ছবি: প্রতীকী।
আরও কেন এটা ভীষণ ভালোভাবে বোঝা দরকার বলুন তো? রোজের জীবনে যেমন খুব সহজেই আমরা মন খারাপকে আমাদের ডিপ্রেশন হয়েছে বলে তকমা লাগিয়ে দিই। ঠিক তেমনি যেটা আরও সাংঘাতিক, আমরা বলি ‘আরে একটু মনটা ঠিক করে নে’ বা ‘মন কে বুঝিয়ে নে’ ইত্যাদি মন্তব্য। হয়তো সেই ব্যাক্তির আপনার মন্তব্য না চিকিৎসার প্রয়োজন। আসলে যেটা বলতে চাইছি, এই দুই মন্তব্যই অবৈজ্ঞানিক। ভিত্তিহীন।
আসুন আমাদের জানার মাঝের এই অসম্পূর্ণতা, অপূর্ণতাকে তথ্য দিয়ে আরও উর্বর করতে পারি কিনা। তবেই আমরা আমাদের প্রয়োজনে এবং আমাদের চার পাশের মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারব।
ডিপ্রেশনের বাংলা নিম্নচাপও নয়, সাধারণ মন খারাপও নয়—অবসাদ
ডিপ্রেশন এক আবেগের ডিজঅর্ডার, যেখানে ব্যক্তির (ক) মন খারাপ ক্রমাগত ভাবে (পারসিসটেন্ট) বিরাজ করবে। সেই সঙ্গে (খ) আগ্রহের অভাব ও (গ) তীব্র ক্লান্তি বোধ। এর সঙ্গে আরও কিছু লক্ষণ যেমন—
মনোসংযোগের অভাব
কোনও কাজে মন দিতে অসুবিধে হতে পারে। অথবা মনোসংযোগ ধরে রাখতে না পারা। হয়তো কাজটা শুরু করলেন কিন্তু যথেষ্ট সময় ধরে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। ফলপ্রসূ কাজের প্রতি অনীহাও আসতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব
নিজের কর্ম দক্ষতার উপর আত্মবিশ্বাসের অভাব। কোনও কাজ শুরু করতে গিয়ে মনে হতে পারে আদৌ পারবেন কিনা। আসলে মনের মধ্যে নিজের কর্মদক্ষতা নিয়ে নানাবিধ সংশয় আসতে থাকে।
অপরাধবোধ ও অযোগ্য মনে হওয়া
উপরে লেখা যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি, সেগুলো একটু ভালো করে বুঝলে দেখতে পাবেন এই মন খারাপ যা দীর্ঘতর। সেই সঙ্গে আগ্রহের অভাব, তীব্র ক্লান্তি বোধ, মনসংযোগ আত্মবিশ্বাসের অভাব স্বভাবতই আপনার কাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আপনি দক্ষ হয়েও সেই সময় কাজটি আর আগের মতো দক্ষতার সঙ্গে করতে পারছেন না। ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাব আরও প্রগাঢ় হচ্ছে। আপনার দ্বারা হচ্ছে না বা হবে না, এমন মনোভাব আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের ফিডব্যাক ও পাচ্ছেন হয়তো। তার থেকেই আসছে অপরাধবোধ। নিজের পরিবারে বা কর্মস্থলে নিজের দক্ষতা নিয়ে সংশয় থেকে অপরাধবোধ আসতে পারে। এবং নিজেকে মূল্যহীন বা অযোগ্য বোধ হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায়। অতীতের ব্যর্থতার কথা গুলো বেশী মনে আসতে পারে।
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে: পরীক্ষা চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের আলাপচারিতা ও ভূমিকা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া
ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?
ভবিষ্যতের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
অবসাদে ভুগলে ব্যক্তির ভবিষ্যতের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আসতে পারে। ব্যাক্তির নিজের ক্ষমতা নিয়েও নেতিবাচক মনোভাবের উদ্রেক হতে দেখা যায়। তিনি নিজেকে অসহায় মনে করতে পারেন। ভবিষৎ নিয়ে কোনও আশার আলো দেখতে পারছেন না, এমন অনুভূতিও আসতে পারে। যাকে বলে আশহীনাতা।
মৃত্যুচিন্তা আসতে পারে
মনের অবসন্ন অবস্থানের কারণে এই সময় মৃত্যু চিন্তা বা আত্মহত্যার ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। যাঁরা এই মুহূর্তে পড়ছেন তাদের জন্য ট্রিগার সতর্কতা। কোনও চিন্তা যদি এই মুহুর্তে আসে, এমন কোনও অনুভূতি প্রত্যক্ষ করেন তাহলে দয়া করে ‘লাইফলাইন ফাউন্ডেশন’ এর দুটি হেল্পলাইন ০৩৩ ৪০৪৪৭৪৩৭ এবং ৯০৮৮০৩০৩০৩ নম্বরে যোগাযোগ করুন। আমি নিজে ফোন করে ওদের অনুমতি নিয়ে এই নম্বর দুটি উল্লেখ করলাম আপনাদের জন্য। তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সিলর, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কাজ করছেন। আর অবশ্যই কিছু সময় বিরতি দিন এই প্রতিবেদন পড়ার থেকে।
এছাড়া অবসাদের লক্ষণগুলির মধ্যে ঘুমের সমস্য এবং খিদেকমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া লক্ষণও যুক্ত হতে পারে। আপনার সাধারণ ঘুম ভাঙ্গার সময়ের অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যাওয়া। ভোরের দিকে অসম্ভব মন খারাপের অনুভূতি। খিদে এবং ঘুমের সমস্যা অন্য অনেক শারীরিক সমস্যার কারণেও হতে পারে। হয়তো প্রাথমিকভাবে অবসাদ নয়। অনেক শারীরিক জটিল দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে, যার সঙ্গে খিদে এবং ঘুমের সমস্যাও লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়। দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যার সঙ্গে অবসাদ কিন্তু আসতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের আন্তর্জাতিক মানের রোগ নির্ণায়ক গাইডলাইনগুলিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা আছে। যখনই উপরোক্ত বর্ণনা করা লক্ষণ বা লক্ষণ সমষ্টি দেখা দেওয়ার কারণে আপনার ব্যক্তিগত সামাজিক এবং কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ছে, তাহলে তার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হন। আমরা যাঁরা এই মুহূর্তেই প্রতিবেদনটি পড়ছি তাঁদের প্রত্যেককে আমার ব্যক্তিগতভাবেই প্রশ্নটা করা। যে কাজেই আপনি আছেন সেই কাজের মানের গুরুত্বপূর্ণ বদল একটি শক্তিশালী মাপকাঠি।
স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৮: মাতৃভাষায় লিঙ্গ বৈষম্য-বিরোধ জবানি
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৮: যেখানে বাঘের ভয় সন্ধে ঠিক সেখানেই হয়, আমারও ঠিক তাই হল
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
আচ্ছা একটু ভেবে দেখুন তো শরীর সব সময় একই রকম ভাবে ভালো থাকে? মানে ধরুন কোনও সেরকম নির্দিষ্ট রোগ নেই। তবুও সপ্তাহে প্রথম দিকে যেরকম শরীর নিয়ে বোধ করেছিলেন হয়তো মাঝের দিকে বা শেষের দিকে শরীরটা অতটা ভালো লাগছে না। কিংবা সকালের দিকে শরীর যতটা তরতাজা ছিল, দুপুর গড়াতে লাঞ্চ ব্রেকের পর ততটা আর নেই। উল্টোটাও হতে পারে। যেমন সকালের দিকে যেরকম একটা অনুভব করছিলেন, বিকেল গড়াতে কাজের শেষে বাড়ি ফিরে, একটু বেশি ভালো বোধ করছেন। এমন অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আপনাদের হয়েছে। আরেকটু যদি অন্যভাবে বলি। প্রকৃতির দিকে যদি আমি তাকাই, সেখানেও তো প্রতি মুহূর্তে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। সকালটাতে যেভাবে উজ্জ্বল সূর্যকে দেখে দিনটা শুরু হল, হতেই পারে দুপুর গড়াতে গড়াতে সূর্য মেঘের ফাঁকে লুকিয়ে পড়েছে। যতটা ফুরফুরে হাওয়া সকালে ছিল দুপুরের দিকে একটা গুমোট গরম হাওয়া বইতে শুরু করলো, যা অসহনীয়। আবার যে সকাল বৃষ্টি নিয়ে এসেছিল বেলার দিকে আকাশ জুড়ে আলোর ছড়াছড়ি। আসল কথা হল কোনও কিছুই শরীরে বা প্রকৃতিতে কোনও অভিজ্ঞতাই কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। এটা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়র একটি কবিতা কথা মনে আসছে। “মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই কেউ তা বোঝে না…প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায় আশায় আশায় আশায় আশায়।” সাধারণ মন খারাপ আর অবসরের মধ্যে মন খারাপের তফাৎ বুঝতে গেলে এটা একটা প্রতিকী উদাহরণ হতেই পারে। আশাহীনতা আশার আলো দেখতে না পাওয়া অবসাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সাধারণ মন খারাপে আশাহীনতা সাময়িক।
তাহলে মন খারাপ মানে কী বুঝবো? মন খারপ বোধ করা একটা পরিস্থিতি বিষয়ক আপনার আবেগের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সারাদিনের বা এই মুহূর্তে আপনার জীবনের যাত্রাপথে যা যা ঘটনা ঘটছে, তার প্রতি আপনারও তো একটা আবেগ গত প্রতিক্রিয়া আছে। ভালো না লাগা, মন খারাপ হওয়া, এটি সেই আবেগগত ক্ষেত্রের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ। প্রকৃতিগত ভাবে সাময়িক এবং সময়ের নিয়মে সমস্যার সঙ্গে আপনার যুঝতে পারার ক্ষমতা অনুযায়ী আস্তে আস্তে কিন্তু এর প্রভাব আবার ক্ষীণ হয়ে আসে। সামগ্রিক আশহীনতা নিয়ে কিন্তু আসে না।
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি
হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?
সম্প্রতি মহামারীর সময় মন সবসময় উল্লাস অনুভব করেছে কি? নিশ্চয়ই না। মন খারাপ করেছে, আমরা কারও সঙ্গে মিশতে পারিনি, বেড়াতে পারিনি, চারিদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রোগ, মৃত্যু! সবে মিলে অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁরা মন খারাপ উপলব্ধি করেছেন। সারাদিন বাড়িতে বসে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করেছেন। কিন্তু মনের আবহাওয়ার খবর জানতে চাইলে একদম মন ভালো ছিল না বেশির ভাগেরই। একদম শুরুর দিকে অবসাদের যে লক্ষণগুলোকে বুঝিয়েছি সেরকম কিছু যদি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দু’ সপ্তাহের অধিক একটানা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বা আপনার আশেপাশে, পরিবারের কোনও মানুষের মধ্যে দেখেন তাহলে অবশ্যই মনো চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
শেষ করবো রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন উল্লেখ করে, ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?” ঘটনার অভিঘাতে জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মনের গতিবিধি। সেখানে মেঘ করলে একটু সময় দিতে হবে। আর সেই দুঃখ যদি তার অভিঘাত দিয়ে সমস্ত মনো সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মজীবনের উপর চূড়ান্ত অভিঘাত আনে তাহলে অবশ্যই দায়িত্ব নিয়ে সচেতন নাগরিক হিসেবে মনো- চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। মনোবিদদের সঙ্গেও যোগাযোগ করবেন।
আপনাদের এই ‘ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ কলাম ভালো লাগছে জেনে অনেক ইমেল পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাদেরকে। আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে এবং সে বিষয়ে পরামর্শ চাই, তাহলে নিচে দেওয়া ইমেইল-এ ‘ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ বিভাগে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। এই বিভাগে আমি সেই প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আপনি নির্দ্বিধায় আপনার প্রশ্ন আমাদের ইমেল করুন, আমাকে জানান।