ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
সোনায় মোড়া হৃদয়
চায়ের কাপে লম্বা চুমুক সেরে কমলকান্তি বললেন—
—তুমি যা বলো সব সময়। “আমি বিধবা। আমার একটা মেয়ে আছে। আমি চাই না আমাকে জড়িয়ে আপনার আপনার পরিবারের বসুন্ধরা ভিলার মর্যাদায় কোনওরকম গ্লানি লাগুক।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
—দেখুন আপনি আমাদের জন্য যা যা করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতার কোন ভাষাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, যে আমার স্বামী ইন্দ্র’র মৃত্যুটা নিছক দুর্ঘটনা ছিল না
—মানে?
—ইন্দ্র আত্মহত্যা করেছিল!
—এ সব কি বলছ? কেন বলছ?
—কারণ আছে তাই বলছি। আর আমি যা বলছি ঠিক বলছি। আজ আপনাকে অনেকগুলো কথা বলব বলেই ডেকে পাঠিয়েছি। যেগুলো শুনে ভীষণ ভীষণ অবাক হবেন। আমার সম্বন্ধে ধারণাটা হয়ত পাল্টে যাবে। ইন্দ্র ভীষণ চাপা স্বভাবের ছেলে। এক রোববার শোয়ের শেষে ঐ নাটকের নায়িকার একটা বার্থডে পার্টি করা হয়েছিল। আমি জানতাম না। তিনি সিনেমার খুব নামী অভিনেত্রী। এক সঙ্গে অভিনয় করি তাই কিছুটা ভদ্রতা এবং পেশাগত কারণেই সেটা এড়িয়ে আলাদা করে চলে আসা যেত না। তাই আমার ফিরতে দেরি হয়েছিল। ইন্দ্র খুব দুশ্চিন্তা করছিল। স্বাভাবিকভাবেই দেরি হবার কারণ জানতে চাইল। খুব ক্লান্ত ছিলাম অকারণেই মনে হল ইন্দ্র আমায় সন্দেহ করছে। যেটা সত্যি নয়। আমার মনগড়া সন্দেহ। কিন্তু আমি সেই সন্দেহের বশেই খুব খারাপ ব্যবহার করলাম। ভুল কারণে দুজনেই দুজনকে ভুল বুঝলাম। পরদিন আমাকে ঘুম থেকে না দেখে ইন্দ্র বাড়ি ছেড়ে গেল। রাতে ফেরার পথে।
—ইন্দ্রবাবু তো ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
—হ্যাঁ, তবে অসাবধানে নয়। ইচ্ছে করে। যাতে মনে হয় এটা দুর্ঘটনা।
—আবারও ভুল হচ্ছে না তো।
—না। আর এই কারণে ইন্দ্রর ওই ঘটনার জন্য আমি নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না। যতদিন বেঁচে থাকবো। ক্ষমা করতে পারবো না। আপনি যেভাবে আমার বিপদের সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইন্দ্র একদিন সেভাবেই সাহায্য করতে গিয়ে আমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিয়ে করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই জেনেও এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইন্দ্র’র পর আপনি একজন যিনি আমাকে সাহায্য করতে চান আমার পরিবারকে সাহায্য করতে চান। আমি যদি ভুল না করি তাহলে আমাকে আবার একটা পরিবার ফিরিয়ে দিতে চান।
—ইন্দ্রকে আমি আঘাত করেছি। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে ও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। ইন্দ্রকে ভুলে গিয়ে আমি আবার নতুন করে সংসার করতে পারব না। আপনি আমাকে ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু আমি আপনাকে ঠকাতে পারবো না। আর এই যে শিবানী আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার একটা ভয়ঙ্কর অতীত আছে সেটা আপনাকে আজকে শুনতে হবে।
শিবানী চুঁচুড়া থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা বলে যেতে লাগল। নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে সবকথা উজাড় করে বলে গেল।
সব কথা শোনার পর কমলকান্তি কোনও কথা না বলে সেদিন ফিরে গিয়েছিল। কখনও কখনও কারও সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবার পর মনে হয় এতদিন পরে কেন চিনতে পারলাম এঁকে? আরও আগে কেন দেখা হলো না। শিবানী সেদিন ঠিক সেই রকমই মনে হয়েছিল।
আমার বড়ঠাম্মি বলতেন, পরে আমার ঠাম্মিকেও বলতে শুনেছি।মা সেভাবে না বললেও কথাটার মর্যাদা দিতেন। ঈশ্বর পৃথিবীতে প্রত্যেকটি ঘটনা কার্যকারণ অনুযায়ী ঘটান। যাঁদের কথা বললাম তারা কেউই নাস্তিক নন। আমিও নই। নিশ্চয়ই কোন গূঢ় কারণ ছিল, তাই কমলকান্তির সঙ্গে শিবানীর দেখা হল অনেক অনেক পরে। আমার ছোটকাকে বাইরে থেকে যতটা হালকা স্বভাবের মনে হয় সে কিন্তু তা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বসুন্ধরা ভিলার অনেক চরিত্রের মতোই সে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তার একটা সোনায় মোড়া হৃদয় ছিল। আমার মা সুরঙ্গমা যখন বসুন্ধরা ভিলায় বিয়ে হয়েছিল তখন মায়ের বয়স মাত্র ২১। আর ছোটকা তখন ১৫ বছরের কিশোর। ন’কাকা তরুণকান্তি মাকে বন্ধুর মতো সব বলতে পারত।
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৭: গাড়িটা কমলকান্তিকে নামিয়ে চলে গেল
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৬: তেলাপিয়া মাছের বড় সুবিধা হল, একে যে কোনও জলাশয়ে যখন খুশি চাষ করা যায়
ছোটকা কমলকান্তি মাকে এসে সব বলেছিলেন। সব মানে সব। শিবানীর সঙ্গে আলাপ হওয়া শিবানীকে ভালোলাগা। শিবানী ও তার পরিবারকে সাহায্য করা। শিবানীদের বাড়ি বদল শিবানীর মেয়ে স্কুলবদল। এই সেদিন শিবানী তার জীবনের যা যা কথা বলেছিল তার সবকিছু সবটুকু।
পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!
শিবানীর কাছ থেকে সেদিন সবকিছু শোনার পর কেকে সোজা বাড়িতে এসেছিল। মাকে ছাতে নিয়ে গিয়ে সব বলেছিল।
— ছোট্টু! শিবানীকে কি তুই ভালোবাসিস?
— দেখ সেজবৌদি। আমি বিরাট কিছু না করলেও বসুন্ধরা ভিলার ছেলে। এতদিনে নানান মহিলা আমার সঙ্গে আলাপ করেছে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছে। তাদের কাউকেই আমার এমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি যে তোর কাছে এসে বলতে পারি। শিবানীকে ভালো লাগে। শিবানীর ওর পরিবারের ভালো হোক এটা আমি চাই। মেয়েটা যে আমাকে তার জীবনের সমস্ত কথা বলেছে এই সাহসটা আমাকে খুব ধাক্কা দিয়েছে। আরও অনেক কম বয়সে দেখা হলে কি হতে জানিনা। কিন্তু এখন বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে তো – তাই ভালোবাসি এ কথাটা ঠিক বলতে পারছি না। আমি তোর সাহায্য চাই একদিন তুই মেয়েটার সঙ্গে কথা বল।
— আমাকে কথা বলতে বলছিস কেন? তুই কি শিবানীকে বিয়ে করতে চাস ছোট্টু পরিষ্কার বল?
— আমি ঠিক জানিনা সেজবৌদি। হয়তো বসুন্ধরা ভিলার কেউ না হলে একেবারে বিয়ে করেই ওকে নিয়ে ঘরে আসতাম। কিন্তু ঠাকুমা বসুন্ধরা দত্ত, বাবা বিনয়কান্তি দত্ত মা স্বর্ণময়ী। বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ। বসুন্ধরা ভিলা। সাহিত্যিক অমলকান্তি। এমনকি তুই আমার সেজবৌদি। বাঙলা ছবির দুনিয়ায় অত্যন্ত অভিজাত শ্রদ্ধেয় একটা নাম। এগুলো আমার মাথার মধ্যে এক একটা দেওয়াল। আমি কিছু ঠিক করতে পারছি না আমি তাই তোর সাহায্য চাই।—চলবে।