শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ববি। ছবি: সংগৃহীত।

।।নাটকের চেয়ে নাটকীয়।।

কলকাতায় দিনের পর দিন স্টুডিয়োতে গিয়েছে ক্যামেরার থেকে দূরে গ্রুপ ড্যান্সের দঙ্গলে কাজ করতে চায়নি। কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু বম্বেতে এসে সেই জেদ বজায় রাখতে পারেনি। এখন শুধু ফিল্ম সিটি নয় কাজের তাগিদে বান্দ্রার মেহবুব স্টুডিয়ো বা অনেকটা দূরে চেম্বুরের আরকে স্টুডিয়োতে ছুটে গিয়েছে। রাজ কাপুরের বিখ্যাত ছবি ববিতে গ্রুপ ড্যান্সে সুযোগ এল। শিবানীর তখন যে আর্থিক অবস্থা তাতে না বলার কোন উপায় নেই। টাকা ছাড়া টিকে থাকা যায় না, বিশেষ করে বম্বের মতো শহরে।

১৯৫৬ সালে শম্ভু মিত্র-অমিত মৈত্র জুটির কাহিনি-চিত্রনাট্য পরিচালনায় দ্বিভাষিক ব্লকবাস্টার “জাগতে রহো” ছবিটি গ্রাম থেকে শহরে এসে পড়া এক কপর্দকহীন নন-এন্টিটি বা নিঃসহায়ের গল্প বলেছিল। সে ছবির বাংলা ভার্সন “একদিন রাত্রে” ছবিতে মূখ্যভূমিকাভিনেতা রাজকাপুর ও মধ্যরাতের মদ্যপের ভূমিকায় বাংলা ছবির প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে এক অন্যবদ্য গান পিকচারাইজ করা হয়েছিল। মান্না দের গাওয়া সে গান কয়েকযুগ মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় সব সত্যি সব সত্যি। অর্থই সব। হৃদয় মূল্যহীন এটাই সত্যি।

সম্ভবত এই প্রথম বাংলা “জীবনমুখী” গানে গীতিকার সলিল লিখেছিলেন—
এই বুক থেকে আমি / কলজেটা ছিঁড়ে যদি / রাখি এই মানিব্যাগেতে
আর মানিব্যাগ থেকে এই/ টাকাটাকে নিয়ে যদি/ রাখি পাঁজরার ফাঁকেতে
এটা টাকাটা তো চলবেই / ধক ধক ধক ধক চলবেই
যদি কলজেটা যাও ভাঙাতে / কিছু মিলবে না একরত্তি / সব সত্যি

হৃদয়ের সারল্য নয়, হৃদয়কে ধক ধক করে চলতে গেলে টাকা চাই। তাই যে কোনও ভাবে সে টাকা রোজগার করতে হবে। যে কোনও উপায়ে আরও আরও অর্থ রোজগারের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে।

এরপর ১৯৭০-এ বাংলা ছবি “সোনা বৌদি”তে শ্রাবন্তী মজুমদারের গলায় একটা পুরোদস্তুর ক্যাবারে নাচের উপযোগী গান ছিল। অজয় দাসের কথা ও সুরে সেই “বন বন বন বন টাকায় ঘুরছে এই দুনিয়াটা’ সে সময়ের কঠিন বাস্তবকে দেখিয়েছিল। সে সময়ে পৃথিবীর আদিমতম পেশায় কলুষিত ছিল সে উপার্জন।

তারপর ঠগজোচ্চরে ছেয়ে যাওয়া কলিযুগে এই আপ্তবাক্য মেনে চলতে শুরু করল, চিরকালের দুঃসাহসী ডাকাবুকো অর্থচাষিরা। মনে তাঁরা অকুতোভয়। মাথায় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের উত্তীয়ের বাণী শ্যামার প্রেমে নয়, অর্থ-প্রেমে। “ন্যায় অন্যায় জানিনেজানিনেজানিনে/ শুধু তোমারে (পড়ুন অর্থেরে) জানি, তোমারে (পড়ুন সম্পদেরে) জানি, ওগো সুন্দরী…। মনে মাভৈঃ মন্ত্র “চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা”।

রাজকাপুরের ববি ছবিতে ড্যান্স ডাইরেক্টর ছিলেন দক্ষিণের বি সোহনলাল। আশ্চর্য ব্যাপার যে মাস্টারজিকে খুব একটা সুবিধের লোক বলে শিবানীর মনে হয়নি তিনিই সোহনলালের অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলে দেব আনন্দের বিখ্যাত ছবি ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ’তে গ্রুপ ডান্সের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। দম মারো দম গানে দিন কয়েক নাচের রিহার্সাল করবার পর ক্যামেরাম্যান ফালি মিস্ত্রি একদিন রিহার্সাল দেখতে এলেন। বললেন, এই গ্রুপ ডান্সার এই গানে চলবে না। এদের মধ্যে বিদেশিরা থাকবে উচ্চবিত্ত ছেলেমেয়ে থাকবে যারা নেশা করতে করতে গানটা গাইছে। অন্যদের সঙ্গে শিবানীও বাদ পড়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২৯: আমরা কেজি থেকে পিজি পর্যন্ত বন্ধু

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

সোহনলাল সেটা খেয়াল রেখেছিলেন। তাই ববি ছবিতে জেলে গ্রামের গ্রুপ ডান্সে শিবানীদের দল সুযোগ পেল। রিহার্সাল শুটিং মিলিয়ে প্রায় টানা পনেরো দিন। মান্না দে শৈলেন্দ্র সিং-এর সেই বিখ্যাত ড্যুয়েট গান। লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল জুটির চিরনতুন কম্পোজিশন। না চাহুঁ সোনা চাঁদি…। গোলাপি ব্লাউজ পরেছিল শিবানী। সেকেন্ড রোতে নাচছিল। সিনেমা হলে দেখতে গিয়ে নিজেই নিজেকে খুঁজে পায়নি। ঝুট বোলে কাউয়া কাটে নাচটায় ডিম্পলের সঙ্গে ক্যামেরা ট্রলি হচ্ছিল। এক ঝলকের জন্য গোলাপি ব্লাউজ পরা শিবানীকে দেখা গেলেও ক্যামেরা যখন স্টেডি হল তখন শিবানী আউট অফ ফ্রেম। এমনই কপাল এরপর যখন ঋষি কাপুর নাচছে তার সামনে নাচছে শিবানী কিন্তু সে ব্যাক টু ক্যামেরা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। এই গ্রুপডান্সগুলোর কথা তাই কোনওদিন কাউকে বলেনি। আজ এতদিন বাদেও না। গানগুলো শুনলে এখন কষ্ট হয়।

মেরা সায়া কিসমত জুয়েল থিফ এসব ছবির কোরিওগ্রাফার বা সেকালের ডান্স ডিরেক্টর বিবাহিত সোহনলালের কাছে নাচ শিখতো নির্মলা নাগপাল ওরফে সরোজ। ৪৩ বছরের সোহনলাল এর সঙ্গে ১৩ বছরের সরোজের বিয়ে হল। তার প্রথম বিয়ে কিন্তু সে হলো সোহনলালের দ্বিতীয় স্ত্রী। পরে সর্দার রোহন খানকে বিয়ে করে সরোজ খান হয়েছিলেন। তেজাব , মি: ইন্ডিয়া, দেবদাস, লগান খলনায়কের বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার। সে সময়ে অবশ্য শিবানী বোম্বেতে ছিল না। সে তখন কলকাতায় শ্যামবাজারের পেশাদারি থিয়েটার মঞ্চে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১১: দাদা অঙ্ক কী কঠিন!

কলকাতা থেকে বম্বে আসার সময় অনেক কিছু ভেবেছিল। ভেবেছিল ডান্সার হিসেবে নাম করতে পারবে। আর সেই রাস্তায় এগোতে গেলে অনেক কিছু দিতে হবে। কলকাতাতেই প্রথম ছবিতে সুযোগ পাওয়াটা হঠাৎ হলেও টাকা পয়সা বম্বের সুযোগ সবকিছুরই তো একটা বিনিময় মূল্য যোগাতে হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বম্বেতে টিকে থাকাটা খুব কষ্টকর হলেও এতদিনেও কখনও সম্মানহানি হয়নি শিবানীর। কলকাতার টালিগঞ্জ স্টুডিওতে দুপুরবেলার খাবার খেতে যারা বসতো তাদের কাছ থেকে টালিগঞ্জের নানান নায়ক নায়িকার রসালো গল্প শুনত। সেখানেই বম্বে সম্বন্ধে নানান কথা বলা হতো। অথচ সে তো একটা চালে থাকে। স্টুডিয়োতে ছুটে বেড়ায়। কখনও কখনও সারাদিন রিহার্সাল করে রাতে শুটিং হয়। খিদে পায় খিদে চেপে কাজ করতে হয়। শরীর আর দিতে চায় না। তবু নাচতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। কিন্তু কখনও কেউ তার নারীত্বকে অপমান করেনি। অথচ বম্বেতেও সে শোনে সুযোগ পাওয়ার জন্য কে কী করেছে সে সব। বম্বেতে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছে এখানে এক্সপ্লয়েটেশন হয়। কিন্তু সেটা অনেক উঁচুতে ওঠার জন্য। ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকার জন্য মূল্য দিতে হয়। বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জন্য প্রতিদিনের ক্লান্তি প্রতিদিনের খিদে প্রতিদিনের যাতায়াতের ধকল এটুকু দিলেই চলে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

এ ভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল শিবানী। চাহিদার জানলা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভারসোভার বাহাত্তর ঘর এক উঠোনের চালে তার ভাড়ার ছোট্ট কামরাটার অন্ধকারে নিঃশব্দে বেঁচে ছিল। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ করে সেই মাস্টারজি পুরনো এগ্রিমেন্টের কথা তুলে বলল ছবি শুরু হচ্ছে। এতদিন বাদে আবার একবার সুযোগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে উঠলো শিবানী।

ছবি ডিরেক্টর প্রডিউসারের সঙ্গে কোন স্টুডিয়োতে নয় আন্ধেরি ওয়েস্ট-এর একটা ছোট্ট অফিসে কথা বলতে যেতে হল। গিয়ে শিবানী যা শুনলো তাতে তার শরীর গুলিয়ে উঠলো। সেই সময় কিছু সস্তা উত্তেজক ছবি বাজারে চলছিল। এরা সেরকমই একজন ছবি নির্মাতা। শিবানী জানিয়েছিল যে সে ডান্সের জন্য এগ্রিমেন্ট সাইন করেছিল। এ ধরনের কোনও ছবির কথা হয়নি। সে নির্মাতারা তখন দেখালো চুক্তির শর্তে লেখা আছে শিবানী নির্মাতাদের পছন্দ মতো যে কোন ধরনের ছবিতে যে কোন চরিত্রে করতে রাজি আছে। ছবির বিষয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য হলেও শিবানীর তাতে কোন আপত্তি নেই।

শিবানী বলল তার কাছে এতদিন এই চুক্তির কোন কপি ছিল না এবং এতদিনকার পুরনো চুক্তি সে সেটা ভালো করে পড়েও দেখেনি মনেও নেই। নির্মাতারা বলল যে টাকায় কথা হয়েছিল তার থেকে এখন টাকা সে বেশি পাবে। চাইলে মোটা টাকা এডভান্স পাবে, চুক্তির কপি তাকে দিয়ে দেওয়া হবে কিন্তু চুক্তির বাইরে যেতে পারবে না। শিবানী বুঝলো এই সেই আরও উপরে ওঠার রাস্তা। পড়াশোনা না করে মাচায় মাচায় নেচে নাম আর পয়সার নেশায় একবার ভুল করেছিল। সিংহানিয়ার ঘরে সেদিন নিজের প্রাপ্য টাকাটুকু নিয়ে বেরিয়ে না এসে বম্বেতে নাম টাকা গ্ল্যামারের নেশায় দ্বিতীয়বার ভুল করেছিল।এটা তৃতীয়বার। কথায় বলে বারবার তিনবার। ঈশ্বর আর সুযোগ দেবেন না। তাকে পালাতে হবে। সারারাত নিজের সেই ছোট্ট কামরায় বসে দেওয়ালে ঝোলানো মা কালীর ছবির সামনে বসে অঝোরে কাঁদলো শিবানী। মায়ের কাছে প্রার্থনা জানাল যাতে ঈশ্বর তাকে এবারটার মত বাঁচিয়ে দেন। —চলবে।

প্রতীকী ছবি: সৌজন্য সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩১

আসলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজাটা বন্ধ করে খামটা খুলে ফেলল শিবানী। একটা ছোট কাগজ। হোটেলের প্যাড। তাতে রুম নাম্বার ফোন নম্বর আর নাম লেখা। নাম দেখে শিবানী চমকে উঠল। সিংহানিয়া । এই হাতের লেখা তার খুব চেনা। তার মানে সিংহানিয়াজি এখন বম্বেতে।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content