রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


এ শহর প্রান্তর। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

।। একটা চেনদেওয়া চটের ব্যাগ।।

গত রাতের ঘটনার পর এখন অনুতপ্ত শিবানী। খুব কাছাকাছি ইন্দ্রকে যবে থেকে দেখছে তত স্পষ্ট ভাবে তাকে চিনতে পেরেছে শিবানী। সিংহানিয়ার সঙ্গে কলকাতায় থাকা। বম্বে যাওয়া বম্বে থেকে ফিরে আসা। নাটকে জয়েন করা। এসব বিষয়ে একটাও কথা কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি ইন্দ্র। শিবানীর অজানা অতীত নিয়ে একেবারেই কৌতুহল দেখায়নি সে। শিবানীর দেরি হচ্ছে সেটা ইন্দ্রকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল। কলকাতা শহর আর আগের মতো নেই নানা জায়গায় নানা কিছু ঘটে যাচ্ছে। সেসব ভেবেই ইন্দ্র ছটফট করছিল। অথচ শিবানী অত না ভেবেই তাকে একটা দূর্বল জায়গায় ধাক্কা দিয়ে দিয়েছে। সকালে একবারও কথা বলল না?

—আমি তো তোকে ডাকতে গিয়েছিলাম ইন্দ্র মানা করলো। বলল কাল ডবল শো ছিল। অনেক রাত্তিরে ফিরেছে। ক্লান্ত। ডাকবেন না। ও জানে আমি আজ ভোরে বেরোবো।

সারাটা দিন শিবানীর অস্বস্তিতে কেটেছে। আজকের এই মুহূর্তের যোগাযোগের দিনে এসে সে সময়ের অনুভূতিটা ঠিক ভাবা যায় না। শিবানী ঠিক করে নেয় ইন্দ্র বাড়ি ফিরলেই আজ পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কথা দেবে যে এমন ভুল আর কোনদিন হবে না।

কিছু লোক আছে যারা দুম করে রেগে যায়। মুখে যা আসে বলে দেয়। ভেতরে কিছু জমিয়ে রাখে না বলেই উত্তেজনা চলে গেলে সে মানুষটাই একদম ঠান্ডা নিজের ভুল বুঝতে পারে। শিবানীর প্রকৃতিটা অনেকটা এরকম। অথচ ইন্দ্র ঠিক উল্টোটা। রাগ করে না উত্তেজিত হয় না। কিন্তু এই ধরনের মানুষের মনের ভেতরে ধাক্কা লেগে গেলে সেটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। সেই ক্ষত শুকিয়ে দাগ মিলিয়ে যেতে বহু-বহুদিন সময় লাগে।

সকাল দুপুর সন্ধ্যে রাত যেন আর কাটছে না। পয়সা বাঁচানোর জন্য কখনও কখনও ট্রাম ডিপো থেকে হেঁটে আসে ইন্দ্র। কোনও প্রোডাকশন চালু থাকলে গাড়ি নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসে না মেইন রোডে ছেড়ে নস্কর পাড়া রোডটা হেঁটেই আসে। শিবানী অপেক্ষা করছে কখন এসে নিঃশব্দে দাঁড়াবে ইন্দ্র। মেয়েটা আজকে বড্ড বায়না করছিল কান্নাকাটি করছিল। মা এখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। শিবানীর কিছু ভালো লাগছে না। বসে বসে একটু তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। একটা গাড়ির ঘর ঘর শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। তাদের জানালার পাশেই গাড়িটা দাঁড়িয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুভ্রা জানলার ছিটের পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেছে।

—ও শিবানী! পুলিশের জিপ।
রাতের কলকাতায় রাস্তায় পুলিশের জিপে করে শিবানী চলেছে। হাওয়া চুল উড়ছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। শরীরটা কেমন যেন এলিয়ে আসছে। বাচ্চাটাকে নিয়ে শুভ্রা শিবানীর সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। লোকাল থানার ইন্সপেক্টর ছিল। তিনি মানা করলেন।

—বাচ্চা নিয়ে আপনি যাবেন না। বাড়িতে থাকুন। আমরা গড়িতে ঢোকার সময়ে মোড়ের মাথায় যে ক্লাবটা আছে ওখানে বলে রেখেছি। ক্লাবের দু-তিনজন ছেলে আপনার মেয়ের সঙ্গে যাবে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৪: কথাটা যেন চাবুকের মতো আঘাত করল ইন্দ্রকে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’

ইন্সপেক্টর বলেছেন ইন্দ্র’র নাকি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই সঙ্গে একটু টাকা পয়সা নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট হলে তো হাসপাতালে যাবার কথা। কিন্তু তাদের শিয়ালদা স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? শিবানী একবার দু’ বার জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছে। ড্রাইভারের পাশে বসা পুলিশের লোকটি উত্তর এড়িয়ে গেছে। জিপের পেছনের সিটে পাড়ার ক্লাবের তিনজন ছেলে রয়েছে। ওদের একজনের নাম জানে বাকি দুজনের মুখ চেনা। বাবিল বলে ছেলেটা পাড়ার কালীপুজোতে দু-একজন ফিল্মস্টার এনে দিতে বলেছিল ইন্দ্রকে। ইন্দ্র সরাসরি বলেছিল ওর সেরকম কারো সঙ্গে পরিচিতি নেই।

বাবিল জানতো শিবানী শ্যামবাজার পাড়ার কাশী বিশ্বনাথ নিয়মিত অভিনয় করে। কাগজে বিজ্ঞাপন বের হয়। যখন স্বল্প পোশাকে মঞ্চে নাচত তখন কালো ওড়নায় মুখঢাকা মিস ক্যুইন হিসেবে তার উন্মুক্ত শরীরী বিভঙ্গের ছবি কাগজে ছাপা হতো। হলের বাইরে তার বিশাল কাট-আউট থাকতো। অথচ সে যখন নাচ ছেড়ে ভালো অভিনয় করতে শুরু করল তখন আর কাগজে তার নাম থাকে না। হলের ভেতরে একটা পোস্টারে অনেকের সঙ্গে তার নামটা থাকে। টিকিট কাউন্টারের পাশে যে স্টিলসগুলো তাতে শুধু চেনা মুখের ভিড়।

শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে ভেতরে যেতেই ইন্দ্র’র চেন দেওয়া চটের ব্যাগটা তাকে দেওয়া হল। এরপর আর শিবানীর কিছু মনে নেই। সিরিটি শ্মশানে ইন্দ্রর মৃতদেহ দাহ করা হয়েছিল। বারাসাত থেকে ফিরতি ট্রেনে হৃদয়পুর স্টেশনের আগে ইন্দ্র রায় ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। ট্রেনের চেন টেনেছিলেন কেউ। কামরায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা ট্রেনের ড্রাইভারকে বলেছিলেন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রলোক। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন স্টেশনে ঢোকার আগে ট্রেনটা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি স্পিডে লাইন চেঞ্জ করছিল। আচমকা ঝাঁকুনিতে ভদ্রলোক হাত ফসকে দরজা দিয়ে বাইরের ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনা। আত্মহত্যা বা খুন নয়। ব্যাগের মধ্যে রোজকার যা থাকতো সেই সবই রয়েছে। বোঝার উপায় নেই সব আছে। কিন্তু রক্তমাংসের গোটা মানুষটা আগুনে পুড়ে কালো ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

কেউ জানুক বা না জানুক। শিবানী জানে এটা দুর্ঘটনা নয়। ইন্দ্র চায়নি সমাজের কাছে শিবানীর ও তাদের সন্তান ঈশানীর কোন মর্যাদা হানি হয়। তাই ভেবেচিন্তে তার আত্মহত্যাকে একটা নিছক ভুলবশত দুর্ঘটনার চেহারা দিয়েছে। বারাসাতে যে গ্রুপের নাচের জন্য ইন্দ্র গিয়েছিল তারা ইন্দ্রর মৃত্যুর খবর পেয়ে শিবানীর সঙ্গে এসে দেখা করে গিয়েছে। তারা জানিয়েছে তাদের ক্লাবের পক্ষে মাসমাইনে দিয়ে ইন্দ্রকে নাচের টিচার হিসেবে রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মানুষটাকে তাদের খুব ভালো লেগেছিল। প্রাথমিকভাবে না বললেও তারা পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্লাসের দিন কমিয়েও যদি ইন্দ্র বারাসাত গিয়ে এই কাজটা একটু কম টাকায় করতে রাজি হয়। সেদিনই কাজটা হয়ে গেলে হয়তো ইন্দ্র এভাবে চলে যেত না। এরকম বহুদিনের ব্যর্থতার মুহূর্ত বয়ে নিয়ে এসে তার বিবেক তাকে বলেছে—

—এটাই স্ট্রাগল। হেরে গেলে চলবে না বুঝলে শিবানী। চেষ্টা করে যেতে হবে।

আর কেউ না বুঝলেও চতুর্থীর শ্রাদ্ধ করতে করতে শিবানী বুঝতে পারছিল হার না মানা ইন্দ্র রায় সেদিন হঠাৎ যেচে হেরে গেল কেন? আসলে ইন্দ্র যার কাছে ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি ফিরে পেতো সেই শিবানীই যে আগের রাতে ইন্দ্রর আত্মবিশ্বাস আত্মমর্যাদাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। সেই ক্ষোভ সেই অভিমান ইন্দ্রকে ঘুরে দাঁড়াতে দিল না।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

কিন্তু শিবানীকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নিজের জন্য না হলেও তার মেয়েকে মানুষ করার জন্যে লড়াইয়ে ফিরতেই হবে।

এই দুর্ঘটনার আরো বছর চারেক পর শিবানীর সঙ্গে পরিচয় হলো বসুন্ধরা ভিলার ছোট ছেলে কেকে বা কমলকান্তির। কমলকান্তি সে বছরই তার এক বন্ধু প্রযোজকের নাটকে একটা মোটা টাকা লগ্নি করেছে। এর আগে সেই বন্ধুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে কিছু টাকা ধার দিয়েছিল। বন্ধু সে টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যে। কমলকান্তি বুঝেছিল এই ব্যবসায় টাকা ফিরছে। ঘনঘন না হলেও মাঝেমধ্যে কমলকান্তি কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে নাটক দেখতে আসতেন। এ নাটকে শিবানীর চরিত্র বেশ বড়। বেশ ভালো অভিনয় করেছিল। তবে বিরতির পর তৃতীয় দৃশ্যে শিবানীর চরিত্রটি খুন হয়।

স্বাভাবিকভাবেই মেকআপ তুলে বাড়িফেরার প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি থাকে শিবানী। কিন্তু দক্ষিণের দিকে তাদের রাস্তায় যারা ফিরবে তাদের নিয়েই তো গাড়ি বের হবে তাই নাটকের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতেই হয়। না হলে নিজের খরচা করে ট্যাক্সি করতে হবে। সেদিন শিবানী দৃশ্য যখন চলছে তখনই স্টেজ ম্যানেজারের নম্বরে ফোন এসেছিল। শিবানির মা শুভ্রা পাড়ার এসটিডি বুথ থেকে ফোন করে জানিয়েছিল শিবানীর একমাত্র মেয়ে ঈশানীর বিকেলের পর থেকে ধুম জ্বর। নাতনিকে নিয়ে তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন। শিবানী সিন শেষ করে এসে খবর পেয়েই ব্যাগ নিয়ে মেকআপ না তুলেই ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। ট্যাক্সি করেই চলে যাবে সে।—চলবে।

শেষযাত্রা। ছবি: সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩৬

গাড়ির আলোয় মেয়েটির মুখ দেখেই চমকে উঠল।‘আরে এতো শিবানী। কাশী বিশ্বনাথের অভিনয় করে।’ সেদিন শিবানী যখন তড়িঘড়ি হল থেকে বেরিয়ে যায় – ঘটনাটা কেকের সামনে ঘটেছিল।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content