ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।
অমাবস্যায় মহালয়া
বড়ঠাম্মি বসুন্ধরা দত্তের শুরু করা পরম্পরা রীতিনীতি মেনে এখনও বসুন্ধরা ভিলায় রথের দিনই গরানকাঠ পুজো করে প্রতিমার কাঠামো বাঁধা শুরু হয়। জন্মাষ্টমীর দিন বসানো হয় মা-দূর্গার মস্তক।
প্রথম পুজোর রীতি মেনে আজও মহালয়ার পরদিন প্রতিপদে পঞ্চঘট এবাড়ীর উত্তর-পূর্বকোণের চারতলার ঠাকুরঘরেই বসানো হয়। বসুন্ধরার দিদিমা বলতেন, মহালয়ার দিনেই মা দুর্গা সপরিবারে কৈলাস থেকে মর্তের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। তাই তাঁদের পুজোর রীতি এরকম। ষষ্ঠী নয়, বসুন্ধরার মামারবাড়ি মানে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়ির রীতি মেনে, বসুন্ধরা ভিলাতে আজও মায়ের বোধন পঞ্চমীতে। মা দূর্গার পিতলের বড় দেবীঘট – লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ-এর আরও চারটি ঘট। সেদিন থেকেই ঘটের পাশে রাখা জাগ-প্রদীপ জ্বলে সকাল-সন্ধ্যে ঘটপুজো হয়।
দেবী বোধনের আগে বাড়ির পুরুষেরা নতুন ধুতি-গেঞ্জি পরে মাথায় নতুন গামছা বেঁধে পঞ্চঘট ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানের পাশে সাদা পাথরে বাঁধানো বেলতলার বেদীতে গিয়ে রাখেন। লিফটে নয়। রীতিমতো ঢাক-ঢোল-কাঁসর-খোল বাজিয়ে সিঁড়ি দিয়ে প্রসেশন করে যাওয়া। তাই পঞ্চমী এবং ষষ্ঠীর সন্ধিক্ষণে আজও বাড়ির বিবাহিতা মেয়ে শাশুড়ি পুত্রবধূরা সোনার গয়নায় অলংকৃতা হয়ে মাকে আবাহন করতে আসেন। বেলতলা থেকে বিধি শেষে আবার পুরুষরা মাথায় করে সেই পঞ্চঘট নিয়ে যান ঠাকুরদালানে। সুবিশাল একচালা প্রতিমার সামনে।
বেলতলা থেকে ঠাকুরদালানে দেবীঘটের প্রসেশন পৌঁছলে ঢাক বেজে ওঠে কাঁসরঘণ্টা উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মধ্যে ধূপধুনো ধোঁয়ায় ঠাকুরদালানে বড় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। ঠিক আগের মতই ঠাকুরঘরে জাগ-প্রদীপ জ্বলে প্রতিপদ থেকে।ঠাকুরদালানে জ্বলে বোধন থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত। প্রথমবার পুজোতে ঠাকুরদালান ছিল না, পরের বছর তৈরি হয়েছিল। সেবার ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বলেছিল। কিন্তু সেই রীতি মেনে আজও দুটি জায়গায় প্রদীপ জ্বলে। শান্তির জল দেবার পর সেই দুই প্রদীপ নেভানো হয়।এখনও। পাঁচদিন বাদে লক্ষ্মীপুজো হয় ঠাকুরঘরে।
এখনও ঐতিহ্য পরম্পরা এসব মেনে বসুন্ধরা ভিলার প্রতিমার আগের মত বড় বড় চোখ। প্রতিমার গায়ে কাঁচা হলুদ রং। অসুরের গায়ের রং সবুজ। সিংহের রং সাদা। তার মুখ ঘোড়ার মত।এখনও প্রতিমার ডাকের সাজ। মায়ের গলার হার কানের দুল এবং নাকের নথ সোনার। আগে ষষ্ঠীর দিনে সকালেই মায়ের অস্ত্রসজ্জা সম্পন্ন করা হত এখন সেটা পঞ্চমীর দিনের আগেই সেরে ফেলা হয়। একচালার প্রতিমার পিছনে হাতে আঁকা বিরাট আকারের চালচিত্র থাকত। সে চালচিত্রের তিনটে ভাগ। ডানদিকে ওপরের অংশে রাধাকৃষ্ণ। মধ্যিখানে মহাদেব এবং বাঁয়ে রাম ও সীতা। চালচিত্রের নিচে থাকতেন বিষ্ণুর দশাবতার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতে আঁকা চালচিত্র আর নেই। সিনেমার পোস্টার এর মত টুকরো টুকরো অফসেট প্রিন্টেড ছবির অংশ নিখুঁতভাবে চালচিত্রে জুড়ে দেওয়া হয়। তবে প্রতিমার দুপাশে দেবী দুর্গার দুই সখী জয়া ও বিজয়া আজও থাকে।
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৮: কমলকান্তির সঙ্গে অনেক পরেই দেখা হল শিবানীর
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?
বসুন্ধরা ভিলার লোকজন এখন স্পন্সরশিপ নিয়ে মাথা ঘামায়। দেবীঘট ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসার অনুষ্ঠান একান্তই পারিবারিক ছিল। বেশ কিছুদিন সেই একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানকে সর্বজনীন করার প্রবল চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ঠাকুরদালানে পুজোর ক’টাদিন যেভাবে টিভি ক্যামেরা ক্রেন আলো আর অসংখ্য কর্মচারী- থিকথিক করে তাই দেখে আর অন্দরমহলকে লোকসমক্ষে টিআরপিসূচক করে তোলার ব্যাপারে উৎসাহী হতে পারেননি এই প্রজন্মের কর্মকর্তারা।
তবে এ বাড়ির সপ্তমী পুজো মহাষ্টমীর অঞ্জলি ও সন্ধ্যারতি সন্ধিপুজোর বিশেষ টেলিকাস্ট হয়। সন্ধিপুজোর সময় পরিবারের মহিলারা চন্দ্রক্ষীর বানান। এই সময় তাঁদের কথা বলা বারণ। তবে সে সব করে এজেন্সির ভাড়াটে লোক। অষ্টমীতে কুমারী পুজোর সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িতে সধবা পুজোর ছল আছে। একসময় বাড়ির নববধূ না হলে নিকটাত্মীয়ের কোন একজন নববধূকে বরণ করে পুজো করা হত। এখন সেলিব্রেটিরা আসেন সধবাপুজোয় অংশ নিতে।
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর
পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার বা সেলিব্রিটি ভোগে অংশ নেবার অধিকার সাধারণের নেই। সেটার জন্যে স্পেশ্যাল পাস আছে। সে পাস নাকি গোপনে চড়া দামে বিকোয়। নামীদামী অতিচেনা মুখকে একঝলক আমনে-সামনে দুহাত দু-পা নাড়িয়ে মানুষের মতো চলাফেরা করতে হেসে গড়িয়ে পড়তে দেখে আমজনতার যারপরনাই আমোদ হয়। চতুর্দিক সাদা পোশাকের চতুর রক্ষীপরিবৃত। একটু বেচাল দেখলেই ঘাড়ধাক্কা। লোকজন বড়বড় চোখে হাঁ করে দেখে। সেলেবরা ফোনে কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক কথা-গল্প বা প্রতিমাকে ভক্তিপ্রণামের আড়ালে-অপাঙ্গে ক্যামেরায় ল্যুক ঠিক রাখতে রাখতে আমজনতার হতবাক অবস্থাকে বেশ উপভোগ করে।
— আমাদের বাড়িতে মানে বসুন্ধরা ভিলায় খুব সুন্দর দূর্গাপুজো হয়। জানো?
সুরঙ্গমার প্রশ্ন শুনে শিবানী সেন সেদিন একটু চুপ করে থাকলেন। মহালয়ার পরেই ছোটকা মাকে নিয়ে গিয়েছিল তার প্রযোজনায় মানে অর্থলগ্নী করা পেশাদার মঞ্চে থিয়েটার দেখাতে। আসল উদ্দেশ্য ছিল শিবানীর সঙ্গে আলাপ করানো। মানে আমার মা সুরঙ্গমাই চেয়েছিলেন শিবানীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। আলাপ করতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সাক্ষাৎকার একান্ত গোপনীয় ছিল।
আমি সেই সাক্ষাৎকারের বর্ণনা শুনেছি। কল্পনার রঙে রঙ মিশিয়ে দৃশ্যচিত্রণ করেছি মাত্র।
— জানি তো নিশ্চয়ই। কাগজে পড়েছি। টেলিভিশনে দেখেছি ।
— ছোট্টু মানে কমলের সঙ্গে তোমার এতদিনের পরিচয় কখনও বলোনি যেতে চাও? দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…
শিবানীর সঙ্গে কথা বলার না থাকলে মা কোন অবস্থাতেই নাটকটা দেখতে যেত না।
— নাকি বলেছিলে? ছোট্টু এড়িয়ে গিয়েছে।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন
—না না, সেরকম কিছু নয়। পুজোর চারটে দিন তো আমাদের ডাবল শো থাকে। রাতে শোয়ের শেষে বাড়ি ফিরে এক-দুদিন মেয়েকে নিয়ে বেরোতেও হয়। সকালে হয়তো একটু রান্নাবান্না করলাম। সেভাবে সময় পাওয়া যায় না। আমারই বলে ওঠা হয় নি।
—দেখো শিবানী আবার কবে আমাদের দেখা হবে আমি জানি না। আর আমি এখন বাড়ি থেকে খুব একটা বের হই না। আজ তোমার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছিলাম। আমি জানি একটু পরেই তোমাদের নেক্সট শো শুরু হবে তার আগে তোমাকে একটুখানি স্পেস দেওয়া উচিত। তা আমি যে কথাটা জিজ্ঞেস করতে এসেছি সেটাতেই সরাসরি চলে যাই।
শিবানী তার বড় বড় চোখ তুলে সুরঙ্গমার চোখের দিকে তাকায়।
— হ্যাঁ বলুন না। এখনও তো বেল পড়েনি।
— ছোট্টুর সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা নিয়ে তুমি ঠিক কি ভাবছো?
—আমি তো কিছু ভাবি নি ! ওঁকে আমি কিছু বলিওনি কখনও। আমার সম্বন্ধে উনি আপনাকে ঠিক কতটা বলেছেন আমি জানিনা। আসলে আমার জীবনটা ভীষণ অনিশ্চিত। আমি কখনও ভেবেচিন্তে প্ল্যান করে এগোইনি। পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজেকে খানিকটা ভাসিয়ে দিয়েছি। একটার পর একটা ঘটনাস্রোতে ভেসে গেছে আমার জীবন। এভাবেই ভাসতে ভাসতে একদিন কমলবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়। ওঁনার পরিবার, পারিবারিক মর্যাদা সমাজে বসুন্ধরা ভিলার স্ট্যাটাস এই সবকিছু আমাদের মধ্যে যে একটা সংশয় তৈরি করবে এটা আমি বুঝি। তাই এই সম্পর্ক থেকে আমি কিছু আশা করি না। উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ আমাকে নানাভাবে… শুধু আমাকে নয় আমার গোটা সংসারকে সাহায্য করেন। আমি যদি না বলি তাহলে ওঁকে, ওঁর পৌরুষকে, আত্মমর্যাদাকে আঘাত করা হবে। সেই অপমানটা আমি কোনওদিন করতে পারবো না। কিন্তু আমি এই সম্পর্কের থেকে কিছু আশা করি না।
সুরঙ্গমা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক সিনেমার মতোই মেয়েটির বিগ ক্লোজ-আপ। আবহে দ্বিতীয় শোয়ের ফার্স্ট বেল বাজছিল। সুরঙ্গমা ঠিক সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করেছিলেন কেন কমলকান্তি এত মেয়ে থাকতে শিবানীর সঙ্গে পরিণতি অসমাপ্ত জেনেও এই অপ্রকাশিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।—চলবে।