রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

।। সৌরভ ।।

ছোটবেলা থেকেই সু্বর্ণকান্তি খুব চুপচাপ। কথা শুনতো বেশি। ভাবতো বেশি, বলতো কম। সেটা হয়তো বাবা বা মাকে দেখে । এই ধীর-স্থির অভ্যেসটা ভাইবোনের মধ্যেও একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। অবশ্যই লকডাউন এর আগে সুবর্ণ কখনও ভাবেনি সে বসুন্ধরার কথা লিখবে। সে বড়ঠাম্মি দাদু বা ঠাম্মির কথা বাড়ির আর সকলের কথা লিখবে। তাই সে এমন অনেক কথা জানে যেগুলো কারও সঙ্গে কখনও আলোচনা করেনি। অথচ এতগুলো মাস ধরে বসুন্ধরা ভিলা বা সেই মানুষগুলোর কথা লিখতে বসে সেসব যেন দৃশ্য হয়ে পরপর তার মাথার মধ্যে ভেসে আসছে। লেখকদের কি এমনই হয়? বাবাকে দেখেছে। বাবা হিসেবে দেখেছে। মানুষ চেনে এমন একজন হিসেবে জেনেছে। কিন্তু তিনি লেখেন কীভাবে? কীভাবে মাথায় লেখা আসে? কীভাবে চরিত্রগুলো তৈরি হয়? সেগুলো নিয়ে কখনও বাবার সঙ্গে কথা বলার কোন সুযোগই ঘটেনি।

বাবু দাদা সৌরভের দাদা গৌরব যখন যোধপুর পার্ক বয়েজে ক্লাস সেভেনে উঠলো তখন থেকে একজনের কাছে অংক করতে যেত। স্কুলের পর। বেশি বয়স নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শিক্ষক শিক্ষিকা। অমিতাভদা যোধপুর পার্ক বয়েজে সায়েন্স এবং অঙ্ক পড়াতো। অমিতাভ সেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স। একটু পাগলাটে। ডাক্তারিতে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়নি। কেমিস্ট্রি ভালোবেসে টিচার হয়ে গেল। আর অমিতাভদার স্ত্রী মনীষাদি। মনীষাদি ইংরেজি পড়াতেন। অ্যান্ড্রুজ হাইস্কুলে। যোধপুর পার্ক থেকে বেরিয়ে সুবোধ মল্লিক রোড টপকালেই রাস্তার উল্টো ফুটপাথে। অ্যান্ড্রুজ হাইস্কুলের পাশে সেলিমপুর বাই লেন। ওই রাস্তা দিয়ে ঢুকে একটু এগোলে ওদের ভাড়াবাড়ি। স্কুলের পর অমিতাভদা টিউশনি করতেন। সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত ক্লাস সেভেন এইট। ছটা থেকে নটা নাইন টেন ইলেভেন। মনীষাদি বাড়িতে টিউশনি করত না। সমস্ত ছাত্রদের কাছে অমিতাভ বাবু বা স্যার নয়। অমিতাভদা। স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী মনীষা, দিদি বা মণীষাদি হয়ে গেল। বাবুদা পড়াশোনায় ভালো ছিল। ৫ বছরেই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিল। ‘৬৭তে ক্লাস সেভেন। মাঝবয়সী দম্পতি অমিতাভদা আর মণীষাদির ভীষণ প্রভাব ছিল বাবুদাদার ওপর। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা ওর ওপর দারুণ ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল।

অমিতাভদাকে মাস্টারমশাই হিসেবে নয়, একটা নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাবুদাদা। এমন হয়েছে বিকেলবেলার সাংঘাতিক বৃষ্টিতে গড়িয়াহাটে কোমর জল। তখন তো মোবাইল ফোন নেই। আর অমিতাভদাদের বাড়িতে ল্যান্ড ফোন ছিল না। বাড়িতে সকলে চিন্তা করছে কিন্তু অত জল ভেঙে গাড়ি যাবে কি করে? অমিতাভদা বাসে করে বাবুদাদাকে বাড়ির গেটে এসে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বসুন্ধরা ভিলায় ঢোকেননি। শুধু বলতেন গৌরবের হাতে ট্যুইশনের টাকাটা পাঠাবেন না। আসার অসুবিধে থাকলে টাকাটা মানি অর্ডার করে দেবেন। কিন্তু ওর হাতে দেবেন না। সেই থেকে বাড়ির কেউ টিউশনের টাকা নিয়ে যেত। বাবুদাদার কাছে অমিতাভদা মণীষাদি শুনতে শুনতে আমরাও তাই ডাকতাম। মায়ের কাছে পরে গল্প শুনেছি এই অমিতাভদা-মণীষাদি ছাত্রদের নিয়ে পিকনিকে যেত। সব খরচখরচা ওদের দু’ জনের। ১৯৬৯ সাল। বাবুদাদা ক্লাস নাইন। অঙ্ক আর কেমিস্ট্রিতে খুব ভালো নম্বর পায়। বাড়িতে ছোটখাট এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিত। অমিতাভদা নাকি বাবুদাদার জীবনের টার্গেট ফিক্স করে দিয়েছে। সে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয়, অমিতাভদার মতো কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বে। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। অমিতাভদা বলেছে অঙ্কে মাথাটা ভালো হলে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে ভালো নম্বর পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ক্রমশ ভালো বক্তা হয়ে উঠছিল বাবুদাদা। স্কুলের ডিবেটে নজরে পড়ে গেল। পড়াশোনার বাইরে নানান কথাবার্তা বলত। আমাদের বাড়িতে ছেলেপুলের সংখ্যা অনেক। চিনুদাদার থেকে বাবুদাদা এক বছরের বড়। বাবুদাদাও আমাদের গল্প বলতো। তবে সে অন্য গল্প। সাত বছর বয়সে প্রথম আমি বাবুদাদার কাছেই চে গুয়েভারার নাম শুনি।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৯: উড়িয়ে…বম্বের তাজ হোটেলে, তাজমহল টাওয়ার নয়, তাজমহল প্যালেসে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭: ওখানে কে?

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১২: প্রকৃত অর্থে পুজোর মধ্যমে ভগবান লাভের শর্তই হল চিত্তশুদ্ধি

এতদিন পরে যখন বাবুদাদাকে নিয়ে লেখার কথা ভাবলাম তখন আবার লাইব্রেরিতে খুঁজতে গিয়ে চে গুয়েভারার পৃথিবী বিখ্যাত ‘দ্য মোটরসাইকেল ডাইরিস’ বইটা হাতে পড়ল। ১৯৯৫ তে প্রকাশিত। হার্ডকভার। লাল হলুদ মলাট। ওপরের বাঁ দিকের কোণে এর্নেস্তো চে গুয়েভারার পরিচিত দৃঢ় ভঙ্গিতে সামনে তাকিয়ে থাকা উজ্জ্বল চোখের সেই দীপ্ত ফোটোগ্রাফ। নিচের ডানকোণে তাঁর সিঙ্গল সিলিন্ডার ৫০০ সিসির নর্টন বাইকের আঁকা ছবি।এই বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বিচারে বেস্টসেলার ছিল। চে গুয়েভারার মতো তার সেই বিখ্যাত ছবিও ইতিহাস। এই ছবি ‘গারিল্লেরো হিরোয়িকো’ নামে খ্যাত। ‘৫৬ থেকে ক্রমাগত অভ্যূত্থানের চেষ্টার পর ৬০ সালে ফিদেল কাস্ত্রো সফল। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন আর্জেন্টিনার লড়াকু বামমনস্ক নেতা গেরিলাযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী এবং পেশাগতভাবে একজন ডাক্তার চে গুয়েভারা, যাঁকে পরে কিউবার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। কাস্ত্রো সরকার নিজস্ব সুরক্ষার জন্যে বেলজিয়াম থেকে নানান অস্ত্রশস্ত্র মাইন এ সব আমদানি করছিল। ৪ মার্চ ১৯৬০ কিউবার হাভানা বন্দরে ফরাসি মালবাহি জাহাজ ‘লা ক্যুয়ব্রে’ থেকে আনানো বিস্ফোরক খালি করার সময় পরপর দু’ বার ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়। প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরদিন সমাধি অনুষ্ঠানের মিছিলে সামিল হয়েছিলেন কিউবার অভ্যুত্থানের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা জঁ পল সার্ত প্রমুখ। কাস্ত্রো বলেছিলেন এটি আমেরিকার ইন্ধনে সিআইএ-র অন্তর্ঘাত। কারণ কিউবা সুরক্ষিত হোক এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চায় না। সমাধি অনুষ্ঠানেই ক্ষোভে ফেটে পড়া চে গুয়েভারার এই পৃথিবীখ্যাত ছবি তুলেছিলেন আলবার্তো কোর্দা।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

তবে এসব গল্প বাবুদাদার কাছে শুনিনি। এতদিন পর চে’র সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম।

বাবুদা বলেছিল চে গুয়েভারার ছোটবেলার কথা। তাদের বাড়িতে প্রায় তিন হাজারের বেশি বই ছিল। ছোটবেলায় চে ভীষণ দাবা খেলতে ভালোবাসত। বাবুদাদা যেমন বাড়িতে নানান এক্সপেরিমেন্ট করে তেমনি চে গুয়েভারার একটা নিজস্ব ল্যাবরেটরি ছিল আর সেখানে সে ট্যালকম পাউডার আর গ্যামাক্সিন মিশিয়ে নতুন কীটনাশক তৈরির চেষ্টা করত। এই জন্য ছোটবেলা থেকেই চে হাঁপানির শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও সাঁতারে বা খেলাধুলোয় খুব ভালো ছিল চে। সাংঘাতিক গতিতে রাগবি খেলতে পারত। বড় হয়ে ডাক্তারিতে ভর্তি হল। ছাত্র থাকাকালীন নিজের বাই-সাইকেলে ছোট মোটর লাগিয়ে নিয়ে একা একা সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করে ফেলেছিল উত্তর আর্জেন্টিনার গ্রাম্য জীবনকে জানতে।এর বছর দুয়েক পর বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে সঙ্গে নিয়ে আট হাজার কিলোমিটারের অভিযান। তরুণ বয়সে গুয়েভারা যখন দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেছে, সে কিন্তু প্রকৃতির শোভা দেখতে পায়নি। গৌতম বুদ্ধের মতো গুয়েভারার চোখে পড়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভয়ঙ্কর কষ্ট। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকা, দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়া, অসুস্থ হলে একটু চিকিৎসা পাওয়া।
আরও পড়ুন:

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২৫: মা-বাবার বয়স বাড়ছে, এই সময় পড়ে গেলে বড় বিপদ ঘটতে পারে, সুরক্ষার প্রয়োজনে মানতে হবে কিছু নিয়ম/১

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

স্বাদে-আহ্লাদে: শীতে পছন্দের তালিকায় রয়েছে লাড্ডু? মিষ্টিমুখ হয়ে যাক গাজরের লাড্ডু দিয়েই

মানুষের এই যৎসামান্য চাওয়াটুকু যাদের জন্যে পাওয়া হয় না তাদের বিরুদ্ধে গুয়েভারার মনের ভিতর রাগ জমাট বাঁধছিল। চে গুয়েভারা প্রথম গুয়েতেমালার সমাজ সংস্কারের কাজে জড়িয়ে পড়ল। মেক্সিকোতে পরিচয় হল কিউবার কাস্ত্রো ভাইদের সঙ্গে। রাউল আর ফিদেল কাস্ত্রো তখন কিউবার অত্যাচারী শাসক বাতিস্তাকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে। চার-পাঁচ বছর হারতে হারতে শেষে বিপ্লবীদের জয় হল। কিউবার অভ্যুত্থানে ফিদেল কাস্ত্রো দেশের প্রধান হলেন। চে হলেন মন্ত্রী। এরপর কিউবা ছেড়ে আফ্রিকার কঙ্গো বা দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় মানুষের লড়াইয়ে ছিলেন এই গেরিলা যোদ্ধা। সাতষট্টি সালে বলিভিয়ার সামরিক শক্তি ছদ্মবেশী চে গুয়েভারাকে চিনতে পেরে গ্রেপ্তার করে এবং বিনা বিচারে তাকে হত্যা করে। যে সময় বাচ্চাদের ঠাকুরমার ঝুলি রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনার কথা তখন বাবু দাদা অমিতাভদার কাছে শুনেছিল চে গুয়েভারার কথা। তাকে ভিতরে ভিতরে খুব নাড়া দিয়েছিল চে গুয়েভারার জীবন ও তার লড়াই। খুব স্বাভাবিকভাবে আমি এসব গল্প আমার মাকে করেছিলাম। মা-বাবা দুজনেই খুব অবাক হয়েছিল।—চলবে

ছবি প্রতীকী। সৌজন্যে: সত্রাগ্নি

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-১১

“পুরো কলকাতা শহর অচেনা হয়ে যাচ্ছিল। রাত বাড়লে গুলি-বোমার শব্দ শোনা যেত। দরজায় অচেনা লোক এলে সন্দেহ হতো । রাতে লোকে পারতপক্ষে বাইরে যাচ্ছে না। সিনেমা হলের নাইট শো মোটামুটি বন্ধ। বিশেষ বিশেষ এলাকায় সন্ধে হলেই ট্যাক্সি যেতে চাইত না । ৬৯-এর কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেল।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content