রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

দূরের অনুষ্ঠানে গিয়ে থাকতে হয়। অতরাতে বাড়ি ফেরা যায় না। উদ্যোক্তারা কারও বাড়িতে ক্লাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। প্রথম প্রথম মা শুভ্রা যেতেন মেয়ের সঙ্গে। ক্রমশ সংসার সামলে প্রতিসপ্তাহে বাড়ির বাইরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। শিবানীর ছোট বোন বনানীকে পাঠাতে লাগলেন। কিন্তু পিঠোপিঠি বোন হলেও ক্লাস টেনের বনু বা বনানীর সঙ্গে দিদির কোন মিল নেই। বনানী জানে সে দিদির মতো রূপসী নয়। আর সে রূপসী হতেও চায় না। সে বিদূষী হতে চায়। পড়াশোনা নিয়েই থাকতে চায়।

রূপের প্রকাশ নয় তার লক্ষ্য ভালো করে পড়াশোনা করে নিজেকে সমাজের সামনে প্রতিষ্ঠা করার। খুব স্বাভাবিকভাবেই বনানী পরীক্ষার আগে সময় নষ্ট করতে রাজি হল না। বেঁকে বসল। তাছাড়া তার বুল্টিদা লোকটাকে একেবারেই পছন্দ না। শিবানীকে নিয়ে তার আদিখ্যেতা, তার চোখের নোংরা দৃষ্টি। তাকে আড়াল করে দিদির সঙ্গে বুল্টিদার চোখে চোখে ইশারায় বলা কথা, কোনওটাই তার পছন্দ নয়। একটি দুটি অনুষ্ঠানে শিবানী একাই গেল। এদিকে বাড়িতে স্রোতের মতো টাকা ঢুকছে। বাড়িতে স্পষ্টত দুটো ভাগ। বাবা মণিকান্ত সেন আর ছোট মেয়ে বনানী একদিকে। অন্যদিকে খ্যাতির চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখতে থাকা বড়মেয়ে শিবানী আর মা শুভ্রা।

এর মধ্যে আচমকা ঘটে গেল এক কেলেঙ্কারি। বুল্টিদার বউ কেয়া জাঁহাবাজ মহিলা। বুল্টিবাবুর স্বভাবচরিত্র নিয়ে তার সন্দেহ ছিল। সেইজন্যে বুল্টির ড্রাইভার রতনকে নাকি কেয়া টাকাপয়সা দিয়ে হাত করে রেখেছিল। রতন বুল্টির সাম্রাজ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ সচিত্র প্রতিবেদন বৌদিমণির কাছে প্রকাশ করত। রতনের কাছে খবর পেয়ে কেয়া একদিন সাতসকালে সরাসরি এসে শিবানীদের বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। পাড়া-প্রতিবেশী বেরিয়ে এসে কেচ্ছাকেলেঙ্কারির চূড়ান্ত। চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত মণিকান্ত বা তার পড়াশোনা করতে থাকা মেধাবী ছোটমেয়ে বনানীর মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে গেল। শিবানী বোধহীন নির্বিকার। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার নেশায় মোহগ্রস্ত। সেও বেরিয়ে এসেছিল ঝগড়া করতে। শুভ্রা বুদ্ধিমান মা। কোনক্রমে বুদ্ধিহীন মেয়েকে সামলে ঘরে ঢোকালো। কেয়াকে হাতেপায়ে ধরে বুঝিয়ে সাজিয়ে তাকে বাড়ি ফেরত পাঠালো।
সেদিন রাতে বুল্টি বাড়িতে এল। অভিমানী শিবানী এসে কেঁদে কেটে একসা হল, জানাল কেয়াবৌদি তাদের বাড়ি বয়ে এসে একপাড়া লোকের সামনে অপমান করে গিয়েছে। বুল্টিদা যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সকলকে অবাক করে শুভ্রা- শিবানীর সব কাণ্ড চুপ করে মেনে নেওয়া নির্বিরোধী মণিকান্ত সেন এসে সরাসরি বুল্টিকে বললেন, সে যেন আর কখনও এ বাড়িতে না আসে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব যেন তারা বাড়িতে মিটিয়ে নেয়। মণিকান্ত যতদিন বেঁচে আছে ততদিন সে বাইরের কাউকে বাড়িতে এসে তার মেয়েকে বা তার পরিবারকে অপমান করার সুযোগ দেবে না। শান্ত চুপচাপ সবকিছু মেনে নেওয়া মানুষ যখন আচমকা ক্ষেপে যায়, তখন তাকে সামলানো মুশকিল হয়।

বুল্টি মুখ বুজে সব সহ্য করে সেদিন চলে গেল। কিন্তু বুল্টির মাথায় অন্য মতলব ঘোঁট পাকাচ্ছে। মাঝবয়েসি বুল্টি শিবানীর নেশায় পড়ে গিয়েছে। ক’দিন নাচের অনুষ্ঠানে ভাঁটা পড়ল। মণিকান্ত ও বনানীর অনুপস্থিতি বুঝে শুভ্রা ও শিবানীকে বুল্টি জানিয়ে এল, সে এবার শিবানীকে কলকাতায় নিয়ে যাবে। টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বুল্টির জানাশোনা লোক রয়েছে। তবে সিনেমায় নামা সহজ নয়। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অভিনয় শিখতে হবে। অডিশন দিতে হবে মানে ডিরেক্টর প্রডিউসারের সামনে নেচে গেয়ে পার্ট বলে দেখাতে হবে।

বাবা আর ছোট মেয়ের অজান্তে শুভ্রা আর শিবানী গেল স্টুডিওতে ছবি তোলাতে। সেখানে মেয়ের নানা ঢঙে নানান সাজে ছবি তোলানো হল। নাচের অনুষ্ঠান যখন পুরোদমে চলছে তখন হিন্দি সিনেমার নাচ কপি করার জন্যে অনুষ্ঠানের টাকা জমিয়ে শিবানী একটা ভিসিডি কিনেছিল। তাদের রঙিন টিভি ছিল না। সাদাকালো টিভিতে ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে হিন্দিছবির নায়িকাদের রং ঢং নাচের ঠমক চমক রপ্ত করত শিবানী।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৯: কমলকান্তি সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছিলেন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

স্টুডিওতে তোলা ছবি দেখে মা-মেয়ে খুব উত্তেজিত। শিবানীকে দেখতে ভালো। তারপর সকালসন্ধ্যে ভিডিও ক্যাসেট দেখে দেখে নায়িকাদের ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানো সব ভালই রপ্ত করেছে। বুল্টিকে খুব বেশি চেষ্টা করতে হল না। টালিগঞ্জের নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা যে শুধু সময়ের অপেক্ষা এটা তখন মা-মেয়ের স্থির বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে।

বিনোদন জগতে সৃষ্টিশীল ভালোলোকেদের সঙ্গে সঙ্গেই ঠগ জোচ্চোর জালিয়াত লোকেদের ভিড়ে বোঝাই। রুপালি জগতের হাতছানিতে হাজারে হাজারে ছেলেমেয়ে প্রতিদিন নিজেদের নায়কনায়িকা করার স্বপ্ন দেখছে। তাদের মধ্যে ভাগ্য এবং প্রতিভার জোরে মাত্র এক বা দুজনের স্বপ্নসফল হচ্ছে। বাকিদের অনেকেই অর্থ মান-সম্ভ্রম খুইয়ে ব্যর্থতার জ্বালা বুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কেউ কেউ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারও চেষ্টা জনতার ভিড়ে উঁকিঝুঁকিমারা মুখ হিসেবে চিরকালের মতো থমকে যাচ্ছে। তবুও চিত্রজগতের মোহের আলোয় শত শত পতঙ্গ এসে ঝাঁপ দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭: ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না

বাড়িতে একরকম লড়াই করে কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির নেতাজিনগরের একটা চিলতে ঘরে এসে উঠল শুভ্রা আর শিবানী। মনে বিশ্বাস জীবনে সাফল্য পেতে হলে স্ট্রাগল করতে হয়। আজকের উজ্জ্বল তারকাদের সকলকে কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু বুল্টির হিসেব ছিল শিবানীর মা ওভাবে বেশিদিন থাকতে পারবেন না। কিছুদিন বাদে চুঁচুড়া ফিরে যাবেন। শিবানীর সংগ্রামে বুল্টিবাবু একাই থেকে যাবেন। দেশের বাড়িতে কেয়াকে নিয়ে বিবাহিত সংসার রইল। শহরে শিবানী। বৌ জানে ওকে কাজের ধান্দায় কলকাতায় আসতে হয়। রাতে খেটেখুটে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে। বুল্টি আসলে টালিগঞ্জে একটু ভাব জমাচ্ছিল। সত্যিকারের নায়ক- নায়িকাদের অনেক চড়াদর। তাদের নিয়ে পোষাবে না, সিনেমার অল্প চেনামুখেদের গাঁ-গঞ্জের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলে একটু পয়সাকড়ি হয়। অভিনয়ের মতো গানের সুযোগ পেতে চাওয়া নতুন শিল্পীরা একটু অনুগ্রহ একটু সুযোগ পেতে ঘোরাঘুরি করে। তাদের ধরে মাচায় সস্তায় গান করানো যেতে পারে। নামের আগে অমুক কণ্ঠ বা কণ্ঠী লিখে নামের শেষে ব্র্যাকেটে কলকাতা লিখে দিলে ক’টা বাড়তি পয়সা। এর মাঝে শিবানীর কপালে শিকে ছিঁড়লে তাকে ধরে রোজগার। তার কপাল পুড়লে নানান কাপ্তেন প্রযোজকের কাছে তার দালালি করবে।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

বুল্টিবাবু শিবানীকে যতটা সাদাসিধে ভেবে নিয়েছিলো সে মোটেই তেমন ছিল না। মাচার নাচের অনুষ্ঠানে বুল্টির সাহায্য ছাড়া একা একা পৌঁছনো যেত না। তখন বুল্টি নাচের অনুষ্ঠানে যা টাকা পেত, মিউজিক আলো টিফিনের প্যাকেট পেট্রল খরচ বাদে প্রায় সবটাই শিবানীর মা শুভ্রার হাতে তুলে দিত। কাঁচা টাকা হাতে পেলে শিবানী এবং তার গোটাপরিবার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকবে। অনেকের মতোই এটা ছিল বুল্টির খালি মাথার সাদামাটা হিসেব। সিনেমার নায়িকা হবার নেশায় স্কুলের পড়াশোনায় মন না থাকলেও শিবানীর মাথা খুব ধারালো। অংক করতো ঝটপট। আরও ছোটবেলায় BODMAS-এর সূত্রটা খুব ভালো করে বুঝতো শিবানী।

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি

ডিভিশন বা মাল্টিপ্লিকেশনের আগেই যে ব্র্যাকেটের কাজ সেরে নিতে হয় সেটা কন্যে বিলক্ষণ জানত। তাই সে বুল্টিকে বলে—

— তুমি কি বলদ বুল্টিদা ?

বুল্টির মতো হ্যাংলা পুরুষমানুষ প্রিয় মহিলাদের অনুযোগের সুরে বলা খারাপ কথাও উপভোগ করে। হ্যা-হ্যা করে জিভ বের করে হাসতে হাসতে বুল্টির প্রশ্ন।

— একথা বলচিস কেন?

— ফাংশন তুমি আনছো? ঠিক কিনা?

— আগে বল।

— আমি পারফম করছি।

— তো ?

— হিসেব মতো তোমার একটা পারসেন্ট থাকবে। মানে থাকা উচিত।

— ওসব ছাড়। মন দিয়ে ফাংশন কর। আর আমি পকেট দিয়ে কিছ্যু দি না। খরচাপাতি নিই তো।

— খরচাপাতি নয় বুল্টিবাবু, আমি ইনকামের কথা বলছি।

১৭ বছরের শিবানী মাঝেমধ্যে ৪২ বছরের বুল্টিকে গলায় এক চামচ আবেগ মিশিয়ে ‘বুল্টিবাবু’ বলে ডাকে। হিন্দি বাংলা সিনেমার ভিডিও ক্যাসেট দেখতে দেখতে নায়িকাদের দুষ্টু আবেগ রপ্ত করছে শিবানী।—চলবে
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২১

বুল্টিরা ভাবে কমবয়েসী শিবানীরা আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতেই পারছে না। তাকে পপুলারিটির নেশা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুল্টিরা ভাবতেই পারে না, মেয়েদের হাতে পায়ে গায়ের জোরের খামতির জন্যেই পুরুষদের থেকে তাদের উপলব্ধি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর। তাই বুল্টিকে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেয় শিবানী কিন্তু বেচাল হতে দেয় না, ছোবল দেওয়া তো দূরের কথা।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content