রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


।।প্রণয়কান্তি ও বাবলি।।

মা তাঁদের শোবার ঘরে সেই গোলাপকলস খাটে বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকালেন। সেদিনের সে ঘটনা স্মৃতির পাতা থেকে যেন চোখের সামনে।

—সানন্দা বলেছিল, ‘বসুন্ধরা ভিলায় ফিরে এলে আমি হেরে যাবো দাদু। তুমি কি চাও তোমার নাতনি বসুন্ধরা দত্তের প্রপৌত্রী জীবনযুদ্ধে হেরে যাক।’ প্রবাদপ্রতিম বিনয়কান্তি দত্ত নন্দার মাথায় হাত রেখে চোখ বুজিয়ে বসেছিলেন। আর কোন আপত্তি করেননি। আমি বুঝতে পারি বংশমর্যাদা সানন্দার মেনে নেওয়াকে বাধা দিচ্ছিল। আমাদের মেয়ে হলেও নন্দা অনেকটাই তার ঠাম্মি স্বর্ণময়ীর মতো। আমার শাশুড়ি মা একবারও নন্দাকে বসুন্ধরা ভিলায় ফিরতে বলেননি। কিন্তু নেশা করে প্রণয় গায়ে হাত তোলার পর বাবলি যেদিন বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে যেতে চেয়েছিল তোমার ঠাম্মি সেই একই মানুষ, বাবলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে যাসনি মা! আমি কথা দিচ্ছি আমি যতদিন বাঁচবো তোর কোন অসম্মান হবে না। আমার পর তোর সেজকাকী সুরঙ্গমা তোকে দেখবে। নাতবউ হিসেবে নয় তুই নাতনি হিসেবে থাক।’ ওই ঘটনার পরপরই তোমার ন’ কাকা তরুণকান্তি তার সমস্ত শেয়ারের ৭৫ ভাগ বাবলির নামে লিখে দিয়েছিলেন। কোম্পানি থেকে পাওয়া মাসোহারা যাতে বাবলিকে দেওয়া হয় সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। সুজাতার প্রাপ্তি মাত্র ২৫ ভাগ। প্রণয়ের ভাগ শূন্য। তোর ন’কাকা নির্বিরোধী মানুষ। ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সমস্যা হল এরকম লোকের পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায় – আচমকা সে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ন’ঠাকুরপো যে এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে আমি সেটা ভাবতেও পারিনি।

—কিন্তু এর ফলে ন-কাকিমা বা প্রণয় দুজনেই ন’কাকার ওপর।

—ওদের ওই হম্বিতম্বিই সার। ভেতরে ভেতরে ওরা জানে বসুন্ধরা ভিলার আশ্রয় গেলে কোথাও জায়গা হবে না। সামাজিক প্রতাপ-প্রতিপত্তি সবটাই বসুন্ধরা ভিলার অংশীদার হিসেবে। আসল সত্যিটা তো কেউ জানে না। ঠাম্মি রেগে গিয়েছিলেন খুব প্রণয়কে ব্যবসা থেকে বের করে দেবার কথা ভেবেছিলেন। তোমার দাদুর মানাও শুনছিলেন না। শেষমেশ তোমার বাবার কথায় রাগ পড়ল।

—বাবা কী এমন ম্যাজিক করল?

—কী আবার? তোমার বাবা যা করেন। কথার জাদু। বললেন, ‘মা প্রণয়কে এত বড়ো সাজা দিও না। মানছি বাবলিকে অপমান করে সে ঘোর অন্যায় করেছে তার কোন ক্ষমা হয় না। আর তুমি কিছু বলার আগেই তোমার ন’ছেলে, প্রণয়ের বাবা তার যথার্থ শাস্তিবিধান করেছে। নিজের পূত্রবধূকে আত্মজের সম্মান দিয়েছে। তোমার ছেলে বলেই না আমাদের ন’খোকন এমনটা ভাবতে পেরেছে। আর বসুন্ধরা ভিলা এতবচ্ছর বৌ-ছেলেমেয়ে ছেলের বৌ নাতি নিয়ে যখন আমার মতো একটা নিস্কম্মাকে শাঁসে-জলে প্রতিপালন করছে, তখন বেচারি প্রণয়ের মাথার থেকে ছাতাটা কেড়ে নিও না।’ মা বললেন, ‘তুই নিস্কম্মা!’ তোমার বাবা উত্তরে বললেন, ‘নিস্কম্মা নই। শারদীয়া লিখে ক’টা পয়সা পাই? ছাপা বইয়ের রয়্যালটি সেই বা এমন কী সাতরাজার ধন। বইবিক্রির হিসেবই-বা কে কড়ায়গণ্ডায় দেয়। হ্যাঁ, সভাসমিতিতে ডাকে। ফুলের তোড়া তো বাড়ি আসতে আসতে শুকিয়ে যায়। বাঁধানো মানপত্র লাগানোর জায়গা নেই। যত্ন করে লাইব্রেরি ঘরে কাগজমুড়ে রাখা আছে। গলায় শাল ঝুলিয়ে দেয়, সে বেশ অনেকগুলো জমেছে কিন্তু তা দিয়ে হবে কী খবরের কাগজওলা বা দুধওলা মাসকাবারি টাকার বদলে কি সেই শাল নেবে?’ মা থেকে শুরু করে ঘরের সকলে হাসতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৭: দাম্পত্যজীবনের অশান্তিই দূর্ভাগ্যজনক পরিণতির কারণ?

অজানার সন্ধানে: অঙ্কই ধ্যানজ্ঞান, মোটা বেতনের চাকরি নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেন আইআইটি-র শ্রবণ

স্বাদে-আহ্লাদে: তপ্ত দিনে প্রাণ জুড়োতে বন্ধুদের জন্য বানিয়ে ফেলুন আমপান্না

হেলদি ডায়েট: এই ১০ খাবার শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও অন্ত্রের যত্ন নেয়, জানতেন?

আমার বাবা এমনই। জীবনের যে কোন কঠিন পরিস্থিতি খুব হালকাভাবে নিতেন। সব সময় ঠাট্টা করতেন। নিজে অত নামী সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও নিজেকেও কখনও খুব সিরিয়াসলি নেননি। অনেক সময় বেমালুম চুপ করে যেতেন। ঘরে আসছেন যাচ্ছেন চা খাচ্ছেন খাবার টেবিলে বসছেন কিন্তু কোন কথা নেই। আমার মা বুঝতে পারতেন এটা তাঁর ভেতরে ভেতরে সৃষ্টির সময়। আমার মায়ের জন্যই বোধহয় বাবা তার লেখক জীবনকে এত উপভোগ করতে পেরেছেন। আজও সমানভাবে একই রকম সহজ একই রকম হাস্যময়। রাগ করতেন না উত্তেজিত হতেন না। কারণ তিনি জানতেন মা সবকিছু সামলে নেবে। সব রকমের দায়দায়িত্ব কর্তব্য। আমি যখন স্কুল কলেজে বাবা একটা কথা খুব বলতেন। সত্যি সত্যি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন কিনা জানি না। কিন্তু বলতেন,

—দেখো সু! দায়-দায়িত্ব নিতে না হওয়াটা আসলে অসীম সৌভাগ্য। গতজন্মের ডিভিডেন্ড। তুমি বসে বসে দেখবে তোমার দায় কেউ ঘাড় পেতে নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত গতজন্মে কারও দায় নিয়েছিলাম তাই এ জন্মে ডিভিডেন্ড পাচ্ছি। তোমার মা নিশ্চয়ই পরজন্মে পাবেন। তিনি একা হাতে সংসারের সমস্ত ফাঁকফোকর ভরাট করছেন। তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য- আমার সামান্য ক’টাকা রোজগারের হিসেব-নিকেশ সবই তোমার মা করেন। আমাকে মাস গেলে একটা হাতখরচা ধরে দেন। ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়িতে পেট্রোল ভরিয়ে দেন। আমি পারিবারিক ব্যবসার কোন কাজে আসি না তাই আমি বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে কোন টাকা পয়সা নিই না।তোমাদের ছোটকা তবু বিজ্ঞাপন এটা, ওটা, খেলাধুলো প্রমোশন এসব অ্যারেঞ্জ করে। ব্যবসার জন্য সেগুলোরও প্রয়োজন আছে। তোমাদের মায়ের কল্যাণে আমি নেচেকুঁদে জীবন কাটাচ্ছি। এমন সৌভাগ্য কটা মানুষের হয় বলো। বড় হলে বুঝতে পারবে দায়-দায়িত্ব আশপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেজো লোক দেখলে ঝপাস করে লাফিয়ে তার কোলে উঠে পড়ে। তোমায় একটা উদাহরণ দিই। হালে তো ক্যাটারার হয়েছে। তারা পাতে পাতে হাতধোয়ার বাটিতে জল দিয়ে যায় পাতে বসেই লোকে হাত ধুয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে পরিপাটি করে হাত মুছতে পারেন। আমাদের ছেলেবেলায় এমন ছিল না। পাশের টিউবওয়েলে গিয়ে হাত ধুতে হতো। মজা হল কোন একজন ভদ্রতা করে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল টিপে জল দেওয়া শুরু করলে আর রক্ষে নেই। কাজের বাড়ির জনতা এসে নুলো বাড়িয়ে হাতটুকু ধুয়ে- মুখে পান গুঁজে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে যাবে। সে বেচারির এঁটো হাত শুকিয়ে যাবে । আর ধোওয়াই হবে না। দায়িত্ব হল চিবোনো চুইংগামের মতো। আঙুলে হাতে চিটচিট করে ছাড়ানো যায় না। তবে এজন্মের জমা সামনের জন্মের পূণ্যে কাজে লাগে। জগদীশ্বর ধার বাকি রাখেন না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং কয়েকটি প্রশ্ন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

সেদিন আর কথা এগোয়নি। এর বহুদিন পর মা আমায় ছোটকার মানসিক
টানাপোড়েনের কথা জানিয়েছিল। তখন আমার বড়ঠাম্মি চলে গিয়েছেন। প্রথমে পাবলিক বোর্ড মানে শ্যামবাজারের পেশাদারী নাটকপাড়ায় ছোটকার এক বন্ধু নাট্যপ্রযোজক বিপদ পড়ল। সে সময় থিয়েটারপাড়ায় কেসকাছারি লেগেই থাকত। তেমনই কিছু একটা ব্যাপার হবে। তো ছোটকা কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে। তারপর থেকে ছোটকার শ্যামবাজারপাড়ায় যাতায়াত বাড়ল।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৫: আর্য কোথায়?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২০: দুর্নীতির দুর্বিপাকে পিতৃতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব

তবে ছোটকাকে ছেড়ে এবার নন্দা মানে আমার বোন সানন্দা দত্তের কাছে ফিরতে হবে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে খুব ভালো রেজাল্ট করে নন্দা এনআরএস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। নন্দার সঙ্গে ফুলকাকার চিঠিপত্রে খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। নানাভাবে ফুল কাকা নন্দাকে গাইড করত। নন্দা ডাক্তারি পড়ছে জেনে কীরা কাকিমাও খুব খুশি। অর্ক দাসগুপ্ত নন্দার কলেজের ছাত্র। তিন বছরের সিনিয়র। র‍্যাগিংকে সূত্র করে নন্দার সঙ্গে বাদানুবাদ, তীব্র ঝগড়াঝাঁটি, রাগ পেরিয়ে অনুরাগ ছুঁয়ে গভীর প্রেম। আমার বাবা-মা খুবই খোলামনের মানুষ। কত বছর আগে তাদের পরস্পরকে ভালো লেগে বিয়ে হয়েছিল। তাই তারা দুজন মানুষের সম্পর্ককে সম্মান করতেন। যদিও আমার বিয়ে আত্মীয়তার সূত্রে সম্বন্ধ করে হয়েছে। কিন্তু নন্দার মতামতকে আমার মা বাবা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অর্ক আর সানন্দা খুব মানানসই কাপল। ওদের একসঙ্গে দেখতে এত ভাল লাগে অথচ ওরা একসঙ্গে থাকল না। থাকতে পারল না।—চলবে

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-১৮

”অর্কর সঙ্গে নন্দার প্রেমের ব্যাপারটা দিগন্ত প্রথম থেকেই জানত। কিন্তু দিগন্ত যে নন্দাকে বন্ধুত্বের বাইরেও জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করত – সেই সত্যিটা সে কখনও প্রকাশ করেনি । দিগন্তর বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা কি সেজন্যে? যেহেতু বিয়ের আগেই শ্রীতমা দিগন্তকে চিনত – সে হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content