ডাঃ অমিত চক্রবর্তী
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
মানুষের জীবনে তার সবথেকে কাছের, সবথেকে বেশি নিকটজন যে হয়ে ওঠে সে হল তার সন্তান। আত্মজের কাছে বাবা মা এবং বাবা মায়ের কাছে আত্মজ — সম্পর্কের এই সমীকরণ সৃষ্টির প্রথম থেকেই অত্যন্ত আবেগপূর্ণ এক সমীকরণ। সন্তানকে বাবা মায়ের মতো করে কেউ কখনো চিনে উঠতে পারে না, অন্তত আবেগের পরাকাষ্ঠা থেকে বাবা মায়েরা এমনটাই ভেবে থাকেন সারা জীবন। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে সন্তান বড়ো হয়, প্রকৃতির নিয়মে তার মধ্যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন আসতে থাকে। বয়ঃসন্ধিতে ছেলে-মেয়ের এই পরিবর্তন প্রকাশ্যে আসে সবথেকে বেশি, আর এই পরিবর্তনই অনেক সময়ে বাবা মা এবং সন্তানদের মধ্যে একে অপরের তরফ থেকেই এক প্রকার দূরত্বের সৃষ্টি করে থাকে। কখনও কখনও সেই দূরত্ব এবং ভুল বোঝার জায়গা থেকেই বয়ংসন্ধিতে ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন রকম আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। বঃয়সন্ধিতে এই জাতীয় সমস্যার কারণ, প্রবণতা এবং সমাধান সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি আমাদের জানালেন যে প্রাথমিকভাবে দুটি কারণে বয়ঃসন্ধিতে এই ধরনের আচরণগত সমস্যা দেখা যায়।
পরিবর্তনে অস্বস্তি!
● এই সময়টায় প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়ের মধ্যেই তেরো থেকে আঠারো এই নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমের মধ্যে সংঘটিত হরমোনাল পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। বিভিন্ন যৌন হরমোনের নিঃসরণের ফলে আসা এই শারীরিক পরিবর্তনগুলি তাদের মানসিক সংগঠনের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
● অনেকেই তাদের এই আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে না, যে না পারা থেকেই বিভিন্ন ভুল কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় পড়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়।
● এই সময়ে থেকে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের আত্মপরিচয়, নিজেদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে আরম্ভ করে। এই সচেতনতা থেকেই তারা নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসর সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। পূর্বপরিচিত বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গেও তারা একটা দূরত্ব বজায় রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এই সময়ে।
● অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা মায়েরা সন্তানদের এই স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে পারেন না। যেখানে তাদের ব্যক্তিগত পরিসরের সবথেকে বেশি প্রয়োজন সেখানেই বাবা-মায়েরা হয়তো সবথেকে বেশি হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করলেন কিংবা ছেলের কোনো মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে তার মেলামেশা নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য হয়তো করে বসলেন যেখান থেকে বাবা-মায়ের প্রতি বিরূপতাবশত সন্তানের সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আর ঠিক এই জায়গা থেকেই সূত্রপাত হয় সমস্যার। সন্তানকে কেন্দ্র করে বাবা মায়ের নিরাপত্তা বোধের অভাব এবং তার জন্য সন্তানের ক্রমবর্ধমান বিরক্তি থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা। সন্তান জড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজের সঙ্গে, কারণ বিরক্তি থেকে জন্ম নেয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যা তাকে হঠকারিভাবে অনেকসময়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রবৃত্ত করে। পাশাপাশি আসে হতাশা।এই হতাশা বা ডিপ্রেশনজনিত কারণে অনেক সময়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
সমস্যার উৎস লুকিয়ে আছে শৈশবেই
বয়ঃসন্ধিতে আচরণগত সমস্যার দ্বিতীয় কারণটি সম্পর্কে ডাঃ চক্রবর্তীর মত হল—কৈশোরের সমস্যা বলে আলাদা করে কোনো সমস্যা তো হয় না। যেকোনও সমস্যারই শিকড় লুকিয়ে থাকে তার শৈশবেই। হয়তো কোনো পরিবারে শিশুটির বাবা মায়ের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই সে অশান্তি দেখে বড়ো হয়েছে। সেই অশান্তির ফলে শিশুটির মধ্যে দিনের পর দিন তৈরি হওয়া মানসিক টানাপোড়েন বয়ঃসন্ধিতে এসে বিভিন্ন আচরণগত সমস্যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশের পথ তৈরি করে নিতে পারে। শৈশবে হয়তো কারোর মধ্যে মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা ছিল বা না বলে অন্যের জিনিস চুরি করার প্রবণতা ছিল। ঠিকসময়ে সেইদিকগুলিতে ঠিকমতো নজর না দেওয়ার ফলে বয়ঃসন্ধিতে এই প্রবণতাগুলি বিভিন্ন মানসিক ডিজঅর্ডারে পর্যবসিত হতে পারে।
আজকালকার যুগে গড়ে ওঠা নিউক্লিয়ার পরিবারও এই জাতীয় সমস্যা তৈরি হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বলে মনে করেন ডাঃ চক্রবর্তী। তাঁর মতে, আগে একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও বাড়ির অন্য কোনও সদস্যের সঙ্গে নিজের সমস্যা ভাগ করে নিতে পারত। ফলত নিজেদের মধ্যে অস্বস্তি চেপে রেখে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা হতাশাগ্রস্ত হয় পড়ার জায়গা ততটা তৈরি হতো না। কিন্তু বর্তমান সময়ে ছেলে মেয়েরা সেই সুযোগটুকুও পায় না। সুতরাং সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না।
সমাধানসূত্র
ডাঃ চক্রবর্তীর মতে, অভিজ্ঞতাসূত্রে আমরা দেখেছি —অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটু বাড়ন্ত গড়নের ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে বাবা-মায়েরা অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কারণ তাঁরা হয়তো কোথাও গিয়ে এটা ভেবে অস্বস্তিবোধ করেন যে আর কোনওভাবেই সন্তানকে নিজের আয়ত্তে রাখা সম্ভব হবে না। আমরা সেক্ষেত্রে সবসময়ই বলি, প্রথমেই সন্তানকে আয়ত্তে রাখার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসুন। কারণ, আপনি যত তাকে আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চাইবেন ততই তার তরফ থেকেও আয়ত্তমুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। পরস্পরের এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবই কিন্তু সন্তানের বিপথে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
সন্তানকে সুস্থ ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি সুস্থ দাম্পত্যজীবন। স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরকে সম্মান করতে পারেন, বাড়িতে শান্তি এবং নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে পারেন তবে কৈশোরে কিছু সমস্যা আসলেও যৌবনে পৌঁছে তা আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। পাশাপাশি, বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে ছোট থেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শেখানো। এতে বাবা-মা এবং সন্তান উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক টান থাকলেও কমবে অতিরিক্ত পরস্পরসাপেক্ষতা এবং সম্পর্কে আসবে যুক্তিবোধ।
ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, বিভিন্ন সমীক্ষায় বারবার দেখা গিয়েছে, মূলত এই নিউক্লিয়ার পরিবারের যুগে যে বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের টান কিন্তু কখনোই কমে না। কেবলমাত্র বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই টানের গোত্র এবং অভিব্যক্তি বদলে যায় এই যা, মত ডাক্তারবাবুর। সন্তানের পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলে এবং কোন সমস্যায় সন্তানের সঙ্গে মাথা ঠান্ডা করে কথা বলার পরিসর তৈরি করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিই হয়ে যায়। তাই বয়ঃসন্ধিতে সন্তানের আচরণগত সমস্যার ক্ষেত্রগুলিতে বাবা মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের ধৈর্যপূর্ণ আচরণ এবং প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ—উভয়ের সাহায্যে খুব সহজেই কিন্তু আপনার সন্তান অস্থিরতাকে পার করে পা বাড়াতে পারে এক সুস্থ এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের পথে।
বয়ঃসন্ধিতে আচরণগত সমস্যার দ্বিতীয় কারণটি সম্পর্কে ডাঃ চক্রবর্তীর মত হল—কৈশোরের সমস্যা বলে আলাদা করে কোনো সমস্যা তো হয় না। যেকোনও সমস্যারই শিকড় লুকিয়ে থাকে তার শৈশবেই। হয়তো কোনো পরিবারে শিশুটির বাবা মায়ের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই সে অশান্তি দেখে বড়ো হয়েছে। সেই অশান্তির ফলে শিশুটির মধ্যে দিনের পর দিন তৈরি হওয়া মানসিক টানাপোড়েন বয়ঃসন্ধিতে এসে বিভিন্ন আচরণগত সমস্যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশের পথ তৈরি করে নিতে পারে। শৈশবে হয়তো কারোর মধ্যে মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা ছিল বা না বলে অন্যের জিনিস চুরি করার প্রবণতা ছিল। ঠিকসময়ে সেইদিকগুলিতে ঠিকমতো নজর না দেওয়ার ফলে বয়ঃসন্ধিতে এই প্রবণতাগুলি বিভিন্ন মানসিক ডিজঅর্ডারে পর্যবসিত হতে পারে।
আজকালকার যুগে গড়ে ওঠা নিউক্লিয়ার পরিবারও এই জাতীয় সমস্যা তৈরি হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বলে মনে করেন ডাঃ চক্রবর্তী। তাঁর মতে, আগে একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও বাড়ির অন্য কোনও সদস্যের সঙ্গে নিজের সমস্যা ভাগ করে নিতে পারত। ফলত নিজেদের মধ্যে অস্বস্তি চেপে রেখে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা হতাশাগ্রস্ত হয় পড়ার জায়গা ততটা তৈরি হতো না। কিন্তু বর্তমান সময়ে ছেলে মেয়েরা সেই সুযোগটুকুও পায় না। সুতরাং সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না।
ডাঃ চক্রবর্তীর মতে, অভিজ্ঞতাসূত্রে আমরা দেখেছি —অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটু বাড়ন্ত গড়নের ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে বাবা-মায়েরা অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কারণ তাঁরা হয়তো কোথাও গিয়ে এটা ভেবে অস্বস্তিবোধ করেন যে আর কোনওভাবেই সন্তানকে নিজের আয়ত্তে রাখা সম্ভব হবে না। আমরা সেক্ষেত্রে সবসময়ই বলি, প্রথমেই সন্তানকে আয়ত্তে রাখার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসুন। কারণ, আপনি যত তাকে আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চাইবেন ততই তার তরফ থেকেও আয়ত্তমুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। পরস্পরের এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবই কিন্তু সন্তানের বিপথে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
সন্তানকে সুস্থ ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি সুস্থ দাম্পত্যজীবন। স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরকে সম্মান করতে পারেন, বাড়িতে শান্তি এবং নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে পারেন তবে কৈশোরে কিছু সমস্যা আসলেও যৌবনে পৌঁছে তা আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। পাশাপাশি, বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে ছোট থেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শেখানো। এতে বাবা-মা এবং সন্তান উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক টান থাকলেও কমবে অতিরিক্ত পরস্পরসাপেক্ষতা এবং সম্পর্কে আসবে যুক্তিবোধ।
ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, বিভিন্ন সমীক্ষায় বারবার দেখা গিয়েছে, মূলত এই নিউক্লিয়ার পরিবারের যুগে যে বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের টান কিন্তু কখনোই কমে না। কেবলমাত্র বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই টানের গোত্র এবং অভিব্যক্তি বদলে যায় এই যা, মত ডাক্তারবাবুর। সন্তানের পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলে এবং কোন সমস্যায় সন্তানের সঙ্গে মাথা ঠান্ডা করে কথা বলার পরিসর তৈরি করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিই হয়ে যায়। তাই বয়ঃসন্ধিতে সন্তানের আচরণগত সমস্যার ক্ষেত্রগুলিতে বাবা মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের ধৈর্যপূর্ণ আচরণ এবং প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ—উভয়ের সাহায্যে খুব সহজেই কিন্তু আপনার সন্তান অস্থিরতাকে পার করে পা বাড়াতে পারে এক সুস্থ এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের পথে।