রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকি। সৌজন্যে: সত্রাগ্নি

।।১৯৭০।।

কখনও কখনও রাগ ক্ষোভ আবেগ থেকে মানুষ বাড়তি উৎসাহে তার কর্তব্য পালন করে। দেশ স্বাধীন করার আগে সশস্ত্র আন্দোলনের বিপ্লবীদের মধ্যে পরাধীনতার জ্বালা ছিল। ইংরেজদের দেশ ছাড়া করার জেদ ছিল। তাই তারা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৭০ দশকের উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র-যুবরা বা তাদের পিছনে আড়ালে থাকা বিদগ্ধ তাত্ত্বিক নেতারা শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং মনে প্রাণে তা বিশ্বাস করতেন। তাই জীবনের মায়া না করে তারা লড়াইটাকে জেদের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামে শহরতলিতে বা শহরে বুর্জোয়াদের উৎখাত করার নামে এই আন্দোলন তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছিল। এই সময়টা নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। অমলকান্তি দত্তের বিখ্যাত উপন্যাস “হে উত্তাল সময়”-এ বাবা লিখেছেন—

“কম বয়সের আবেগ বেশি ছিল। তাই হয়তো প্রস্তুতির অভাবটা আন্দাজ করা যায়নি। অপেক্ষা ছিল না ধৈর্য ছিল না শুধু ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল। মূল তথ্য থেকে আন্দোলন যে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা বোঝার ক্ষমতা যাঁদের ছিল তারা সচেতন করেননি বা বলা যায় কিছু লোক তাদের সচেতন করতে দেয়নি। কৃষকদের মধ্যে যৌথ চেতনার জাগরণ ঘটেনি। আর এই উপলব্ধিও হয়নি যে দল কোনও বিপ্লব করে না। বিপ্লব করে মানুষ বিপ্লব করে জনতা। দল সচেতনভাবে বৈপ্লবিক চেতনা মানুষের থেকে মানুষকে চারিয়ে দিতে পারে। ফলে অতি বিপ্লবের কল্পনাবিলাসে হৃদয়হীন হয়ে উঠল সমাজের সবথেকে উজ্জ্বল অংশ শিক্ষিত অতিশিক্ষিত ছাত্র যুব সম্প্রদায়। গ্রামে আন্দোলন ব্যর্থ হল। শহরে স্কুল পোড়ানো মূর্তি ভাঙ্গা শুরু হল। নিরীহ কিছু মানুষ দিনে দুপুরে খুন হলেন। কিন্তু সেই অর্থে কোন মন্ত্রী কোনও উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিককে ছুঁতে পারল না এই দিকভ্রান্ত যুবকেরা। মাঝখান থেকে আন্দোলনের মধ্যে সুকৌশলে ঢুকে পড়লো কিছু গুন্ডা বদমাইশ খুনে ওয়াগান ব্রেকার, যাদের আন্দোলন ভাঙার জন্য সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পুলিশের নিচের তলার কনস্টেবল বা সাব ইন্সপেক্টর খুন হবার পর পুলিশ মহলের কাছে এটা আর নিতান্ত চাকরি থাকলো না। আন্দোলনকারীদের মতো তাদের এটা একটা যুদ্ধ হয়ে উঠলো। হাতের প্রশাসনিক সরকারি ক্ষমতা, মনের মধ্যে ভয়ঙ্কর রাগ এবং ক্ষোভ সে সময়ের একশ্রেণির পুলিশ অফিসারকে ভয়ঙ্কর নৃশংস করে তুলল। ফলে কোথাও কেউ ধরা পড়লে তাকে রাজনৈতিক বন্দির বিন্দুমাত্র সু্যোগ না দিয়ে কথা বের করার জন্যে অমানসিক অত্যাচার শুরু হল। একই ভাবে যাদের ভাই-বন্ধু সহযোগী কর্মী বা নেতা অত্যাচারিত হয়েছেন বা প্রাণ হারিয়েছেন তারাও প্রতিশোধের আগুনে বদলা নিতে শুরু করল। গ্রামের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই একসময় শুরু হয়েছিল, সে আন্দোলন গুলি-বোমার ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী যুদ্ধে পর্যবসিত হল।”

বাবার এই উপন্যাস অনেকটা পরে ‘৭৭-এ লেখা, তখন অনেক ভূতপূর্ব আন্দোলনকারী রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ছাড়া পেলেও অনেকেরই জেলের পুলিশি অত্যাচারে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। সময়টা বদলে না গেলে বাবাকেও হয়তো শ্রেণিশত্রু বুর্জোয়া হিসেবে গণ্য করা হতো।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১১: রাত বাড়লে গুলি-বোমার শব্দ, দরজায় অচেনা লোক এলে সন্দেহ হতো

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯: নুনিয়া

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

যাই হোক, সেলিমপুর বাইলেনের এক টিকটিকির গল্পটা শেষ করি। হঠাৎ মাঝরাতে বন্ধ বাড়ির বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে অল্প আলো দেখে সন্দেহ তো হবেই। সে তার এক সঙ্গীকে নিয়ে একতলার জানলায় যেতে গিয়ে অন্ধকারে পা লেগে পাশে পড়ে থাকা আধলা ইঁট খোলা ড্রেনের জলে ঝুপ করে গিয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে জানলার ফাঁক দিয়ে আসা সে আলোর রেখা গায়েব। নিতান্ত আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চাকরি হলে ওই একটুকরো ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো না বা অস্বাভাবিক মনে হবার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু পুলিশের লোকজন সেলিমপুর বাই লেনের ওই ভাড়াবাড়ির আশপাশে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করল। পুলিশের লোক অমিতাভ সেন এবং মনীষা সেনের স্কুল থেকে বাড়িওলার কাছ থেকে নানান লোক মারফৎ খবরাখবর যোগাড় করে ফেলল। অমিতাভ সেন জলপাইগুড়ির তিস্তা পারের সেনপাড়ার বাসিন্দা বাবা বিজয় সেন স্কুলশিক্ষক। মণীষা দে রানিনগরের মেয়ে। রানিনগর জংশন-এ নেমে ওদের বাড়ি যেতে হয়। অমিতাভের সঙ্গে পারিবারিক পরিচয়। সেদিনের পরে ওই বন্ধবাড়িতে এছাড়া আর অস্বাভাবিক কিছুই দেখা যায়নি। পুলিশও আগ বাড়িয়ে পা বাড়ায়নি। পুলিশি টহল নয়। রেড নয়। এমন কি থানাতেও এ নিয়ে কোন আলোচনা নেই। পুলিশের যে টিকটিকিরা প্রথম খবর এনে দিল তাদের অন্যত্র কাজ দিয়ে পাঠানো হল। সম্ভাবনার জন্য এই আশ্চর্য গোপনীয়তা, সেটা ফলে গেল।

সেদিন অমিতাভ আর মনীষা ভোরবেলা কলকাতা ফিরলেন। সকালে দু’ জনেই যে যার স্কুলে গেলেন। যোধপুর বয়েজ আর অ্যান্ড্রুজ হাইস্কুলের ক্লাসে ছাত্রদের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হল। দুপুরে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজব হল। সমবয়সী অনেকে জানতে চাইলেন ওরা আচমকা কোনো হনিমুনে গিয়েছিলেন কিনা। সন্ধেবেলা যথারীতি স্কুলফেরত টিউশন ক্লাসে বসলেন অমিতাভ। ছাত্রদের জন্যে জলপাইগুড়ির বিখ্যাত বেলাকোবার চমচম নিয়ে এসেছে ওরা। মনীষাদের বাড়ি রানিনগর জংশন থেকে বেলাকোবা ট্রেনে একটুখানি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১০: কান্না-হাসির দোল দোলানো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’

হেলদি ডায়েট: দ্রুত রোগা হতে চান? ভরসা রাখুন সুপারফুড ডালিয়াতে

ভিতরের দরজা দিয়ে মনীষা বাইরের ঘরে এল। একহাতে একথালা চমচম অন্য হাতে পিতলের জলের জাগ আর একটা খালি ঘটি। ঠিক দরজার পাশে একটা কাঠের সাবেকি টুলে জলের জাগ আর ঘটিটা নামিয়ে সেই রসালো চমচম কাঁসার থালায় সাজিয়ে সবে মাঝের টেবলে রেখেছে। বাবুদাদারা মূহুর্তে অংক খাতা নামিয়ে চমচমের থালায় হাত বাড়াতে যাবে। বাইরের ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে দুজন মাঝবয়সী মধ্যবিত্ত চেহারার শার্ট-প্যান্ট পরা অচেনা লোক ঢুকলেন। অমিতাভ মনীষা একটু অবাক। ছাত্রদের চমচম নিতে ইশারা করে অমিতাভ তাকালেন।

বলুন—আর এ ভাবে জুতো পরেই ঘরে ঢুকে এলেন।

সরি—ভুল হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা আপনি কি বাড়ি গিয়ে পড়ান?

আঁজ্ঞে না! আমি বাড়িতেই পড়াই। এখন ব্যস্ত আছি। এখন নতুন ছাত্র নেবার উপায় নেই।

না মানে পয়সাকড়িতে পুষিয়ে দেব।

মনীষা একটু বিরক্ত হয়ে জানাল।

উনি তো না বলছেন— আর নতুন ছাত্র নিলে তাকে বসাব কোথায়? এতটুকু তো ঘর? আর আজ বরং আসুন। এখন ছাত্র পড়ানোর সময়।

ঠিক! আপনারা তো মাঝে বাড়ি ছিলেন না।

অমিতাভ অবাক—

আপনারা মানে?

আগে দু’-দুবার এসে ফিরে গিয়েছি।

অমিতাভ এবার সচকিত। দ্বিতীয়জন আশ্বস্ত করেন।

ওই টিউশনির ব্যাপারে।

দ্বিতীয় লোকটি ততক্ষণে প্রায় ভিতরের দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। মনীষা চিৎকার করে ওঠে।

এ কি জুতো পরে আপনি ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

দ্বিতীয় লোকটা অদ্ভুত ভাবে বলে উঠলো।

জলটা এগিয়ে দিচ্ছিলাম। বাচ্চাদের গলায় বিষম লেগে যাবে। বেলাকোবার স্পেশাল চমচম!

মনীষা ওঠার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে ভিতর-দরজা আড়াল করে দাঁড়ানো লোকটা নিমেষের মধ্যে রিভলবার বের করে মনীষার মাথায় ধরে। বাচ্চারা আঁতকে ওঠে। অন্য লোকটা ততক্ষণে লাফ দিয়ে এসে অমিতাভর গলাটা জাপটে ধরে মুখের ভেতরে রিভলবারের নল ঢুকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে।
আরও পড়ুন:

খাই খাই: টক-ঝাল-মিষ্টি আমের চাটনি খেতে ইচ্ছে করে? বানিয়ে ফেলুন এভাবে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩০: সত্যজিৎ ও সুচিত্রা জুটির সেই ছবি তৈরি হলে তা মাইলস্টোন হয়ে উঠতে পারতো

বশ মানছে না ভুঁড়ি? রইল পাঁচটি সহজ টোটকা

একদম চুপ। কেউ চেঁচাবে না। সকলে মাথা নিচু করে মাটিতে বসে থাকো। আমরা পুলিশের লোক। অমিতাভ সেন আপনি বা আপনার স্ত্রী কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করবেন না। কোন বাচ্চাকে হোস্টেজ করার চেষ্টা করলে আপনিও মরবেন। বাচ্চাটাও মরবে। আনফরচুনেটলি আমরা এখন দয়ামায়া এসব বাড়িতে রেখে পুলিশে চাকরি করতে আসি। পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। পিছনে বাড়িওলার পোর্শানে সিঁড়িতে পুলিশ আছে। আশপাশের সবকটা বাড়ির ছাদে বারান্দায় ফায়ার আর্মস নিয়ে পুলিশ পজিশনে আছে। সুতরাং দেরি করবেন না, আপনারা একে একে আলাদা আলাদা পুলিশের গাড়িতে গিয়ে উঠুন। বাচ্ছারা বইপত্র নিয়ে ভ্যানে যাবে।

বাচ্ছারা যাবে মানে ওরা আমার ছাত্র, আমার কাছে পড়তে আসে।

ও সব নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না। ওসব আমরা বুঝে নেব। আপনাদের পিডি অ্যাক্টে অ্যারেস্ট করা হল। পিডি অ্যাক্ট জানেন তো প্রিভেন্টিভ ডিটেনশান অ্যাক্ট।

মনীষা একটু ভিতরে যেতে চাইছিল। মাথায় রিভলবারের খোঁচা দিয়ে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের লোকটি বলল।

উঁহু! ওসব থানায় গিয়ে হবে। এখানে ওসব ভদ্রতা মানবতার রিস্ক নিতে পারবো না।

অন্যজন তাড়া দেয়।

অযথা দেরি করবেন না। আপনাদের থানায় জমা করিয়ে। কাগজপত্র সেরে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে তো, দু’জনে দু’জায়গায় থাকি। আগে আমাদের কক্ষনো দেখেননি। পুলিশ অনেক চালাক হয়ে গিয়েছে। আজকের এই অপারেশনের জন্য আমাদের তুলে আনা হয়েছে। আমি সোদপুর থানা থেকে আর ও বেহালা।—চলবে

ছবি: প্রতীকি। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-১৩

“পাওয়া গেল চে গুয়েভারা ও মাও সেতুং-এর লেখা গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বইপত্রের ইংরেজি অনুবাদ। আর সেই বিখ্যাত রেড বুক। বুকপকেটে ঢুকে যায় এমন ছোট সাইজ। লাল রেক্সিনে মোড়া কার্ডবোর্ডের কভার। রেক্সিনের ওপরে এনগ্রেভ করে লেখা “কোটেশনস অফ চেয়ারম্যান মাও সেতুং”।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content