সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

।। স্বর্গেরসিঁড়ি।।

হোটেলে গিয়ে দেখা গেল একটা মাঝারি মাপের হল ঘরে ছবি ডিরেক্টর ও ডান্স ডিরেক্টর বসে আছেন। ইন্দ্র তাদের সঙ্গে শিবানীর পরিচয় করে দিল। স্টুডিয়োতে ঘুরে ঘুরে শিবানী দেখেছে নায়ক-নায়িকারা বয়সে বড় কোনও গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সঙ্গে আলাপ করালে দুহাত জড়ো করে প্রথাগত নমস্কার বা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে না। ডান হাতটা বুকের কাছে এনে মাথা শরীরটাকে অল্প ছুঁইয়ে একটা মাঝামাঝি ভঙ্গি করে। শিবানী এখানে সেই কায়দাটাই করলো।

সেই হলেতেই একটু দূরে একটা টেবিলের সেলাইয়ের মেশিন রেখে একজন টেলার বসে আছে। পরিচালক ইশারা করতেই ট্রেলার লোকটি এসে চটপট মাপ নিয়ে নিল। ইন্দ্র সঙ্গী করে কস্টিউম নিয়ে এসেছিল লোকটাকে দিতেই সে কস্টিউমগুলো কাটছাঁট করে সেলাই শুরু করল। অন্য একজন বড় স্পুল টেপরেকর্ডার নিয়ে বসেছিল। ডান্স ডিরেক্টরের ইশারায় সে সকালে শোনা সেই চটুল গানটা বাজাতে শুরু করল। ট্রান্সলেটর কাল দিতে দিতে “ওয়ান টু থ্রি ফোর” বলতে ইন্দ্র গানের সঙ্গে লিপ করে সকালে দেখা বোম্বের সেই মেয়েটির ভঙ্গিমায় নাচতে শুরু করল।

বিকেল থেকে নাচের রিহার্সাল কস্টিউমের সঙ্গে নাচ গানের লাইন মুখস্ত করা এসব শেষ হতে হতে প্রায় মধ্যরাত।

স্টুডিয়ো থেকে পড়ি কি মরি করে ট্যাক্সিতে সদর স্ট্রিট আসতে হয়েছিল। শিবানী বাড়িতে পিসিমাকে খবর দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তবে বাড়ির পাশে একটা এসটিডি বুথ থেকে মাঝেমধ্যে চুঁচুড়াতে পাশের বাড়িতে ফোন করে মাকে ডেকে পাঠাতো। কখনও কখনও মা ফোনে সেই এসটিডি বুথে খবরও পাঠাতো। বুথের নাম্বার শিবানী এর কাছে ছিল। ফোন করে পিসিমাকে খবর দিতে বলল। একটা বিশেষ কাজে এক জায়গায় আটকে পড়েছে। দেরিতে ফিরবে। পিসিমা যেন খেয়ে নেয়।

অনেকটা রাতে যাবার আগে ছবির প্রযোজক এসে শিবানীকে যেন জরিপ করে গেল। ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল ইন্দ্র নিজে। বলল রাত্রিটা খুব ভালো করে ঘুমোতে। একটু বেলা করে প্রোডাকশনের গাড়ি নিয়ে ইন্দ্র নিজে শিবানীকে নিয়ে যাবে হোটেলে। সেখানেই মেকাপ করে সাজিয়ে গুজিয়ে সরাসরি স্টুডিয়োর শুটিং স্পটে যাবে গাড়ি।

ভেবেছিল রাতে ঘুমোতে পারবে না। হোটেল থেকে খেয়ে এসেছিল। বাড়িতে পৌঁছে আর যেন দাঁড়াতে পারল না এত ভয়ংকর ক্লান্তি যে আর কিছু মনে নেই। সকালে উঠে পিসিমাকে জানালো। সে ছবিতে একটা সুযোগ পেয়েছে। পরের কথাগুলো তাকে গতকালই ডিরেক্টর জানিয়ে দিয়েছিলেন। শুটিংয়ের জন্য দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হবে তিনটে দিন সে বাড়িতে ফিরতে পারবে না।

পিসিমার মুখ দেখে শিবানী বলে দিল।

—অকারণে চিন্তা কোরো না পিসিমা । মাকে আমি ফোন করে সব জানিয়ে দেব।

সাজগোজের পর আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠলো শিবানী। তাকে তো সেই বোম্বের নর্তকীর তুলনায় এতোটুকু খেলো মনে হচ্ছে না। সমস্ত শিল্পীকে স্টুডিওতেই মেকআপ করা হয়। কিন্তু যেহেতু সে সেই স্টুডিওতে এতদিন ধরে একটু অভিনয়ের সুযোগ পেতে অফিসে অফিসে ঘুরেছে তাই তাকে শুটিংয়ের এই কটা দিন স্টুডিয়োতে মেকাপ না করিয়ে হোটেল থেকেই রেডি করে দামি গাড়িতে স্টুডিয়োতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছবির প্রযোজক। শিবানীকে বলে দেওয়া হয়েছে এই স্টুডিয়োতে অনেকে তার চেনাপরিচিত আছে। কিন্তু এই শুটিংয়ের কদিন সে যেন পারতপক্ষে কারও সঙ্গে কোন রকম কথাবার্তা না বলে। শট দিয়ে অপেক্ষা না করে মেকআপ রুমে চলে যায়। কাজ শেষে গাড়ি তাকে সোজা হোটেলে নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

২য় খণ্ড, পর্ব-২৪: অর্কের একটা কথায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন সানন্দা

রিভিউ: দ্য নাইট ম্যানেজার: দেশীয় সংস্করণে চোখে চোখ রেখে লড়েছেন আদিত্য, অনিল, শাশ্বত ও শোভিতা

বম্বের সে নর্তকীর যেদিন অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হচ্ছে সেদিন তারই কাটছাঁট করা কস্টিউম পরে চটুল গানে শরীর দোলালো শিবানী। আগের দিনের অতিরিক্ত পুলিশি ব্যবস্থা ভিড় সামলাচ্ছে। কারণ সেদিন শুটিং রয়েছে এক জনপ্রিয় নায়কের। মাথায় নকল চুল নকল চোখের পাতা চড়া মেকআপ চেহারা থেকে যেন জেল্লা বেরোচ্ছে। শিবানীর খোলামেলা পোশাকের ওপরে হালকা ঢিলেঢালা লম্বা ফ্রন্ট-ওপেন মাথাঢাকা ক্লোক বা হুডি-জাতীয় অতিরিক্ত একটা পোশাক চাপানো। সেটা গায়ে চাপিয়েই শিবানী স্টুডিয়ো থেকে ফ্লোরে পৌঁছচ্ছে। সঙ্গে থাকছে কস্টিউমের মেয়েটি। রিহার্সাল করছে। মেকাপ ঠিকঠাক করা হচ্ছে। গান বেজে উঠছে। সে পরপর শট দিচ্ছে। ডিরেক্টর বসে রয়েছেন। প্রোডিউসার বসে রয়েছেন। শিবানী বুঝতে পারছে যে তারা অখুশি নয়। শিবানীকে সকলে ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ বলে ডাকছে।

ডান্স ডিরেক্টর শিবানীকে ‘বেটি বেটি’ বলে নাচের স্টেপস বুঝিয়ে দিচ্ছে শটের পরে উৎসাহিত করছে। নাচের ঘনিষ্ঠ মুভমেন্ট বা কম্পোজিশন থাকলেও নামী হিরো বিশেষ কথাবার্তা বলছে না। স্টুডিও থেকে যাওয়াআসার পথে তাকে ঘিরে থাকছে ছবির অ্যাসিস্ট্যান্টরা বা ইন্দ্র নিজে। ফ্লোরের আশপাশে চাকবাঁধা জনতার ভিড় থেকে উড়ো মন্তব্য কানে আসছে।

—এও কী বম্বের?

— মনে তো হয়।

— নাম কী?

—জানি না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

চেনামুখ নজরে এসেছে। কিন্তু তারা আজ অনেকটা দূরে। নায়কের নিরাপত্তার কারণেই আজ পুলিশের অনেক কড়াকড়ি। নায়ককে কিছুই বুঝতে দেওয়া হয়নি। তাকে বলা হয়েছে ডানসার রিপ্লেস করা হয়েছে। আগের দিনের বিকেল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত রিহার্সালটা খুব কাজে লেগেছে। জীবনের প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি হলেও শিবানীর অসুবিধা হচ্ছে না। বাড়িতে ভিডিও চালিয়ে বহু বহুদিন লিপ দেওয়া অভ্যেস করেছে। গানটাও কাল থেকে বহু বহুবার শোনা হয়ে গিয়েছে। তালটা মাথায় বসে গিয়েছে। জীবনে প্রথমবার ক্যামেরার সামনাসামনি হয়ে যতটা ভয় পাবে ভেবেছিল সে রকম একবারও হচ্ছে না। ঘোরের মধ্যে সারাদিনের কাজটা উতরে গেল। ড্যান্স ডিরেক্টর ইন্দ্রকে বলে দিল তাকে গাড়িতে হোটেলে নিয়ে যেতে। কালকের সং পোর্শানগুলো রেডি করিয়ে রাখতে। ঘণ্টা দু’য়েক বাদে ডান্স ডিরেক্টর হোটেলে আসছেন।

গাড়িতে বসে প্রথম কথা বললে ইন্দ্র।

— আজ তো ফাটিয়ে দিয়েছো ! প্রোডিউসার তো মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল।

— আচ্ছা আমায় পয়সা দেবে?

—নিশ্চয়ই দেবে। তোমার জন্য আলাদা গাড়ি দিয়েছে হোটেলে আলাদা ঘর দিয়েছে। টাকাও দেবে।

— কত দেবে?

—সেটা আমি কি করে বলবো? প্রোডাকশন ম্যানেজার তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবে?

— বম্বের মেয়েটাকে কত দিচ্ছিল?

— জানি না। ছবির জগতে কে কত টাকা পায় বা ঠিক কী সুযোগসুবিধে পায় সেটা জানা শক্ত। মন দিয়ে কাল পরশু কাজ করো। পয়সা পেয়ে যাবে। ওসব নিয়ে কেন ভাবছ। একটা গ্রুপ ডান্সে বা ক্রাউডে নাচলে, কী পেতে?
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪: আমারে তুমি অশেষ করেছ

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

ইন্দ্র খুব একটা কথা বলে না। হোটেলে শিবানীকে রুমে পৌঁছে দিয়ে বলল —

—ভালো করে মেকআপ তুলে স্নান সেরে – যেমন যা ইচ্ছে হবে ফোনে অর্ডার করে খেয়ে নাও। ঘন্টাখানেক সময় পাবে -একটু রেস্ট করে নিতে পারো । আমি লবিতে ওয়েট করছি।

— কেন আমার ঘরে বসুন।

— না।

— আপনি কিছু খাবেন না

— না। পরে খেয়ে নেব।

— আচ্ছা এই কস্টিউমটাই তো কালকে লাগবে কিন্তু এটা তো সারাদিন পরে আছি?

— তিনটে সেট রাখা আছে। ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। ওসব কন্টিনিউটি কস্টিউম ডিপার্টমেন্টের লোকজন বুঝবে।

সেদিনও একই রুটিন। ডান্স ডিরেক্টরের সঙ্গে ডিরেক্টর আসেননি। তবে ক্যামেরাম্যান এসেছে। কালকের সেই লম্বাটে হলঘরেই সন্ধ্যেরাতে রিহার্সাল শুরু হল। সেই টেবিল থেকে লাফিয়ে পড়ে গানের শুরুর অংশটা শেখানো হল। গানের অন্য অংশগুলোয় দেখিয়ে দেওয়া হলো। মিটলো মাঝ রাতে।—চলবে।

চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২৬

বহুদিন আগে প্রথমবার মাচায় ড্যান্স শো করারআগে শিবানীর এমনই ভয়ে হাত পা দিয়ে ঘাম বের হচ্ছিল। স্টেজে কোন গতিকে তালে তাল মিলিয়ে নেচে গিয়েছে মাঝে মাঝে ভয় চোখ বুঝিয়ে ফেলেছে। এক্সপ্রেশন সেভাবে দিতেই পারেনি। নাচ শেষ হতে হাঁপাতে হাঁপাতে খোলা মাঠে বাঁধা মঞ্চের পেছনের অন্ধকারে প্রায় লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content