‘ভারতীয় মহিলাদের যৌনজীবন’—আদতে এই বিষয়টার অস্তিত্ব বাস্তবিক ক্ষেত্রে কতটা আছে সেই নিয়েই মাঝে মাঝে সন্দিহান হতে হয়। আমার ব্যক্তিগত পরিসরে এবং অবশ্যই কার্যক্ষেত্রে এমন বহু মানুষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে যাঁদের মানসিক অবসাদের মূল কারণ কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের যৌনজীবনে এবং এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্যই হলেন মহিলা। বহুদিন ধরে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ, সহজ আলোচনার পরিধি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি কিছু অন্ধ সংস্কারের বশে, যার ফলে পরবর্তীকালে অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু খুব ক্ষতিকারক কিছু প্রভাবের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদেরই সন্তান, দিদি, বোন বা বন্ধুদের তাঁদের বিবাহিত জীবনে।
প্রথমেই এটা বুঝে নেওয়া দরকার যে ভারতীয় মহিলাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌনজীবন সংক্রান্ত এই জাতীয় সমস্যাগুলির সম্মুখীন কেন হতে হয়? হরমোনজনিত কারণে বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে যৌন সমস্যার কথা আমি বলছি না। আমাদের দেশে মহিলাদের উপর সামাজিক ও পারিবারিক বোঝাটা বড়ই বেশি। সেই সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বাবলম্বীও নন। তাই নিজেদের মত বা অবস্থান নিয়ে কথা বলতে বিশেষত নিজের যৌন ইচ্ছা বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে সাহসও পান না। একটু বিস্তারিতভাবে সমস্যাগুলিকে যদি বলতে হয় তাহলে—
প্রথমত: এই সমস্যার মূলে রয়েছে লিঙ্গগত বৈষম্য। ছোটবেলা থেকেই একজন পুরুষ তাঁর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে যে সুযোগ সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে বা তাঁদের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যে বিষয়গুলো নিয়ে সর্বসমক্ষে আলোচনা না হলেও সেগুলোকে অন্তত ভীষণ স্বাভাবিক হিসাবে গণ্য করা হয় তাঁর লিঙ্গগত পরিচিতির কারণে, একজন মহিলার ক্ষেত্রে সেটা কখনওই করা হয়ে থাকে না। যার ফলস্বরূপ ছোটবেলা থেকেই কোনও না কোনওভাবে মহিলাদের অবচেতনে এমন একটা ধারণা ঢুকে যায় যে, ‘যেহেতু আমি একটি মেয়ে সেহেতু এই বিষয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারি না বা আমার নিজস্ব চাহিদা বা ইচ্ছাগুলো সম্পর্কে সরব হওয়া উচিত নয়৷’ কারণ ছোটবেলা থেকেই আমাকে শেখানো হয়েছে যে আমাকে কী কী করতে নেই। এই ‘করতে নেই’-এর তালিকা আজও আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিবারতন্ত্রের এত গভীরে শিকড় বিস্তার করে রয়েছে যে এই পরম্পরার ভয়াবহ ফসল হিসাবে বিশেষত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ভারতীয় মহিলাদের যৌনজীবন এক নির্বিকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরাও মেনে নেন যে বিবাহ-পরবর্তী জীবনে তাঁর অস্তিত্ব কেবল ‘স্বামী’র সম্পদস্বরূপ তাঁর ইচ্ছে মেটানোর এক যন্ত্রবিশেষ।
প্রথমেই মাথায় রাখা দরকার যে আমাদের জীবনের বাদবাকি আবশ্যিক জৈবিক ক্রিয়ার মতো যৌনতাও একটি অন্যতম ক্রিয়া যা মানুষের জীবনকে সচল ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে সাহায্য করে, সুতরাং এই বিষয়ে নারী পুরুষ উভয়েরই সমান সম্মতি ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তা নাহলে একটা সময়ের পর মানবজাতিকে অচল, অসাড় হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো কিন্তু অসম্ভব হয়ে যাবে। স্কুলে বর্তমানে ধীরে ধীরে সেক্স এডুকেশনের পাঠ আরম্ভ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও শিক্ষকরা, বিশেষ করে গ্রামের দিকে, এই বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সহজভাবে আলোচনা করতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। একই বিষয় দেখা যায় পারিবারিক ক্ষেত্রেও। যে কারণে বিয়ের পরে মহিলারা অনেক সময়েই এই বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন বা তাঁদের নিজস্ব ইচ্ছা বা সমস্যাগুলোর কথা তাঁদের স্বামীকে মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত: কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ছোটবেলায় মেয়েটি কোনওভাবে কোনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টের কারণে, মানসম্মানজনিত ট্যাবুর কারণে হয়তো বাড়ির লোকজন বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিল এবং খুব সম্ভবত এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করা হয়নি তাঁর সঙ্গে। ফলত যৌনতা সম্পর্কে তাঁর একটা ভয় থেকে গিয়েছে ছোটবেলা থেকেই যার প্রভাব পরবর্তীকালে পড়েছে তাঁর যৌনজীবনে। অনেক ক্ষেত্রেই এই ভয়ের কারণে মহিলাটির লিবিডো বা কামশক্তি অথবা কামনাজনিত ইচ্ছার অভাব দেখা যায়, যার ফলে যথাযথ ল্যুব্রিকেশন হয় না এবং অনেক সময়েই তাঁদেরকে যন্ত্রণাবহুল এক সংগম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
তৃতীয়ত: কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষ-সঙ্গীটির বিভিন্ন সমস্যা থেকে যৌনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেটা ইরেকশান বা লিঙ্গের শিথিলতা সংক্রান্ত সমস্যা বা শীঘ্রপতনের সমস্যা হতে পারে বা সংগম পূর্ব ফোরপ্লেতে হয়তো কোথায় গলদ থেকে যাচ্ছে। ফলত, মহিলা-সঙ্গীটি চূড়ান্ত পরিতৃপ্তির পর্যায়টি উপভোগ করতে পারছেন না কোনওভাবে, সেক্ষেত্রেও অনেক সময়ই মহিলারা এই নিয়ে পুরুষ-সঙ্গীটির সঙ্গে কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং নিজেদের গুটিয়ে নেন। হরমোন বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণ ছাড়া মূলত এই কারণগুলি থেকে যৌনজীবনে যে অপরিতৃপ্তি দেখা যায় সেই অপরিতৃপ্তি অধিকাংশ সময়েই রূপান্তরিত হয় মানসিক অবসাদে। অবসাদের প্রথম ধাপটিই হল এই সমস্যা নিয়ে কাউকে কিছু বলতে না পারা। পুরুষরা যদিও বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন, মহিলারা কিন্তু কখনওই সহজে এই নিয়ে অন্য কেউ তো দূরঅস্ত্, নিজের ঘরের মানুষটির সঙ্গেও চট করে কথা বলতে চান না। ফলস্বরূপ দাম্পত্যজীবনে অন্যান্য খুঁটিনাটি সমস্যা লেগেই থাকে এবং বহু ক্ষেত্রেই সেই সমস্যা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। পাশাপাশি আগে থেকেই যদি এই বিষয়ে কোনও ভয়ের অভিজ্ঞতা থেকে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রেও ভয় বা অ্যাংজাইটি থেকে যৌনক্রিয়ায় দ্বিধা ও জড়তা কাজ করতে পারে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের দায় নিয়ে চুপচাপ দিনের পর দিন জড়তাসহ যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলে সেখান থেকেও বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এই সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করতে হবে সেটি হল যৌনতা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর আলোচনার পরিধি প্রসারিত করা। এই পরিধিকে স্কুল থেকে পরিবার সবক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রসারিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য, যে সত্যের খুঁটিনাটি তথ্য বয়স অনুযায়ী যুক্তিপূর্ণভাবে সবার কাছে উপস্থাপিত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, সেটি হল বিয়ের পর স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে যদি আগে থেকে মেলামেশার সুযোগ না ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে যৌনতার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করাটা দাম্পত্যজীবনের জন্য অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হতে পারে। শারীরিক সম্পর্ক যথাযথভাবে তৈরি হওয়ার জন্য সবার আগে দরকার মানসিক মেলবন্ধন। পরস্পর পরস্পরের কাছে সহজ হতে না পারলে কিন্তু এই প্রক্রিয়া আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে হতাশাব্যঞ্জক করে তুলতে পারে। এবং সবশেষে, এই ধরনের যে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা আবশ্যিক। অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো চললে একটা সময়ের পর উভয়েই এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।
পুরুষ হিসেবে একজন মানুষের যৌন পরিতৃপ্তি যতটা জরুরি সমাজ এবং জীবনচক্রকে সুস্থভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন মহিলার ক্ষেত্রেও ততটাই জরুরি। তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে আপনার কাছের মানুষটির সঙ্গে তাঁর যৌনজীবন সংক্রান্ত যেকোনও সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন, প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার একটা সহযোগিতা কিন্তু সমাজের অনেক বদ্ধ আগলকে খুলে দিতে পারে, অনেক মানুষের জীবনকে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। তাই বস্তাপচা বদ্ধমূল সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসুন।
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
প্রথমেই এটা বুঝে নেওয়া দরকার যে ভারতীয় মহিলাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌনজীবন সংক্রান্ত এই জাতীয় সমস্যাগুলির সম্মুখীন কেন হতে হয়? হরমোনজনিত কারণে বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে যৌন সমস্যার কথা আমি বলছি না। আমাদের দেশে মহিলাদের উপর সামাজিক ও পারিবারিক বোঝাটা বড়ই বেশি। সেই সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বাবলম্বীও নন। তাই নিজেদের মত বা অবস্থান নিয়ে কথা বলতে বিশেষত নিজের যৌন ইচ্ছা বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে সাহসও পান না। একটু বিস্তারিতভাবে সমস্যাগুলিকে যদি বলতে হয় তাহলে—
প্রথমেই মাথায় রাখা দরকার যে আমাদের জীবনের বাদবাকি আবশ্যিক জৈবিক ক্রিয়ার মতো যৌনতাও একটি অন্যতম ক্রিয়া যা মানুষের জীবনকে সচল ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে সাহায্য করে, সুতরাং এই বিষয়ে নারী পুরুষ উভয়েরই সমান সম্মতি ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তা নাহলে একটা সময়ের পর মানবজাতিকে অচল, অসাড় হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো কিন্তু অসম্ভব হয়ে যাবে। স্কুলে বর্তমানে ধীরে ধীরে সেক্স এডুকেশনের পাঠ আরম্ভ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও শিক্ষকরা, বিশেষ করে গ্রামের দিকে, এই বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সহজভাবে আলোচনা করতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। একই বিষয় দেখা যায় পারিবারিক ক্ষেত্রেও। যে কারণে বিয়ের পরে মহিলারা অনেক সময়েই এই বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন বা তাঁদের নিজস্ব ইচ্ছা বা সমস্যাগুলোর কথা তাঁদের স্বামীকে মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেন না।
এই সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করতে হবে সেটি হল যৌনতা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর আলোচনার পরিধি প্রসারিত করা। এই পরিধিকে স্কুল থেকে পরিবার সবক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রসারিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য, যে সত্যের খুঁটিনাটি তথ্য বয়স অনুযায়ী যুক্তিপূর্ণভাবে সবার কাছে উপস্থাপিত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, সেটি হল বিয়ের পর স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে যদি আগে থেকে মেলামেশার সুযোগ না ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে যৌনতার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করাটা দাম্পত্যজীবনের জন্য অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হতে পারে। শারীরিক সম্পর্ক যথাযথভাবে তৈরি হওয়ার জন্য সবার আগে দরকার মানসিক মেলবন্ধন। পরস্পর পরস্পরের কাছে সহজ হতে না পারলে কিন্তু এই প্রক্রিয়া আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে হতাশাব্যঞ্জক করে তুলতে পারে। এবং সবশেষে, এই ধরনের যে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা আবশ্যিক। অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো চললে একটা সময়ের পর উভয়েই এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।
পুরুষ হিসেবে একজন মানুষের যৌন পরিতৃপ্তি যতটা জরুরি সমাজ এবং জীবনচক্রকে সুস্থভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন মহিলার ক্ষেত্রেও ততটাই জরুরি। তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে আপনার কাছের মানুষটির সঙ্গে তাঁর যৌনজীবন সংক্রান্ত যেকোনও সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন, প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার একটা সহযোগিতা কিন্তু সমাজের অনেক বদ্ধ আগলকে খুলে দিতে পারে, অনেক মানুষের জীবনকে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। তাই বস্তাপচা বদ্ধমূল সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসুন।
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।