রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ঘর-গেরস্থালি। জন-অরণ্য। ছবি: সংগৃহীত।

।।নতুন জীবন।।

ইন্দ্রর ইশারায় ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে শিবানীর মনে হল কমটাকায় বাড়ি খুঁজতে গেলে মেন রোড থেকে তো একটু ভেতরে আসতে হবেই। রিজেন্ট পার্কের ফ্ল্যাট আর কোথায় পাবে? মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রইল। সেখানে সম্ভবত ইন্দ্রর পরিচিত একটি ছেলে অপেক্ষা করছিল। তাকে ট্যাক্সির সামনে দাঁড় করিয়ে ইন্দ্র কালী মন্দিরের দিকে ঢুকছে দেখে শিবানী ভাবল ‘ভালোই হল এতদিন তো অনেক ঝড় ঝাপটা গেল। ভারসোভার আরামনগরের ছাওলে রাখা সেই ছোট্ট মা কালীর ছবিটা ছাড়া কখনও মন্দিরে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ানো হয়নি। মন্দিরের ভিতরে পা রাখতে মন্দিরের ভেতর থেকে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে এলেন—

—এসে গিয়েছেন যান যান তৈরি হয়ে আসুন।

এ বার ইন্দ্র শিবানীর দিকে তাকাল একটু যেন অন্যরকম চাউনি। শিবানী হাতে এতক্ষণ সঙ্গে রাখা ছোট কিটব্যাগ থেকে একটা লাল রঙের শাটিনের শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল—

—শিবানী এখানে একটা ঘর আছে। ওখানে গিয়ে এই শাড়িটা পরে তৈরি হয়ে এসো।

শিবানী বেশ অবাক।

— বিয়ের শুটিং? কই বলনি তো?

—বলার আর সময় পেলাম কই?

—কিন্তু শুধু এই শাড়িটা? ব্লাউজ মুকুট মালা ভেল তারপর চন্দন পরানো নেই।

—সব বলব তুমি তৈরি হয়ে এসো। একটু অন্যরকম গল্প।

—মালপত্র নিয়ে এভাবে এগুলো হয় নাকি? আগে বললে।

—বাড়িটা যে ছাড়তে হতো। শিফটিং তো আজকেই করতে হতো। বেশিক্ষণের কাজ নয়। যাও যাও রেডি হয়ে নাও।

—লাইট ক্যামেরা এ সব।

—নেচারালি শুট করবে। বললাম না অন্যরকম গল্প।

শিবানী কথা না বাড়িয়ে ঘরটায় ঢুকে গেল। ফিরে এসে দেখল। মন্দিরের চাতালে বিয়ের আয়োজন। কনের সিঁথি মুকুট বরের টোপর একজোড়া রজনীগন্ধার মালা আছে, ব্রাহ্মণ আছেন আর বর আছে। আর কেউ নেই। বরের পোশাকে ইন্দ্র নিজে।

—কি হচ্ছে আমি এসব কিছু।

—এছাড়া কোন উপায় ছিল না। এটা না হলে তোমায় আমি আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলতাম কি করে? মা বেঁচে থাকলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হয়ত এই বিয়েটা দিতেন। তোমার কাছে তোমার বাড়ির যে কথা শুনেছি তাতে তোমার মা-বাবা হয়তো কেউই বিয়েতে রাজি হতেন না। কাল থেকে অনেকবার ভেবেছি। অনেক রকম করে ভাবার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আর কোন সমাধান মাথায় আসেনি। বসো। দেরি হয়ে যাবে।

বিয়ের পর করুণাময়ী কালীবাড়ির পাশের একটা মিষ্টির দোকানে কচুরি তরকারি রসগোল্লা আর মিষ্টি দই দিয়ে বিয়ের খাওয়া দাওয়া হল। বর-কনে বামুন ঠাকুর ট্যাক্সি ড্রাইভার আর ইন্দ্রর পরিচিত সেই ছেলেটি।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩২: সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডান্স ডিরেক্টর ইন্দ্র রায়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

কালী মন্দির থেকে একটুখানি গেলেই নস্কর পাড়া রোডে ইন্দ্রর বাড়ি। বাড়ি না বলে ঘর বলাই ভালো। একটা ঘর রান্নাঘর বাথরুম পায়খানা ব্যাস। ইন্দ্ররা ওপার বাংলার মানুষ। ওপার থেকে এপারে এসেছিল। বারাসতে থাকতো। বাবা মারা যাবার পর মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে। তখন থেকে জীবনের লড়াই লড়ছে ইন্দ্র। ইন্দ্রর আশপাশে যারা থাকেন তাদের মধ্যে এসব বিয়ে নিয়ে কোন উৎসাহ ছিল না। ইন্দ্রও সেটা চায়নি। বাড়ির মধ্যে বেশ গরম। পাখা আছে কিন্তু তাতে হাওয়া কম।

নস্কর পাড়া রোড ধরে টালি নালার দিকে এগিয়ে গেলে এপারে ইটখোলা পূর্ব পুটিয়ারি। ওপারে পশ্চিম পুটিয়ারি। বাঁ হাতে কোনাকুনি এগোলে কুদঘাট বাজার। জল থেকে বয়ে আসা হাওয়া একটু ঠান্ডা হয়। সন্ধ্যেবেলায় সেদিন ইন্দ্র’র সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে অনেক কথা মনে হচ্ছিল শিবানীর। লোকটা তো অদ্ভুত। শিবানীকে বিপদের থেকে বাঁচানোর জন্য বিয়ে করে ফেলল।

শিবানীর এতগুলো দিন কিভাবে কেটেছে? বম্বেতে কীভাবে কাটিয়েছে তার কোনও কথাই জানতে চাইনি ইন্দ্র। অথচ শেষ যেদিন ইন্দ্রর সঙ্গে দেখা হয়েছিল স্টুডিয়োতে সেদিন রাতে পার্টিতে বা পার্টির পরে সিংহানিয়ার সঙ্গে কী হয়েছিল বা কী হতে পারে এতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে থাকার পর ইন্দ্রর কাছে সেটা জলের মতো পরিষ্কার। কেন একজন প্রযোজক একা একজন মহিলাকে রিজেন্ট পার্কের ওই ঝকঝকে ফ্ল্যাটটা দিয়েছিল সেটা বুঝতেও খুব বেশি বুদ্ধি লাগে না।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

এত কিছুর পরেও ইন্দ্র তাকে? কী করে? কি করে মানুষ এতটাই নিষ্পাপ হয়? কী করে সে তার জীবনসঙ্গীকে এত সহজে বিশ্বাস করতে পারে? অথচ শিবানী তো এক একটা সিঁড়ি ব্যবহার করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছে। বুল্টিদা থেকে ইন্দ্র। ইন্দ্র থেকে সিংহানিয়া। সিংহানিয়া থেকে বম্বে। হ্যাঁ, তার পরে মুখ থুবড়ে পড়া থেকে সিংহানিয়াই তাকে বাঁচিয়ে আবার কলকাতা ফিরিয়ে এনেছিল। এখন সিংহানিয়া তাকে বাতিল করে দিয়েছে। আজআবার স্বার্থের জন্য ইন্দ্রকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছে। ইন্দ্র কি এগুলো বোঝে? বুঝে বুঝেও সে শিবানীকে এভাবেই গ্রহণ করল?

মাথা দোলাতে দোলাতে একঘেয়ে ঘর ঘর শব্দ করে ফ্যান ঘুরছে। খোলা জানলার আব্রু ছিটের পর্দা-বেয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের জালে-ঢাকা জ্বলে থাকা বাল্বের মিয়োনো আলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে। জানলার দিকে দেয়াল ঘেঁষে ঘরে ঘুমোচ্ছে ইন্দ্র। মুখ চোখ ঘামে ভেজা। মিয়োনো আলোয় চকচক করছে ইন্দ্র’র ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর। তবু সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মানুষটার লোভ নেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই দাবি নেই সন্দেহ নেই অবিশ্বাস নেই জীবনের প্রতিটি দিনকে সঙ্গে নিয়ে চলা একজন সাধারন মানুষ। তার পাশে শুয়ে শিবানীর মধ্যে সংশয় আকাঙ্ক্ষা না পাওয়া ক্ষোভ অস্থিরতা অনিশ্চয়তা সবকিছু একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। তাই এমন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় এসেও তার চোখে ঘুম নেই।

ইন্দ্র-শিবানীর গল্প থেকে সুবর্ণ একটু বিরতি নিল। এবার কি একটু বসুন্ধরা ভিলার অন্য গল্পে যাবে সুবর্ণ? আসলে কোনকালে তো লেখার অভ্যেস নেই। নিজের কাছে মিথ্যে বলতে নেই। তাই সুবর্ণ স্বীকার করে যে বাবা চলে যাবার আগে পর্যন্ত কখনই খুব একটা সিরিয়াসলি বাবার লেখা পড়েনি। মা পড়তেন। প্রথম থেকেই পড়তেন। লেখার পরে বাবা কখনও-সখনও মাকে কোন একটা লেখা বা কোন উপন্যাসের বিশেষ কোন একটা জটিল অংশ পড়ে শোনাতেন। মতামত নিতেন। নিজেকে থামিয়ে সেটা নিয়ে ভাবতেন প্রয়োজনে পরিমার্জন পরিবর্তন করে নিতেন। সুবর্ণও শোনায় শ্রীতমাকে। বা-কখনও মাকে। তবে অমলকান্তি তো আর সুবর্ণর মতো একটা উপন্যাসে আটকে ছিলেন না। গল্প উপন্যাস বিশেষ সংখ্যায় প্রবন্ধ প্রতিবেদন। কখনও বিশিষ্ট সিনেমা বা নাটকের আলোচনা। অন্য লেখকদের শ্রেষ্ঠ গল্প সেরা গল্প উপন্যাস সংকলন নিয়ে কাজকর্ম এমনকি সময় করে লিটিল ম্যাগাজিনের নববর্ষ বা শারদ সংখ্যায় লেখা দিতেন অমলকান্তি দত্ত।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪০: একসঙ্গে বহু ছবিতে অভিনয় করা সত্ত্বেও প্রদীপ কুমার সে দিন চিনতেই পারলেন না উত্তম কুমারকে!

সুবর্ণর অন্য কাজকর্মে কখনই আত্মবিশ্বাসের কোনও অভাব হয়নি। তবে নিজের লেখা নিয়ে তৃপ্তির অভাব আছে । ভালো না লাগার ভয় আছে। একঘেয়েমির সংশয় আছে। গতিহীনতার উৎকণ্ঠা রয়েছে। বসুন্ধরা ভিলার এত চরিত্র আর তাদের জীবনের এত ধরনের বিচিত্র গল্প যে কোনটা আগে বলবে আর কোনটা পরে, সেটা বড় ধাঁধাঁর মতো লাগে।

ঝকঝকে দামি গাড়ি থেকে মাটিতে পা-রাখা চকচকে নামী মানুষকে দেখলে তার ঠাট-বাটের আড়ালে রাখা গভীর-গোপন গল্পটা যেমন বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় না ঘন সবুজের লনে ঘেরা এই দুধসাদা রাজপ্রাসাদ বসুন্ধরা ভিলার বাইরে থেকেও তেমন এর ভেতরের মানুষজন আর তাদের মনের ভেতরের গল্পের কোনও আগাম আভাস পাওয়া যায় না।

কিন্তু শিবানীর গল্পটাই সুবর্ণকে টানছে। প্ল্যানচেটের সময় আত্মা যেমন তিনপায়াওলা তেকোণা লোহার পাতকে টানে তেমনভাবে লেখার চরিত্ররা তার গল্প বলতে বাধ্য করে। এই ধাতব পাতকে সাহেবরা “প্ল্যানচেটে উইজ্যা’ বলে। মানে একটা কাঠের বোর্ড। ওপরের এককোণে ‘ইয়েস’ অন্যকোণে ‘নো’। মাঝে দুসারিতে লেখা ‘এ থেকে জেড’ ছাব্বিশটা ইংরেজি বর্ণমালা। তার নিচে ‘শূণ্য থেকে নয়’ দশটি সংখ্যা। তারও নিচে “গুড বাই”। ভর করা আত্মাকে যা প্রশ্ন করা হবে তেকোণা ধাতব পাত বা উইজ্যাকে এইসব হ্যাঁ, না, বর্ণমালা আর সংখ্যার মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আত্মা ,সেই ক্যুইজের উত্তর দেবে। যখন মর্জি হবে আত্মা ‘গুড বাই’ ছুঁয়ে চলে যাবে। —চলবে।

সাদাকালো ছবি। ছবি: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩৪

কথাটা যেন চাবুকের মতো আঘাত করল ইন্দ্রকে। শাশুড়ি মা আসার পরে ঘরের মধ্যে একটা চিলতে জায়গা বার করে ইন্দ্র তার নিজের শোবার ব্যবস্থা করেছে তাকে ল্যান্ডলাইনের কথাটা তুলে যেন ইন্দ্রর আত্মমর্যাদাকেই ভয়ংকরভাবে ভেঙে দিল শিবানী।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content