আমি মাস দেড়েকের বড়। ঋতু ভালো নাচত। ইউনিভার্সিটির অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে রবি ঠাকুরের শ্যামা নৃত্যনাট্যে মূখ্যভুমিকায় ঋতু। কি ভাগ্যি বিয়ের আগের দিন প্রোগ্রাম হয়েছিল। উত্তীয়ের নিঃস্বার্থ প্রেমকে ব্যবহার করেছিল শ্যামা, বজ্রসেনকে পেতে। কিন্তু উত্তীয়ের জীবনদানে প্রাণভিক্ষা পাওয়ার যন্ত্রণা বজ্রসেনকে শান্তি দিল না, শ্যামার প্রেমকে প্রত্যাখান করল বজ্রসেন। বিয়োগান্তক পরিণতি ঘটল শ্যামা বজ্রসেনের প্রেমের। উত্তীয় মৃত্যুর পরেও রয়ে গেল তাদের প্রেমের মাঝে দেওয়াল হয়ে। মা আর আমি গিয়েছিলাম শ্যামা দেখতে। কোনক্রমে আমাদের সঙ্গে দেখা করে শ্যামার পোশাকেই প্রায় বাড়ি ছুটল ঋতু। পরদিন যে কাকভোরে দধিমঙ্গল।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৪১

ঠিক একদিন পর ২২ তারিখ বিকেলের দিকে ঋতুর অস্থিরতা শুরু হল। সন্ধের পর প্রসববেদনা শুরু হল। রাতে এসে ঋতুকে দেখে সানন্দা নিজে গিয়ে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা দিলো। ২৩ তারিখ কাকভোরে মায়ের ঘরের টেলিফোন বাজল, মা ফোন ধরে যা শুনল সেই সাংঘাতিক দুঃসংবাদ শোনার ক্ষমতা বসুন্ধরা ভিলার কারও ছিল না।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content