শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী

।।জীবনের নাটক।।

আমার বোন সানন্দা আর ভগ্নিপতি অর্কপ্রভ দু’ জনেই শহরের নামকরা গাইনি-সার্জেন। অথচ অর্ক চাইলেও নন্দা একসঙ্গে চেম্বার করত না। সরকারি হাসপাতালে থাকলেও অর্ক প্রাইভেট প্র্যাকটিস নার্সিংহোমে বেশি সময় দিত। সানন্দা উলটো। প্রাইভেট প্র্যাকটিস নার্সিং হোম করতই না। প্রতি মাসে নিয়ম করে দু-দিন কলকাতা থেকে দূরের গ্রামে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়ে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা করত। ওর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের একটা টিম যেত। ওর এক সাউথ পয়েন্টের স্কুলফ্রেন্ড ছিল।

একেবারে নার্শারি থেকেই বন্ধুত্ব। দিগন্ত চ্যাটার্জি। সাংবাদিক। অদ্ভুত ছেলে। ওরা তিন ভাই। ট্রাঙ্গুলার পার্কের কাছে ওদের অবস্থাপন্ন বাড়ি। বাবা নামী অ্যাডভোকেট। দিগন্ত মেজো ভাই। বড় আর ছোট ভাইয়ের বিয়ে হল। দিগন্ত বিয়ে করল না। নানা ধরনের এনজিওর সঙ্গে যুক্ত। পথ শিশুদের নিয়ে স্কুল করায় নাটক করায়। পাত্র হিসেবে আদর্শ। কিন্তু কেন যে বিয়ে করল না! শ্রীতমার সঙ্গে দিগন্ত’র সম্পর্ক খুব ভালো। আসলে দিগন্তর পিসি কি একটা বৈবাহিক সূত্রে যেন শ্রীতমাদের বাড়ির বউ। দিগন্তের সেই পিসির সূত্রেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল।

রাসবিহারী থেকে শ্রীতমা বহুবার বিয়ের আগে দিগন্তদের ট্রাঙ্গুলার পার্কের বাড়িতে গেছে। শ্রীতমার কাছে শুনেছি অর্কর সঙ্গে নন্দার প্রেমের ব্যাপারটা দিগন্ত প্রথম থেকেই জানত। কিন্তু দিগন্ত যে নন্দাকে বন্ধুত্বের বাইরেও জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করত সেই সত্যিটা সে কখনও প্রকাশ করেনি। দিগন্তর বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা কি সেজন্যে? যেহেতু বিয়ের আগেই শ্রীতমা দিগন্তকে চিনত সে হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল। আসলে স্কুলের সময়ের নন্দা এতটাই গম্ভীর চশমাপরা সব সময় সিরিয়াস তাকে দিগন্তর মত শান্ত স্বভাবের ছেলে কখনও প্রেম নিবেদন করতে পারবে না।

অর্ক বিয়ের পর চুপচাপ হয়ে গেলেও ডাক্তারি পড়ার সময় খুব ডাকাবুকো মারকুটে ছিল। নিজের স্বভাবের তুলনায় এই পুরোপুরি অন্য রকমের চরিত্রের ছেলেটাকে হয়তো নন্দার এই কারণেই ভালো লেগে গিয়েছিল।নন্দা যখন ডাক্তারি পড়ছে। দিগন্ত তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তখন ওদের যোগাযোগ ছিল তবে সেটা আগের তুলনায় ফিকে। নন্দার জীবনে যে কিছু একটা ঘটছে সেটা দিগন্ত আন্দাজ করেছিল কিন্তু তাকে বাধা দেয়নি। দিলে হয়তো ওদের জীবনটা অন্যরকম হতো। অর্ক হয়তো তার মানসিকতারই কাউকে খুঁজে পেতো। সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে ঈশ্বর যে কেন মাঝে মাঝে এত অন্যমনস্কতার পরিচয় দেন কে জানে?
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৮: সানন্দা বলেছিল, ‘বসুন্ধরা ভিলায় ফিরে এলে আমি হেরে যাবো দাদু’

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৪: পুতুলের মাথায় কোঁচকানো সোনালি চুল, চোখ দুটো কেমন যেন অদ্ভুত, কিন্তু এটা আমায় কে পাঠালো?

আজকে বসে ছোটকার কথা লিখতে গিয়ে সুবর্ণকে শ্যামবাজার পেশাদারী নাট্যমঞ্চ সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিতে হয়েছে। লাইব্রেরি ঘরে অনেক পুরনো বইপত্র আছে। তার মধ্যে ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘থিয়েটারের গুপ্তকথা’। সে বইটির দাম ছিল দেড়টাকা। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ মানে ১৯২৭-এ লেখা। ১৯৫২ সালে রমেন গুপ্তের লেখা ‘গ্রিনরুম থেকে কোর্টরুম’ বা ১৯৬০ এ প্রকাশিত দেবনারায়ণ গুপ্তের “উইংসের আড়ালে’। একেবারে হালে ২০১৪ সালে আরতি দাস ওরফে মিস শেফালি’র জীবনী “সন্ধ্যা রাতের শেফালি” উলটে পালটে দেখেছে। সেই জগতের খোঁজখবর রাখা চেনাপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলেছে।

একটা ব্যাপার নজরে এসেছে থিয়েটার পাড়ায় ধার-দেনা আর ঋণ বা পাওনা টাকা অনাদায়ে আদালতের নালিশ-সমন এসব লেগেই থাকত। একসময়ে মিনার্ভা ও স্টার থিয়েটারের মালিক দোর্দণ্ডপ্রতাপ উপেন্দ্রনাথ মিত্র থেকে বাঙলা রঙ্গমঞ্চের নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকেও বিশাল দেনার দায়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে হয়েছে। ১৯৩৩ সালের বিশে জুন শিশির কুমারের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি হয়েছিল বলে শোনা যায়।

উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে লালা গোপীনাথের লড়াইয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের আলো প্রায় নিভে গিয়েছিল। তখন রিক্ত হৃতসর্বস্ব বৃদ্ধ উপেন্দ্রনাথের পাশে দাঁড়ান তাঁর সুযোগ্যপুত্র সলিল কুমার মিত্র। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, বিশ্বরূপা শাসন করতে এসেছেন রাসবিহারী সরকার। শংকরের সাড়াজাগানো উপন্যাস চৌরঙ্গী নিয়ে এলেন মঞ্চে। গ্র্যান্ডহোটেল থেকে মিস শেফালি তখন হোটেল হিন্দুস্তানে ক্যাবারে নাচছেন। ১৯৭১ সালে গ্র্যান্ডে মাসমাইনে ছিল দশ হাজার টাকা। হিন্দুস্তানে তা বেড়ে হল মাসে পনেরো হাজার।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২১: ক্যানসার মানেই মৃত্যু?

দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

আজকের হিসেবে কমবেশি মাসে ৬ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। চৌরঙ্গী নাটকে কলকাতা প্রথম দেখলো মিস শেফালির ক্যাবারে ডান্স। রাসবিহারী সরকার মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা মানে প্রায় ৩লাখ ৩০ হাজার মাইনে স্থির করলেন। সপ্তাহে তিনদিন। পাঁচটা শো। মাসে ২০ বা ২২টা শো। আজ নয় সেদিনের কল্লোলিনী কলকাতাতেও একই ধরণের অবাক-করা আর্থিক বৈষম্য ছিল। একদিকে শিক্ষিত বেকারের চাকরি নেই ভয়ংকর অনটনে জমে থাকা রাগ। কলকাতা ৭১। আবার অন্যত্র রঙিন মায়াবী আলোয় উড়তে থাকা অজস্র টাকা যৌবনের জৌলুস!

এই জৌলুসের নিষিদ্ধ হাতছানিতে পথ হারালেন বসুন্ধরা ভিলার কমলকান্তি বা কেকে। যাকে ঘিরে এই ভুলপথে পা বাড়ানো তার অতীত বৃত্তান্ত জানা গেল অনেক পরে। তখন ক্ষতি যা হবার ছিল হয়ে গেছে।

“পথ হারানো” শব্দটা হয়তো একটু অন্যরকম। বলা ভালো কমলকান্তি জীবনের পথে একজন সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছিলেন। যার চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসা করা যায়। এত জায়গায় এত মহিলা থাকতে কেন হঠাৎ করে একজন থিয়েটার অভিনেত্রীর প্রেমে পড়লেন কমলকান্তি? মন দেওয়াতে নেওয়াতে কার্যকারণ খুব একটা নির্ভর করে না। কখন কেন কে কার প্রেমে পড়ে সেটাও হয়ত আর সব জাগতিক নিয়মের মতোই ঈশ্বর নির্ধারিত। এই অভিনেত্রীর নাম শিবানী সেন। বসুন্ধরা ভিলায় একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী তার রাজ্যপাট সব ছেড়ে অমলকান্তির ঘরণী হয়েছিলেন।তাহলে শিবানী কমলকান্তির ঘরণী হতে পারল না কেন? সে এক বিরাট অধ্যায়। বসুন্ধরা ভিলার অন্য সকলের গল্প জানতে জানতেই আমরা ক্রমশ শিবানীকে জেনে ফেলবো। চিনে ফেলবো।

শিবানী সেন চুঁচুড়ার মেয়ে। চুঁচুড়া রেলস্টেশন আর খাদিনা মোড়ের মাঝামাঝি চুঁচুড়া স্টেশন রোডের ডানদিকে লেনিন নগর। শীতলা মন্দিরের পাশে শিবানীর সরকারি কর্মী বাবার ছোট্ট একতলা বাড়ি। সে সময়ের ১১ ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু পরীক্ষা দেয়নি। ছোটবেলা থেকেই নাচের অনুষ্ঠান করত। সরস্বতী পুজো দোল পঁচিশে বৈশাখ টপকে দুর্গাপুজোর বিচিত্রানুষ্ঠানের নিয়মিত আকর্ষণ। ক্লাস নাইন টেন থেকেই জনপ্রিয়তার স্বাদ বুঝতে শিখে গেল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল

প্রথমে টেপ রেকর্ডারে হিন্দি গান বাজিয়ে ভিডিওতে দেখা সিনেমার গানের নায়িকাকে হুবহু নকল করে শিবানীর নাচ আলাদা করে দর্শক টানতে শুরু করলো। কলকাতা শহরের অনুকরণে তখন গ্রামেগঞ্জেও অনুষ্ঠান আয়োজক-এর যুগ। তেমনই এক বুল্টিদার নজরে পড়লো শিবানী। নাচের পোশাক সঙ্গে জোরালো হিন্দি গান – আর ঝিকিমিকি আলোয় বদলে গেল শিবানী। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। তখন আর প্যাঁকপ্যাকে সাইকেল রিক্সা নয় বুল্টিদার লালরঙের ফিয়াটে চড়ে শিবানী সেজেগুজে মঞ্চের পাশে পৌঁছে যেত। নাচের অনুষ্ঠান শেষে আবার এসে গাড়িতে উঠতো। একেবারে ফিল্মস্টারের ধরনধারন। প্রতি অনুষ্ঠানে ২০০ টাকা।

সে সময়ে যথেষ্ঠ বেশি। তখন এক লিটার পেট্রলের দাম শুনলে আজ লোকের হয়ত হার্ট অ্যাটাক করবে। এক টাকা পাঁচ পয়সা প্রতি লিটার। ১৯৭৪ সালে ইরাক-ইরান ঝগড়ায় গালফ সমস্যায় পেট্রলের দাম লাফ দিয়ে একটাকা ৭৫ পয়সা হয়ে গেল। যাই হোক। আলো মিউজিক গাড়িভাড়া সাজগোজ এসব করেও শ’ দেড়েক থাকত। বাবা মণিকান্ত সেন না মানলেও মা শুভ্রা সেন বলতেন ‘ওর টালেন্ট থাকলে চেষ্টা করবে না কেন?’

সেই চূঁচূড়া ছাড়িয়ে কৃষ্ণনগর বর্ধমান তারকেশ্বর আরামবাগ দুর্গাপুরে ছড়িয়ে পড়ল শিবানীর নাচের সুখ্যাতি। অনুষ্ঠান বাড়তে বাড়তে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল। সন্ধ্যে্র নাচের অনুষ্ঠান মাঝরাতে গড়িয়ে যেত। বুল্টিদা তখন শিবানী আর শিবানীর মায়ের কাছে ম্যাজিসিয়ানের মত রঙিন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। শিবানীর চোখে গ্ল্যামারের নেশা।—চলবে

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২০

‘‘একটি দুটি অনুষ্ঠানে শিবানী একাই গেল। এদিকে বাড়িতে স্রোতের মতো টাকা ঢুকছে। বাড়িতে স্পষ্টতঃ দুটো ভাগ। বাবা মণিকান্ত সেন আর ছোট মেয়ে বনানী একদিকে। অন্যদিকে খ্যাতির চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখতে থাকা বড়মেয়ে শিবানী আর মা শুভ্রা।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content