শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

সারাদিন বসে থেকে পার্ট বলার পরেও ৩০ থেকে ৪০ টাকার বেশি রোজগার করা যায়না। বুল্টিদার সঙ্গে দিনের পর দিন নাচের অনুষ্ঠানে গিয়ে ২০০ টাকা পেয়েছে। সেটাও চালু বাজারদরের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। সেখানে তিন দিনে ২০০০ টাকা! হোটেলে থাকা খাওয়া যাতায়াত ফ্রি! একটা ঘরের মধ্যে তিন-চারটে বিলে সই করে দিল শিবানী। ১০০ টাকার কুড়িটা নোট মুড়ে ভালো করে ব্যাগের মধ্যে নিয়ে নিল। প্রোডাকশন ম্যানেজার চলে যাবার পর শিবানী উঠছিল। মাস্টারজি হাত দেখিয়ে বসতে বললেন। এতদিন সিংহানিয়া শিবানীর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। ভাবলেশহীনভাবে মাঝে মাঝে তাকিয়েছে। এই প্রথম স্পষ্ট টান ছাড়া ঝরঝরে বাংলায় কথা বললেন

— শিবানী বম্বেতে ছবি করবে?

শিবানী চমকে তাকায়।

— মানে?

—মানে খুব সোজা। মাস্টারজির কানেকশনে আমি বোম্বেতে একটা ছবি ফাইনান্স করছি।তোমার কাজ দেখে উনি এবং আমি দু’ জনেই খুশি। তবে বোম্বেতে নিয়ে গেলে একটা ছবির জন্য খরচায় পোষাবে না। আমার এই ছবিটা ছাড়াও ওঁর দুটো ছবিতেও তোমাকে সাইন করাবে। তবে ডান্সের জন্যে তোমায় নিলেও ডান্সারের কারেক্টরটা স্টোরিতে খুব ইম্পর্টেন্ট। বম্বেতে অল ইন্ডিয়ার জন্য ছবি হয়। ওখানে রেট অনেক বেশি। এখন যা পেলে তার থেকে অনেক অনেক বেশি টাকা পাবে। বম্বে যাতায়াতের খরচ থাকার খরচ সব প্রোডাকশন করবে।

আবার মাথা ঝিমঝিম করছে শিবানীর। মাস্টারজি এবার উঠে পড়লেন। বললেন এই স্টোরিটা সিংহানিয়াজির লেখা। টেবিলে তিনটে ছবির এগ্রিমেন্টের কপি রাখা আছে। পাশের ব্লু খামে তিনটে ছবির জন্য ৫০০০ টাকা এডভান্স রাখা আছে। ছোট করে সিংহানিয়া থেকে স্টোরি শুনে ভালো লাগলে এগ্রিমেন্ট সাইন করে এডভান্স নিয়ে নিতে পারে। পরে ওখানে কতদিন থাকতে হবে কবে যেতে হবে কবে ফিরবে সব তাকে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ছিল শিবানী। মাস্টারজি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অটোমেটিক দরজাটা আস্তে আস্তে”কট” করে বন্ধ হয়ে যাবার পরই যেন ঘোরটা কেটে গেল। শিবানী বুঝতে পারছে প্রথম দিন স্টেজে ওঠার মত তার হাত-পা ঘামছে।
সিংহানিয়া বলল—

—এগ্রিমেন্টগুলো সই করে টাকা ব্যাগে গুছিয়ে ফেলো। লছমি দেবীকে কখনো ফেলে রাখবে না। তোমাদের বাংলায় কি বলে লছমি মা ‘চানচলা’—ঠিক বললাম?
এরকম একটা দমবন্ধ পরিবেশেও শিবানী হেসে ফেলে—

— চানচলা নয় চঞ্চলা।

— জন্ম কলকাতায় বাংলা বলতে অসুবিধা হয় না – তবে হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট বলতে পারি না।

— ভালোই বলেন।

— রিয়ালি? থ্যাঙ্ক ইউ। নাও নাও জলদি করো।

এগ্রিমেন্ট এর পাশেই পেন রাখা ছিল। সিংহানিয়ার নির্দেশ মত প্রত্যেক পাতায় শিবানী সই করে দিল টাকাটা হ্যান্ডব্যাগে তুলে নিল। সিংহানিয়া এগ্রিমেন্ট গুলো ভাঁজ করে সোফার পাশে রাখা এটাচিতে ভরে ফেলল। শিবানী এদিক-ওদিক দেখছিল।

— কিছু চাই? কোলড্রিংকস আইসক্রিম?

— জল।

— ঐতো ফ্রিজের ওপরে আছে, ঠান্ডা চাইলে ফ্রিজের ভেতরে পাবে।
শিবানী জল খায়। তারপর বাইরে বের হবার দরজার দিকে ফেরে। সিংহানিয়া তার শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তাকায়।

—উঁহু! ওয়াশরুম ঐদিকে। ওখানে তোমার জন্য নতুন রোব রাখা আছে।
আজকের পার্টিতে ইন্দ্র’র না থাকা। প্রোডাকশন ম্যানেজারের পার্টিতে আসা নিয়ে জোর করা, প্রডিউসারের ঘরে পেমেন্ট দেবার কথা বলা, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা দেওয়া, বম্বের ছবির অফার, আরও টাকা পাওয়া ছবির গল্প শোনানোর জন্য দরজা বন্ধ করে মাস্টারজির ঘর ছেড়ে যাওয়া এই সব কিছুর মধ্যে শিবানী সর্বনাশের ইঙ্গিত পাচ্ছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২৬: নাচ শেষ হতে মঞ্চের পিছনের অন্ধকারে সে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল

রিভিউ: ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’—মনোজ বাজপেয়ী একাই একশো

জনমানবহীন সমুদ্রতটে একা দাঁড়িয়ে ধেয়ে আসা বিশাল ঢেউয়ের দিকে তাকালে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনাও হয়। সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়াবার শখ। শিবানীর শরীরের শিরায় শিরায় সেই সর্বনাশা নেশার গরল একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছিল। না হলে সেই মুহূর্তে সে হোটেলের রুমের দরজাটা খুলে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারতো। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে দরজাটা ভালো করে লক করে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতে পারতো। শিবানী তা করেনি। এতদিনকার জমিয়ে রাখা আকাঙ্ক্ষা, নাম টাকা গ্ল্যামারের আকন্ঠ নেশায় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করল চুঁচুড়ার মধ্যবিত্ত বাড়ির বড় মেয়ে শিবানী সেন।

প্রণয়কান্তির স্ত্রী মানে আমার ন’কাকা তরুণকান্তি দত্তের পুত্রবধূ বাবলি কলকাতার মেয়ে নয়। সুজাতার পরিচিতর মধ্যেই দিল্লির এক প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বাবলি আর তার মা থাকত। এটি বাবলির দাদুর বাড়ি। বাবলির বাবা যখন মারা যান তখন বাবলি স্কুল ছাত্রী। বাবা ফরিদাবাদে বিখ্যাত টায়ার কোম্পানীর বল্লভগড় ফ্যাক্ট্রির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কে ওঁদের পৈতৃক বাড়ি। প্রায়ই ওরা গাড়ি নিয়ে ফরিদাবাদ থেকে দিল্লি চলে আসত। উইকেন্ড কাটিয়ে ফিরে যেত। সময়টা শীতকাল। বাড়ি থেকে রাত্রিবেলার খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়েছিল। রাস্তায় কুয়াশা ছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

বাবলি পেছনের সিটে বসে বসে ঢুলছিল। বাবলি মা সেই দেখে গাড়ি থামিয়ে সামনের সিট থেকে পিছনে এসে মেয়েকে ধরে বসলেন ক্লান্ত বাবলি ঘুমিয়ে পড়ল। একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি তারপর কিছু মনে নেই। বাবলি সেদিন না ঘুমোতে থাকলে মা-বাবা একসঙ্গে চলে যেত। বাবলি আর বাবলির মা থেকে গেল পৃথিবীতে। হাইওয়ে ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িটা ড্রাইভারের দিক থেকে দুমড়ে গিয়েছিল। বাবার শরীরটা চেনা যায়নি। সেই থেকে বাবলির মা আর বাবলি, দাদুর কাছে দিল্লিতে। জেএনইউ থেকে পড়েছে। নানা রকমের কালচারের একটিভিটি করতো ওদের বন্ধুরা। বাবলিকে দেখতে খুব সুন্দর। মডেলিং-এর অফার এসেছিল। দাদু চাননি। সুজাতার বাবা কর্ণেল বসু রায় আর বাবলির বাবা বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে সুজাতা, বাবলির মা বা বাবলিকে বহুদিন চিনতো। সুজাতা শ্বশুরবাড়িতে খুব বড় দুর্গাপুজো হয় এটা চিত্তরঞ্জন পার্কের সকল বাঙালি প্রায় জানতেন। সুজাতার বাবার একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব। যেখানেই যেতেন সেখানেই বসুন্ধরা ভিলার গল্প করতেন। দিল্লিতে জমজমাট দূর্গা পুজো হয়। কিন্তু সে তো প্রায় ছোটবেলা থেকেই দেখছে। পুজোর সময়টা তো বাবলিরা, দিল্লিতে দাদুর বাড়িতেই থাকতো। তাই বাবলির কলকাতার দুর্গাপূজা দেখার বড্ড শখ।

স্বামীর মৃত্যুর পর বাবলির মা কোথাও যেতেন না। সুজাতা জোরাজুরি করতেও রাজি হলেন না। সুজাতা তখন বলল—

— তাহলে আমি বাবলিকে নিয়ে যাচ্ছি। পুজোর লক্ষ্মীপূজো কাটিয়ে আমি একবার দিল্লি আসব। আমার সঙ্গে চলে আসবে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

সুজাতা দত্ত বসুন্ধরা ভিলার দুর্গাপূজার সময় বাড়িতে কোন দায়িত্বেই থাকেন না। কিন্তু যতই হোক বাবলি আসছে। লোক দেখানো হলেও সেবারটা বাড়িতেই ছিলেন।

ঈশ্বরের অদ্ভুত যোগাযোগ। অষ্টমীর সকালে স্নান সেরে নতুন শাড়িতে পরিপাটি সেজে ঠাকুরদালানে অঞ্জলি দিতে গেল বাবলি। প্রণয়কান্তিও বাড়ির দুর্গাপূজোয় থাকে না। পুজোর চার দিন সে তার মতোই উদ্ধত একরোখা ছেলেপুলের সঙ্গে হুল্লোড় করে বেড়ায়। শুধু অষ্টমীর দিনে বাড়ির অঞ্জলিটা দিতে হয়। সেই অঞ্জলি দিতে গিয়ে প্রণয়কান্তি দেখলো বাবলিকে। প্রণয়ের সঙ্গে যেসব মেয়েরা মেশে তাদের থেকে বাবলি একেবারে আলাদা। তার দিকে চোখ পড়লে থমকে যেতে হয়। কি যে হয়ে গেল সেদিন! শুধু চোখ নয় হৃদয়ের দপদপও কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন বন্ধ হয়ে গেল।

বড়লোকের বেয়াড়া ছেলেপুলের বড় হলেও বায়না কমে না। গ্রাম থেকে উঠে আসা বাঙালির বড় প্রিয় বড় কাছের চরিত্রের ক্ষেত্রেও নাকি এমনই হয়েছিল। প্রণয়কান্তি বায়না ধরল এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে। প্রণয় সম্পর্কে বাবলি কিছুই প্রায় জানতো না। দেখতে শুনতে ভালো। বসুন্ধরা ভিলার ছেলে। আর প্রণয় যার ছেলে সেই সুজাতা তাদের বহুদিনের পারিবারিক পরিচিতির সূত্রেই একজন।

স্বর্ণময়ী শুনে খুব খুশি। প্রণয়ের বদমেজাজ ঔদ্ধত্যের জন্যে একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও বাবলিকে বসুন্ধরা ভিলার সকলে ভালবেসে ফেলল। তবে এর মধ্যে প্রণয়ের একটা চাপা হিংসেও কাজ করছিল। ওই যে সৌরভের বিয়ে হল বম্বেতে। ঠিক তেমনভাবেই প্রণয়ের বিয়ে হল দিল্লিতে। কর্নেল বসুরায়ের বাড়িতে নয় দিল্লির পাঁচতারা হোটেলে পার্টি হল। আর সেখানেও বসুন্ধরা ভিলার অফিসিয়াল রিপ্রেজেন্টেটিভ অমলকান্তি ও সুরঙ্গমা দত্ত।—চলবে।

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২৮

ভারসোভা…কিন্তু সেখানে মধ্যবিত্ত কারও পক্ষে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। ইয়ারি রোড শুনলেও বেশ ভালো লাগে। সিনেমার পত্র-পত্রিকায় ভিড় করা অনেক নামজাদা চিত্রতারকার ঝকমকে বাড়িঘর এসব অঞ্চলে। শিবানীর থাকার জায়গা ছিল- সমুদ্রের ধারের ঝকঝকে ভারসোভা রোড থেকে ইয়ারি রোড-আরামনগর লেন হয়ে – গলি তস্য গলিতে একটা টানা-বারান্দার সার সার এক কামরার ঘরের একটা। বম্বেতে যাকে ছাওল বলে।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content