শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবির নাম ‘দম লাগা কে হাইসা’। এই সিনেমায় বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছিলেন নায়িকাও।

বেশ কিছুদিন পর কোনও চেনা মানুষের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল, আপনাকে দেখে প্রথমেই তিনি মন্তব্য করে বসলেন “ওরে বাবা কী রোগা লাগছে, শরীর খারাপ নাকি?” অথবা “বেশ রোগা লাগছে কিন্তু”, “এই জামাতে তোকে অতটা মোটা লাগে না”! এই সব কোনও কিছুই আপনি জানতে চাননি যে, আপনাকে কেমন লাগছে ইত্যাদি। এমন ঘটনা বন্ধু মহল থেকেও হতে পারে। আসলে দেখামাত্রই শরীর নিয়ে মন্তব্য করার প্রবণতা। শুধু শরীরের আকার নয়, গায়ের রং উচ্চতা, বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে কুরুচিকর তীর্যক অপমানজনক মন্তব্য করার প্রবণতা থেকেই আসে বডি শেমিং।

দীর্ঘদিনের ক্লিনিক্যাল কাজের সূত্রে অনেক সময় দেখেছি, বহু মানুষ বডি শেমিংয়ের অভিঘাতে জর্জরিত। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা বহু বছর বাদে অনুধাবন করতে পারেন যে, তাঁরাও বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছিলেন।
অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের মধ্যে নিকট আত্মীয়র কাছ থেকে শরীরের আকার, ওজন, রং নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্যকে আমরা মান্যতা দিয়ে থাকি। অনেক সময় ভালোর জন্য বলছি ভেবে নিজেদের কাজকে নিজেরাই মান্যতা দিই। অনেক সময় অভিভাবকরা নিজেরা ভেবে নেন এই ধরনের মন্তব্য সম্ভবত তাঁর সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে কেউ করছেন। অথবা কাছের মানুষ সম্পর্কের অধিকারে বলছেন। তাই উল্টো দিকে যে মানুষটির এই মন্তব্য শুনে মনের মধ্যে কষ্ট পেলেন, যন্ত্রণা অনুভব করলেন, যাঁর মনের উপর, আত্মবিশ্বাসের উপর অনেক বড় অভিঘাত এল সেই মানুষটার কথা আর আমরা ভাবি না। অনেকের মধ্যে এখনও বডি শেমিং বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা আমাদের সবার মধ্যে আনতে হবে। আপনার শরীর নিয়ে, আকার নিয়ে, আকৃতি নিয়ে, গায়ের রং নিয়ে, কেউ কোনও ধরনের তির্যক মন্তব্য করলে তা ‘বডি শেমিং’। আর বিভিন্ন রকম যুক্তি দিয়ে অন্যের এই তির্যক মন্তব্যকে যাঁরা সমর্থন করার চেষ্টা করেন, তা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে হবে।
বয়ঃসন্ধি কালে বাচ্চাদের বিভিন্ন সময় স্কুলে, টিউশনে তাদের নিজেদের বন্ধু মহল থেকেও এ ধরনের তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়। এই ধরনের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মন খারাপ, দুশ্চিন্তা, নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্নবোধক অনুভূতি প্রকাশ পায়। এতে দৈহিক ভাবমূর্তি বা বডি ইমেজ সংক্রন্ত সমস্যা তৈরি হতো পারে। অনেক সময় অভিভাবকরা না বুঝে এই ধরনের কথা শুনতে পেলে বা জানতে পারলেও পাস কাটিয়ে যান। এমন অনেক আছেন যাঁরা প্রতিনিয়ত তাঁদের শরীরের গড়ন নিয়ে মন্তব্য শোনার ফলে পছন্দের খাবারটুকুও খেতে ভয় পান। অনেকে আবার দিনের পর দিন না খেয়ে ওজন কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা আয়নার সামনে দাঁড়াতেও কুন্ঠাবোধ করেন। এ সবই কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে শরীরের গরন-গঠন নিয়ে তির্যক মন্তব্যর ফলস্বরূপ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

মনের আয়না: ঘুমোতে গেলেই মগজে ভিড় করছে রাজ্যের দুশ্চিন্তা? জন্মাচ্ছে অকারণ ভয়? রইল সমাধান

ইংলিশ টিংলিশ: I talk কিন্তু he talks কেন হয়? সঙ্গে আরও জেনে নাও be এবং have verb-এর সঠিক প্রয়োগ

 

যে সব বিষয় আমাদের মাথায় রাখতেই হবে

 

প্রয়োজন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া

প্রাথমিকভাবে যেটা প্রয়োজন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। নিজের প্রাপ্ত শারীরিক আকার, গঠন, রঙের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ। হয়তো একদিনেই আসবে না। একবার লেখা পড়ে আসবে না। সময় দিয়ে ভাবি আমরা। আমরা কি কেউই পূর্বনির্ধারণ করতে পারি? আমাদের শরীরের গঠন, গড়ন, রং আকার, উচ্চতা। না, পারি না। তাই যা পেয়েছি, যেমন ভাবে পেয়েছি, তার উদযাপন করার অভ্যাস করতে হবে।
 

অসম্মান না করে বুঝিয়ে দিন

যাঁরা এ ধরনের মন্তব্য করেন তাঁদেরকে অসম্মান না করে জানান দিতে হবে, আপনি মোটেও আগ্রহী না এই জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে। অনেক সময় তাদেরও জানান দিন এই ধরনের মন্তব্যকে বডি শেমিং বলা হয়।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১০: সাধনা যে সত্যের আশ্রয় পাওয়ার তরে…

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৯: দাঁতে পোকা! সত্যি, নাকি নিছক ধোঁকা?

 

সর্বদা সজাগ থাকতে হবে

যাঁরা এই ধরনের মন্তব্য করেন তাঁরা যদি নিজেরাও একটু সজাগ হতে পারেন। যেমন ধরুন হঠাৎ কারও সঙ্গে দেখা হলে শরীর ছাড়া আর কী ভাবে কথোপকথন শুরু করা যায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করুন। তাঁর কাজ নিয়ে কথা হতে পারেন। সে কেমন আছে এই প্রশ্ন দিয়েও আলাপ শুরু করা যেতে পারে।
 

ইচ্ছে মতো যা খুশি বলা যায় না

যেখানেই স্বাধীনতা সেখানেই সচেতন হওয়া আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। নিজের কথা অন্যের উপর কী কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তার বিশ্লেষণ করা জরুরি। কিছু একটা বলে দেওয়া যায় না। নিজেও সজাগ হন। আপনার উপস্থিতি অন্যের অসুবিধার কারণ যেন না হয়।
 

জীবনে গভীর অভিঘাত হানে

বহু মানুষ দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা সঙ্গে দিন অতিবাহিত করেন। আমাদের পুরো গল্পটা কিন্তু জানা থাকে না। কেউ হয়তো সম্পর্ক জনিত কারণে আবেগের সমস্যায় ভুগছেন। অথবা কারণ হয়তো কোনও হরমোনগতভাবে সমস্যা শুরু হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে শরীর নিয়ে তির্যক কোনও মন্তব্য তাঁদের জীবনে গভীর অভিঘাত হানে। যিনি এই জাতীয় মন্তব্য করেন তিনি কোনওদিনই কিন্তু এই তথ্য জানতে পারেন না।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

 

অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে

পরিবারে অভিভাবকদেরও একটু সচেতন হতে হবে। অনেক সময়ই সন্তান এসে আপনাকে জানাচ্ছে কিন্তু সম্পর্ক, আত্মীয়তা ইত্যাদির কথা ভেবে এই বিষয়গুলোকে কিন্তু অবহেলা করবেন না। আপনি এ ধরনের মন্তব্য সমর্থন করেন না তা জানান। আর কীভাবে সামনের মানুষটিকে তা জানান দেওয়া যায় সেই আলোচনায় সামিল হোন। এতে আপনার সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এবং ওকে ওর নিজের কথা বলতে উৎসাহ দিন।
 

আচরণের প্রভাব নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ জরুরি

আমাদের, সব পাঠকে বলছি— বাইরের পৃথিবী কীভাবে আপনার সঙ্গে আচরণ করবে তা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিজে কতটা সেই আচরণের প্রভাব পড়তে দেব সেই নিয়ন্ত্রণ যেন নিজের কাছেই থাকে। আপনার চারপাশে যাঁরা এমন তির্যক মন্তব্য করে না এমন অনেক মানুষও আছেন। তাঁদের সঙ্গে সময় কাটান।

আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

পর্ব-২২: অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

 

তাড়াহুড়ো করে কিছু চাপিয়ে দেবেন না

যে সব অভিভাবক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক জায়গা থেকে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগে আছেন, তাঁরা তির্যক মন্তব্য না করে। বরং ওর সঙ্গে কথা বলুন। জানতে চান তার অসুবিধার কথা। ও কোনও সাহায্য চায় কিনা আপনার কাছে, সেটা জানার চেষ্টা করুন। কোন পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী কিনা সে বিষয়ে ওর মতামত নিন। তাড়াহুড়ো করে কিছু চাপিয়ে দেবেন না।
 

পাশে দাঁড়ান

সবশেষে বলব কারও মন্তব্যের ন্যায্যতা বিচার করার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার অনুভূতি। অভিভাবকরাও মন্তব্যের ন্যায্যতা বিচার থেকে বিরত থেকে বরঞ্চ সন্তানের অনুভূতির পাশে দাঁড়ান, মান্যতা দিন। আপনার যদি খারাপ লাগে তাহলে সেই বিষয়ে জানান, পাশে দাঁড়ান।

আপনাদের ‘ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ কলাম ভালো লাগছে জানিয়ে অনেক ইমেল আমাদের দফতরে আসছে। আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে এবং সে বিষয়ে পরামর্শ চাই, তাহলে নীচে দেওয়া ইমেইল-এ প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। আমি সেই প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আপনি নির্দ্বিধায় আপনার প্রশ্ন আমাদের ইমেল করুন, আমাকে জানান।
 প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ইমেইল: samayupdates.mentalhealth@gmail.com
* ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে (Menthal health and awareness) : লেখিকা সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, আমরি হাসপাতাল, কলকাতা।

Skip to content