জনমেজয়ের যজ্ঞসভা৷ ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে৷
মহাভারত হল কৌরব ও পাণ্ডবভাইদের জন্ম, তাদের বড় হওয়া, কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে তাদের যুদ্ধ এসবকে কেন্দ্র করে নানান আখ্যানের সমাহার। সুতগণ এক এক আখ্যান বলতে গিয়ে জুড়েছেন আরও কতশত আখ্যান। সেইসব আখ্যানমালা আর নানা চরিত্র নিয়েই এই গল্প বলা— মহাভারতের আখ্যানমালা। প্রতি সপ্তাহে এই ধারাবাহিকটি লিখছেন বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ -এর অধ্যাপক ড. অদিতি ভট্টাচার্য।
পর্ব-১
বহু বহু বছর ধরে বহু যুগ পার করে কত না কথার কথামালা জুড়ে এই ভারতসংহিতা৷ শুরুর কথা যদি জানতে চাই তাহলে চলে যেতে হবে, সেই নৈমিষারণ্যে৷ আজকের চেনা নৈমিষারণ্য সে নয়৷ ঋষিদের তপস্থলী পুণ্য সে আশ্রমপদে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রতচারী ব্রহ্মর্ষিদের দল৷ আমন্ত্রিত ছিলেন তাঁরা কুলপতি শৌনকের যজ্ঞে৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন লোমহর্ষণের সুযোগ্য পুত্র ঋষি উগ্রশ্রবা৷ পুরাণের কাহিনিগুলি তাঁর নখদর্পণে৷ তাই এমন জমায়েতে সকলেই শুনতে চায় পুরাণের জনমনোহর গল্পগুলি৷ এদিনেও তার ব্যতিক্রম হল না৷ সারাদিন ধরে চলেছে যজ্ঞাদি৷ দিনের শেষে সকলেরই জেগে উঠেছে শিশুর মতো গল্প শোনার অভিলাষ৷ সৌতিও অবশ্য নিরাশ করলেন না৷ শুরু করলেন পেরিয়ে আসা দিনের কাহিনি বলা৷ সৌতি উগ্রশ্রবা ফেলে এসেছেন জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ৷ কিন্তু ফেলে আসা সেই যজ্ঞ, যজ্ঞে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি কিংবা সেখানে শোনা কাহিনিগুলো তাঁর সারাজীবনের পাথেয় হয়ে রয়ে গিয়েছে৷ জনমেজয়ের সেই সর্পসত্র ছিল প্রতিশোধের যজ্ঞ৷ সর্পদংশনে পিতা পরীক্ষিতের অকালে মৃত্যু হয়েছে৷ পিতার এই অকালপ্রস্থান তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না৷ রাগ গিয়ে পড়েছিল গোটা সর্পকুলের ওপর৷ নিজের প্রিয় অমাত্যদের কাছে প্রকাশ করেন ক্ষোভ৷ জানতে চাইলেন উপায়৷ কীভাবে শত্রুনিধন সম্ভব? পরীক্ষিতের মৃত্যু ছিল দৈবনির্ধারিত৷ তক্ষক সেখানে ছিল নিমিত্তমাত্র৷ এসমস্ত কিছু জেনেও জনমেজয়ের হৃদয়ে জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন৷ স্থির করলেন সর্পকুল ধ্বংস করতে হবে৷ রাজপুরোহিতরা নিদান দিলেন সর্পযজ্ঞের৷ বড় দুরূহ সে যজ্ঞ৷ এবং জনমেজয়ের পক্ষেই সেটা করা সম্ভব৷ পাণ্ডবদের একমাত্র উত্তরাধিকারী তিনি৷ পিতৃহত্যার প্রতিশোধের অদম্য জেদই হয়তো তাঁকে যজ্ঞের অধিকারী করে তুলেছে৷ বেদের যজ্ঞের নিয়মেই নিয়ম তৈরি করলেন পুরোহিতেরা৷ বড় কঠিন সে নিয়ম৷ শুরু হল যজ্ঞ৷ নিধন হতে লাগল নিরপরাধ সাপেদের দল৷ বলি হতে লাগল জনমেজয় রাজার ক্রোধের আগুনে৷ কিন্তু যতই জ্বলুক প্রতিশোধের আগুন, এ বড় ক্লান্তিকর৷ আর যথারীতি দিনশেষে শরীরে, কখনও মনে তার চাইতেও বেশি ক্লান্তি ঘিরে ধরত৷ তাই তো দিনান্তে বসত গল্পকথার আসর৷ সেই সর্পসত্র বেশকিছু দিন ধরে চলেছিল৷ যদিও প্রতিহিংসার বশে শত্রুনিধনের জন্য যজ্ঞের এমন উদাহরণ বেদে দুর্লভ নয়, তবুও সর্পসত্রের কথা কোথাও নেই৷ তবুও অভিনব এ যজ্ঞ হয়েছিল৷ কুরুবংশের যোগ্য উত্তরাধিকারী রাজার ইচ্ছে যে! আর তা অনুমোদন করে তাতে সিলমোহর লাগিয়েছেন রাজার পুরোহিতেরা৷ বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজা জনমেজয়ের সেই যজ্ঞে নানাদিগ্দেকশ থেকে উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা৷ ঘটাপটা করে শুরু হয়েছিল যজ্ঞক্রিয়া৷
প্রতিদিনের যজ্ঞশেষের সেই গল্পের আসরে মুনিঋষিরা নিজের নিজের জানা বেদের গল্পগুলি পরিবেশন করতেন আর রসাস্বাদন করতেন আগ্রহী শ্রোতৃকুল৷ বেদব্যাস শোনাতেন মহাভারতের আশ্চর্য সব কাহিনি৷ দেশবিদেশ থেকে আসা স্বনামধন্য ঋষিমুনির সে দলে মধ্যমণি হয়ে হাজির হতেন জনমেজয়৷ আগ্রহ তাঁরও কিছু কম নয়৷ তাছাড়া অমন ক্লান্তিকর শ্রমসাধ্য যজ্ঞশেষে একটু বিশ্রাম কে না চায়? যদি বেদ মহাভারতের পুণ্য কাহিনি শুনে কোনওভাবে গ্নানিমুক্তি ঘটে৷ এটাও গল্পশোনার পিছনে সকলের উত্সাহের কারণ৷ নিরাশ করতেন না মুনিঋষিরাও৷ তাঁরা বেদ উপনিষদের নানান গল্পের ঝুলি খুলে বসতেন৷ শোনাতেন সকলের উপযোগী করে সরলভাষায়৷ সভায় উপস্থিত বেদব্যাস শোনাতেন মহাভারতের গল্প৷ সৌতির ভূমিকা এখন তাঁদের৷
তবে বেদের গল্পগুলির চাইতেও জনমেজয়ের বেশি আগ্রহ ছিল মহাভারতের অপূর্ব সে সব আখ্যানের প্রতি৷ তাঁর মনে হত, বেদের রহস্যে ঘেরা ঘটনারাজির চাইতেও মহাভারতের গল্পই যেন আরও মনের কাছাকাছি৷ তাই তাঁর শুনে আশ মিটত না৷ বেদব্যাসই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের৷ কেমন ছিলেন তাঁরা? কী ছিল তাঁদের চরিত্র৷ সে কথা আরও বিশদে শুনতে চান তিনি৷ আরও বিশদে জানতে চান কুরুপাণ্ডবদের চরিত্র৷ বেদব্যাস ও নিরাশ করলেন না রাজাকে৷ আদেশ দিলেন বৈশম্পায়নকে৷ বৈশম্পায়ন তাঁর উপযুক্ত শিষ্য৷ এরপর বৈশম্পায়ন হাল ধরলেন৷ তিনি হলেন সৌতি৷ সৌতি বৈশম্পায়নের গল্প বলার প্রসিদ্ধি তো সর্বজনবিদিত৷ তাই ঋষি রাজরাজড়ারা এমন সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত খুশি৷ এদিকে গুরুর আদেশ পেয়ে বৈশম্পায়ন সর্বসমক্ষে বলা শুরু করলেন, অপূর্ব সে আখ্যান মহাভারত যার নাম৷ এক গল্প বলেন, বলতে বলতে তার সঙ্গে এসে জুড়ে যায় আরও কতশত গল্পের মালা৷ সামনে যখন এমন যুগপৎ মুগ্ধ আর বিদগ্ধ শ্রোতার দল তখন বক্তাও বলে চলেন সমান উত্সাহে৷ বক্তার মেধাদীপ্ত গল্পকথনে যোগ হয় নানান উপদেশকথা, সমাজের টুকরো ছবি থেকে শুরু করে দর্শনের গুরুগম্ভীর আলোচনা৷ ভারতকথা শোনার সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় উপস্থিত সকলে৷